প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৯:২৯
নির্মোহ রাজনীতির আদর্শ পুরুষ এম এ ওয়াদুদ
রাজনীতিতে ত্যাগী, নিঃস্বার্থ, আপসহীন ও নির্মোহ বলতে যা বোঝায় এম এ ওয়াদুদ ছিলেন তা-ই। তাঁর নীরব, নিরবচ্ছিন্ন নিরলস ভূমিকা এবং নির্মোহের জায়গাটি স্বতন্ত্র। ক্ষমতা ও পদ-পদবীর কোনো মোহ তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি। একসময় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদটি ছেড়ে দিয়েও তিনি রাজনৈতিক কর্তব্যকর্মে সক্রিয় ছিলেন। জিল্লুর রহমান লিখেছেন, ‘১৯৫৪ সালের নির্বাচনে শেরেবাংলা-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট ওয়াদুদ সাহেবকে মনোনয়ন দিতে চেয়েছিল।’ ১৯৭০ সালেও তিনি নির্বাচন করেননি, তবে রাজনীতি ও দেশের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য ছাড়েননি।
|আরো খবর
১৯২৫ সালের ১ আগস্ট চাঁদপুরের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারী এম এ ওয়াদুদ আজীবন নিজ ধর্মে নিষ্ঠ থেকে অন্য ধর্মের বিষয়ে উদার ছিলেন। তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতা জীবনের সব ক্ষেত্রেই প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনার ছাত্রলীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক। ১৯৫৩ সালের যে কাউন্সিলে ছাত্রলীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়, সে কাউন্সিলে তাঁকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও সেক্যুলার ও প্রগতিশীল রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। হাশেম খান বলেছেন, ‘...বলা যায় প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই তিনি ‘মুসলিম ছাত্রলীগকে’ পুরো অসাম্প্রদায়িক ছাত্রলীগে রূপান্তরিত করেছিলেন।’ ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন।
ভাষা আন্দোলনের শুরুতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, একই দিনে এম এ ওয়াদুদও আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার হন। ভুখা মিছিল আন্দোলনের কারণে ১৯৪৯ সালে তিনি জেল খেটেছেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ১৯৪৯ সালে ওয়াদুদও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারিতেও তিনি গ্রেপ্তার হন এবং প্রায় ছয় মাস জেল খাটেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম কমিটি (১৯৫১) ও সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদেরও (১৯৫২) সদস্য ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৩ সালে তাঁকে একুশে পদকে (মরণোত্তর) ভূষিত করা হয়। তিনি ছিলেন প্রখর সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাহীন হলে মন্ত্রিপরিষদে না থাকা সত্ত্বেও তাঁকে জেল দেওয়া হয়েছিল। তিনি গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, কচি-কাঁচার মেলা এবং ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। মুক্তিযুদ্ধের জনমত গঠনেও তাঁর অবদান গুরুত্বপূর্ণ।
মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, মুক্তবুদ্ধি, সৎ চেতনাসম্পন্ন ও নির্লোভ এম.এ. ওয়াদুদের সান্নিধ্যে যাঁরাই গিয়েছেন, তাঁরাই তাঁর নির্মোহ দেশপ্রেমের রাজনীতির প্রশংসা করেছেন। তাঁর সততা, দেশপ্রেম, দায়িত্ব-কর্তব্যে কোথাও আপস নেই। আদর্শ, প্রত্যয় ও লক্ষ্য থেকে কেউ তাঁকে টলাতে পারেনি। ১৯৬২ সালেও তাঁর বিরুদ্ধে সামরিক ওয়ারেন্ট জারি হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক সরকার মন্ত্রীর পদ দিয়ে তাঁর ম্যান্ডেট নিতে চাইলেও তিনি আপস করেননি। তোফায়েল আহমেদ লিখেছেন, ‘১৯৭৮-এ স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিত্ব গ্রহণের প্রস্তাব তিনি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা দায়ের করে তাঁকে তিনবার বিভিন্ন মেয়াদে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়।’
এম এ ওয়াদুদকে যতই অধ্যয়ন করা হয়, ততই তাঁর সেবা, দেশপ্রেম ও নির্মোহ রাজনীতি পরস্ফুট হয়। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী,’ ‘কারাগারের রোজনামচা,’ ‘আমার দেখা নয়াচীন’ এবং পাকিস্তানের গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাঠেও তাঁর রাজনীতির তথ্য পাওয়া যায়। তিনি দেশের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, আদর্শ ও জ্ঞানের বুদ্ধিবৃত্তিক সমুন্নতি ঘটিয়েছেন, আবার পরিবারের প্রতিও নিষ্ঠাবান থেকেছেন। তাঁর এক পুত্র ও এক কন্যা, দুজনেই চিকিৎসাবিজ্ঞানে ডিগ্রিধারী। তাঁর কন্যা ডাঃ দীপু মনি বর্তমানে বাংলাদেশের প্রথম নারী শিক্ষামন্ত্রী। ডাঃ দীপু মনি বাংলাদেশের প্রথম নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন।
এম এ ওয়াদুদ ছাত্ররাজনীতি, দলীয় রাজনীতি, সাংবাদিকতা, লেখালেখি, শিশু সংগঠন, সংস্কৃতিসেবা-সবই নিষ্ঠার সঙ্গে করেছেন। আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘আবদুল ওয়াদুদ ছিলেন সেই সব মানুষের একজন, যাঁরা অন্তরের প্রেরণায় ও বিবেকের তাড়নায় নিরন্তর কাজ করে যেতেন; কিন্তু কোনো প্রতিদানের আশা করতেন না, এমনকি তাঁর কাজের উপযুক্ত স্বীকৃতি মিলল কি না তা নিয়েও উদ্বিগ্ন হতেন না।’ তাঁর মূল্যবোধ, পরিমিত জীবনবোধ এবং অসাম্প্রদায়িক, আপসহীন, ত্যাগী ও নির্মোহ রাজনীতি অধিক প্রচার করা হলে উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির পথ সুগম হবে। ১৯৮৩ সালের ২৮ আগস্ট ৫৮ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এম এ ওয়াদুদের স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক