শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৫ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০২২, ০০:০০

নূরের নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এলেন ধরায়

আবুল হাসান মোহাম্মদ বায়জীদ

নূরের নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এলেন ধরায়
অনলাইন ডেস্ক

‘রবিউল আউয়াল’ মানে ‘প্রথম বসন্ত’। ঋতুরাজ বসন্তে প্রকৃতি তার পূর্ণাঙ্গ রঙ-রূপ-সৌন্দর্য মেলে ধরে। গাছে নতুন পাতা গজায়, বাগানে অনিন্দ্য সুন্দর-মনোহর ও সুগন্ধি ফুলের ঘ্রাণ মৌ মৌ করে। পাখি ডাকে, নদী বয়, কোকিলের কুহুতানে হৃদয় জুড়ায়। সাড়ে ১৪শ’ বছর আগে জগতে বসন্তের সূচনা হয়েছিল এক নূরের টুকরার শুভাগমনে। যুগ যুগ ধরে অনাবৃষ্টি, প্রকৃতির রুক্ষ্মতা, অভাব-অনটন, হাহাকার, জুলুমের তাপদাহে জ্বলন্ত অঙ্গারে পরিণত হওয়া শুষ্ক-প্রাণহীন দুনিয়ায় তিনি আগমনের সাথে সাথে খোদার রহমতের বারিধারা যেন উপচে উপচে পড়েছিল। সীরাত বিশেষজ্ঞগণ বলেন, তাঁর আগমনের বছরকে দুনিয়াবাসী ‘ছানাতুল ফাত্হি ওয়াল ইব্তেহাজ’ বা বিজয় ও আনন্দ-উৎসবের বছর বলে গণ্য করতো। ভারাক্রান্ত মানবতার দুঃখ ঘুচাতেই তিনি এসেছেন। তাঁকে কেন্দ্র করেই জীবন ও জগতের সবকিছু। তিনি না আসলে না জগত সৃজন হতো, না সূর্য আলো দিত, না চাঁদ আলো বিলাতো, না পাখি গাইতো, না ফুল ফুটতো, না গাছে ফল ধরতো! তিনি না হলে না নদীতে ঢেউ উঠতো, না সাগরে জোয়ার আসতো, তিনি না হলে না আমরা হতাম, না কিছু অস্তিত্ববান হতো! এমনকি তিনি না হলে এক আল্লাহর পরিচয়ও পেতাম না আমরা। তিনি সৃষ্টিতে, বৈশিষ্ট্যে সবদিক থেকে অনন্য-অনুপম। জগতের সব সৌন্দর্য ও মর্যাদা তাঁর কদমধূলির ছিঁটে-ফোঁটা মাত্র! তাঁর মধ্যে কোন ত্রুটি নেই, খুঁত নেই, কলঙ্কের লেশমাত্রও নেই। তাঁর নাম রেখেছেন আল্লাহ তায়ালা ‘মুহাম্মদ’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। যাঁর অর্থ ‘সর্বপ্রশংসিত’ সত্তা। তাঁর আগমনের পদ্ধতিও ছিল সবার থেকে ভিন্নতর, অতি অসাধারণ প্রক্রিয়ায়। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক নূর। নূর হিসেবে মহান আল্লাহ তাঁকে সৃষ্টি করেছেন এবং নূর হিসেবেই জগতে পাঠিয়েছেন। কুরআনুল কারীমের সূরা মায়িদার ১৫নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- “নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট হতে তোমাদের কাছে নূর এবং স্পষ্ট কিতাব এসেছে।” আয়াতে কারীমায় ‘নূর’ দ্বারা অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

তিনি নিজেও নিজেকে নূর বলে পরিচয় দিয়েছেন- হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করে তাকে তার সন্তানদের সম্পর্কে সংবাদ দেন, তখন তিনি কতেক সন্তানের উপর অপর কতেকের মর্যাদা দেখতে পান। তিনি তাদের সর্বশেষে নিচের দিকে আমাকে একটি উজ্জ্বল নূর হিসেবে দেখতে পেয়ে বললেন, হে প্রভূ! ইনি কে? আল্লাহ তায়ালা বললেন, ইনি হলেন তোমার পুত্র আহমদ। তিনিই প্রথম, তিনিই শেষ এবং তাঁর সুপারিশই কবুল করা হবে।’ [দালাইলুন নবুওয়্যাহ-হাদিস নং ২২২৫, কানযুল উম্মাল- হা: নং ৩২০৫৬, কিতাবুল আওয়ায়েল ইবনে আসেম- হাদি: নং-০৫] এই হাদিসের প্রত্যেক রাবী সিক্বাহ এবং সনদ হাসান বা উত্তম পর্যায়ের। ‘রূহের জগতে’ তাঁকে সর্বপ্রথম নূর হিসেবে সৃষ্টি করে পর্যায়ক্রমে এই ‘নূরে মুহাম্মদী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে স্থান থেকে স্থানে স্থানান্তর করে পৃথিবীতে পাঠান। হাদিস ও সীরাতের বিভিন্ন কিতাবের বর্ণনা অনুযায়ী তার ধারাবাহিকতা হলো-

বেহেশতে নূরে মুহাম্মদী হযরত আদম আলাইহিস সালামের ঔরসে রাখা হয় এবং নূরের ঝলক পেশানী থেকে বিচ্ছুরিত হত। [মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যাহ-১/৪৯] আদম (আঃ)-এর কপালে নূরে মুহাম্মদী রাখার পরে তিনি একদিন পেশানী থেকে হালকা আওয়াজ শুনতে পেলেন। আল্লাহ তায়ালাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কীসের আওয়াজ? আল্লাহ জবাব দিলেন- এটা হচ্ছে তোমার সন্তানদের মধ্যে যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ তাঁর তাসবীহ এর আওয়াজ। এছাড়া বর্ণিত আছে আদম (আঃ)-এর কপালে নূরে মুহাম্মদী প্রখর সূর্যের মত ঝলমল করতো [শরফুল মুস্তফা-১/৩০১, ৩০২]

জান্নাতের নূরাণী পরিবেশে হাজার কোটি বছর অবস্থান করার পর নূরে মুহাম্মদী বাবা আদমের সাথে পৃথিবীতে নেমে আসেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাদিঃ) থেকে বর্ণিত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘আদম (আঃ) সৃষ্টিরও দুই হাজার বছর পূর্ব থেকে নবীজীর রূহ মুবারক নূর হিসেবে আল্লাহর সামনে তাসবীহ পাঠ করতেন, তাঁর তাসবীহ শুনে ফেরেশতারাও তাসবীহ পাঠ করতো। আল্লাহ যখন আদম (আঃ) কে তৈরী করলেন, তখন আদমের পৃষ্ঠদেশে ঐ নূরে মুহাম্মদী স্থানান্তর করেন। অত:পর আদমের সাথেই ঐ নূর পৃথীবিতে নেমে আসেন, সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে নূহ (আঃ)-এর পৃষ্ঠে, তারপর নবী ইবরাহীম খলিলুল্লাহ (আঃ)-এর পৃষ্ঠে নূরে মুহাম্মদী স্থানান্তর করা হয়।’ [আশ শিফা-১/৮৩, খাছাইছুল কুবরা-১/৬৭, সীরাতে হালাবিয়্যাহ-১/৪৯]

হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র নসবনামায় আদি পিতা আদম (আঃ) থেকে শুরু করে আব্বাজান খাজা আবদুল্লাহ (রাদিঃ) এবং আম্মাজান আমেনা (রাদিঃ) পর্যন্ত প্রত্যেকেই ছিলেন জ্ঞানে-গুণে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে যুগের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি। পবিত্র কুরআনের সূরা আশ শুআ’রা-এর ১৯নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘আমি আপনাকে (যুগে যুগে) সিজদাকারীদের মধ্যে স্থানান্তর করেছি’। এই আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে মুফাসসীরকুল শ্রেষ্ঠ ইবনে আব্বাস (রাদিঃ) বলেন-এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ‘আমি আপনাকে এক নবী থেকে অন্য নবীর ঔরসে স্থানান্তর করেছি এমনকি শেষ পর্যন্ত নবী হিসেবে বের করেছি’, ভিন্ন বর্ণনায় এসেছে আমি আপনাকে নবীদের পৃষ্ঠদেশে স্থানান্তর করেছি এবং শেষ পর্যন্ত আপনাকে আপনার আম্মাজান জন্ম দিয়েছেন। [মু’জামুল কবীর লিত তবারাণী-হাদিস: নং ১২০২১, মু’জামে ইবনুল আ’রাবী-হাদিস: নং-১৭০৫, মাজামউয যাওয়ায়েদণ্ডহাদিস: নং ১১২৪৭- এবং হাদিসটি সহিহ] এভাবেই বাবা আদম থেকে প্রত্যেক নবীর যুগেই আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নূর মুবারক কোন না কোন নবীর কিংবা সময়ের সবচেয়ে মুত্তাকী ব্যক্তির পৃষ্ঠদেশে ছিল। হিজরী তৃতীয় শতকের জগত বিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা আবদুল মালেক খারকুশী সংকলিত ‘শরফুল মুস্তাফা’ কিতাবের প্রথম অধ্যায় পর্যালোচনা করে জানা যায়, আদম (আঃ) থেকে শুরু করে নবী ঈসা (আঃ) পর্যন্ত প্রত্যেক নবীর যুগেই যখনই কোন বড় বিপদণ্ডআপদ আসতো আল্লাহ তায়ালা নূরে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বরকতে তাদেরকে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করতেন। কাল পরিক্রমায় আল্লাহর হাবিব সরকারে দোআ’লম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আগমনের সময় ঘনিয়ে এল। নবীজীর পূর্বপুরুষদের মধ্যে যাদের ঔরসে নূরে মুহাম্মদী গচ্ছিত ছিল তাদের থেকেও নানা আলামত প্রকাশ হওয়া শুরু করলো। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পূর্ব পুরুষদের মধ্যে একজন ছিলেন ‘আদনান’ নামে। তিনিই সর্বপ্রথম হারাম শরীফে বসতি স্থাপন করেন এবং সর্বপ্রথম তিনিই পবিত্র কা’বায় গেলাফ পরান। তার পরবর্তীজন হচ্ছেন ‘মাআ’দ’। তাঁর সারাজীবন কেটেছে জিহাদের ময়দানে এবং তিনি প্রত্যেক যুদ্ধেই বিজয় লাভ করতেন। আল্লাহ তায়ালা ঐ যুগের নবীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ‘মাআদকে সম্মানের সাথে নিজ বোরাকে আরোহন করিয়ে সিরিয়ায় নিয়ে যেতে। কেননা আমি তার বংশ থেকেই এক সম্মানিত নবী পয়দা করতে যাচ্ছি, যার মাধ্যমে পয়গম্বরের ধারাবাহিকতায় সমাপ্তি ঘটবে।’ বলা বাহুল্য এসবই নূরে মুহাম্মদীর সম্মানে। তার পরবর্তীজন হলেন ‘নিযার’। এটি নযর শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ বিরল। তিনি নিজ যুগে একজন বিরল ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন তাঁর ললাটে নূরে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চমকাচ্ছিল। সে যুগে জ্ঞানে গুণে বুদ্ধিমত্তায় তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিলেন না। পরবর্তীজন হলেন ‘মুযার’। অত্যন্ত জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান ছিলেন। নূরে মুহাম্মদীর বরকতে তিনি দেখতে এত আকর্ষণীয় ছিলেন যে, যে কেউ দেখলেই তাঁকে মহব্বত ও সম্মান করত। তিনি সুকণ্ঠের অধিকারীও ছিলেন। তার পরে ‘ইলয়াস’। তিনিই প্রথম বাইতুল্লাহ হতে পশু প্রেরণের প্রচলন করেন। বর্ণিত আছে ইলয়াস বিন মুযার স্বীয় পৃষ্ঠদেশ হতে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হজ্জের তালবিয়া শ্রবণ করতেন। এভাবে হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বুযুর্গ দাদা পর্যন্ত প্রত্যেকেই ঈমানদার এবং যুগের শ্রেষ্ঠ মানুষ ছিলেন। হুজুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দাদা আবদুল মুত্তালিব ছিলেন মক্কার সবচেয়ে সম্মানিত ও প্রভাবশালী মানুষ। নূরে মুহাম্মদীর ঝলকে তাঁর চেহারা এত উজ্জ্বল ছিল যে, অন্ধকার রাত্রেও তিনি কোথাও আগমন করলে আঁধার দূরীভূত হয়ে যেত। [শরহুয যুরক্বানী আলাল মাওয়াহিব-১/১৩৫, ১৩৬ ও ১৩৭, রওজুল উনফ-১/৮]

নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সম্মানিত আব্বাজান হযরত আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন আবদুল মুত্তালিবের কনিষ্ঠ এবং সবচেয়ে প্রিয় পুত্র। বর্ণিত আছে যেদিন তিনি জন্মগ্রহণ করেন সেদিন সম্পর্কে সিরিয়ার খৃষ্টান ও ইহুদী পণ্ডিতরা জানতে পারে। তাদের কাছে নবী ইয়াহইয়া আলাইহিস সালামের রক্তমাখা একটি জুব্বাহ ছিল। তাদের আসমানী কিতাবে লিখিত ছিল যখন দেখবে এই জুব্বার রক্ত তাজা হয়ে উঠেছে এবং টপটপ করে রক্ত ঝরছে তখন বুঝে নিও আখেরী যামানার পয়গম্বরের পিতা দুনিয়ায় আগমন করেছেন। ঠিকই যেদিন আবদুল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন সেদিন ঐ জুব্বা থেকে টপটপ করে রক্ত ঝরতে থাকে। তারা দলবলে মক্কায় এসে হুজুরের আব্বাজানকে খোঁজ করে তার ক্ষতি করার চেষ্টা করলে আল্লাহ কুদরতীভাবে তাঁকে রক্ষা করেন। তারা ব্যর্থ হয়ে সিরিয়ায় ফিরে যায়। সিরিয়ায় পৌঁছানোর পর ওখানকার লোকেরা জিজ্ঞাসা করলে তারা বলতে থাকল আমরা মক্কার কুরাইশদের মাঝে ঝলমল করা একটা নূর রেখে এসেছি। হুজুরে পুর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আব্বা একদিন পিতা আবদুল মুত্তালিবকে বলেন ‘আমি মক্কার উপকণ্ঠে জাবালে ছুবাইরে উঠলে দেখলাম আমার পৃষ্ঠ হতে দুটি নূর বের হল। একটি পূর্ব দিগন্তে অন্যটি পশ্চিম দিগন্তে মিলিত হল। তারপর দেখলাম নূর দুটি বৃত্তাকার ঘুরছে এমনকি মেঘের আকৃতি ধারণ করল। এরপর আকাশ বিদীর্ণ হয়ে গেলে মুহূর্তের মধ্যে দেখলাম নূর দুটি আকাশাভ্যন্তরে প্রবেশ করে আবার আমার কাছে ফিরে আসল। আমি যেখানেই বসি আমি শুনতে পাই কেউ আমাকে সালাম দিচ্ছে হে নূরে মুহাম্মদীর রক্ষক আপনায় সালাম। যে কোনো শুকনো জায়গায় বসলে সেটা মুহূর্তেই সবুজ-শ্যামলে রূপান্তর হয়ে যায়। আবদুল মুত্তালিব বললেন, সুসংবাদ গ্রহণ করো হে আমার পুত্র! তোমার নছল থেকেই আল্লাহ জগতের সবচেয়ে সম্মানিত সত্তাকে বের করবেন। [তারিখুল খামীছ-১/১৮২]

পরিণত বয়সে আবদুল্লাহকে বিবাহ দেয়ার জন্যে পিতা আবদুল মুত্তালিব রওয়ানা হলে পথিমধ্যে ফাতেমা বিনতে মুররাহ নামে এক ইহুদি মহিলার সাথে সাক্ষাৎ হয়। সে তাওরাত, ইঞ্জিল ইত্যাদিতে অভিজ্ঞ ছিল। খাজা আবদুল্লাহর চেহারায় নূরে মুহাম্মদীর অপরূপ ঝলক দেখে সে নিজেকে তার কাছে পেশ করলো এবং প্রস্তাব দিলো আমি তোমাকে একশত উট উপহার দেবো তুমি আমাকে বিয়ে করো। কিন্তু আবদুল্লাহ চারিত্রিক মাধুর্যতা ও পিতার সম্মানের কথা খেয়াল করে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। অবশেষে বনী যোহরা গোত্রের ওহাব বিন আবদে মানাফের অতুলনীয় কন্যা জগতের সবচেয়ে ভাগ্যবান রমণী আম্মাজান আমেনা (রাদিঃ)-এর সাথে তাঁর বিবাহ হয়ে যায়। [দালাইলুন নবুওয়্যাহ-আবূ নুআইম ইস্ফাহানী-১/৩৮] বিবি আমেনার সাথে পরিণয়ের পরদিন হযরত আবদুল্লাহ নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তনকালে ফের ঐ মহিলার সাথে সাক্ষাৎ হয়। এবার মহিলা আবদুল্লাহকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে জবাব দিল- ‘গতকাল তোমার মাঝে যে নূর ছিল- আজ সে নূর তোমার থেকে বিদায় নিয়েছে। সুতরাং তোমাতে আমার কোনো প্রয়োজন নাই।’ [শরহুয যুরকানী- ১/১৯৩] এখানেও একজন ইহুদি মহিলা আল্লাহর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নূর হিসেবে অভিহিত করলেন।

মা আমেনা আল্লাহর হাবিবকে গর্ভে ধারণ করার দুই মাস পরেই হযরত আবদুল্লাহ (রাদিঃ) ইন্তেকাল করেন। যে রাতে হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নূর মুবারক আম্মাজানের রেহেমে পাকে স্থানান্তর হয়, সে রাতে আল্লাহ জান্নাতের রক্ষক ‘খাজেন’কে হুকুম দিয়েছিলেন জান্নাতের সকল দরজা খুলে দিতে। আকাশের ফেরেশতারা আনন্দে মেতে উঠেছিল। আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন ঘোষক ঘোষণা করলেন- ‘সাবধান! তোমরা জেনে রাখ, আজকের রাত্রেই ঐ গচ্ছিত নূর যা থেকে হেদায়েত দানকারী শেষ নবী আবির্ভূত হবেন তা তাঁর আম্মাজানের রেহেমে স্থানান্তর হচ্ছে।’ [তারিখুল খামিছ-১/১৮৫] নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়ার পর পেয়ারা নবী নিখিল বিশ্বের পরম প্রেমাষ্পদ হাবিবে কিবরিয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শুভাগমনের সময় এসে গেল। অবশেষে ৫৭০ খৃ. সহিহ ও প্রসিদ্ধ বর্ণনা মতে ১২ই রবিউল আউয়াল নূর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ধরায় আগমন করেন। [সিরাতে নববী-ইবনে কাছির-১/১৯৯]

হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আগমন মুহূর্তে যে সকল অলৌকিক ঘটনাবলী সংঘটিত হলো তার মধ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু হলো-

* হযরত মা আমেনা (রাদিঃ) বলেন, তাঁর জন্মলগ্নের পর মুহূর্তেই একটা নূর প্রকাশিত হলো যার আলোতে পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের সব কিছু আলোকিত হয়। যেই আলোতে সুদূর সিরিয়ার রাজপ্রাসাদ সমূহ আমি দেখতে পাই। [তারিখুল কবীর-ইমাম বুখারী-১/৩৯, মুসনাদে আহমদণ্ড৪/১২৭]

* ফাতিমা বিন সুলাইমান বর্ণনা করেন, প্রিয় নবীর বেলাদতের সময় আমি দেখলাম বায়তুল্লাহ নূরের জ্যোতিতে আলোকময় হয়ে উঠলো এবং তারকারাজী যমীনের এত নিকটবর্তী হয়ে এলো যে মনে হচ্ছিল এগুলো আমার উপর এসে পড়বে। [ফাতহুল বারী-৬/৪২৬]

* পারস্য স¤্রাঁ কিসরার রাজ প্রাসাদের ১৪টি গম্বুজ ধসে পড়ে। [বায়হাকী-১২৬ পৃ.]

* ইরানের অনির্বাণ শিখা যা এক হাজার বছর পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্যও নিভেনি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিলাদতের মুহূর্তে তা দপ করে নিভে যায়। [বায়হাকী-১২৬ পৃ.]

* বিখ্যাত তবরীয়া হ্রদ শুকিয়ে গেল। [মাওয়াহেব]

* প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মাতৃগর্ভ থেকে দুনিয়াতে আগমনের পদ্ধতিও ছিল অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আল ইত্তেহাফ বিহুব্বিল আশরাফ কিতাবে বলা হয়েছে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামসহ সমস্ত নবী-রাসূল অন্যান্য বনী আদমের মতো মায়ের লজ্জাস্থান দিয়ে ভূমিষ্ঠ হন নি, বরং মায়ের নাভি ও লজ্জাস্থানের মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিবি আমেনা রাদিয়াল্লাহু আনহার নাভির বাম উরুদেশ দিয়ে (যা বাম পাঁজরের হাড়ের নি¤েœ অবস্থিত) ধূলির ধরায় কদম রাখেন। [উমদাতুন নুকূল ফি কাইফিয়্যাতে বিলাদাতির রাসূল]

* হযরত ইবনে আব্বাস (রাদিঃ) বর্ণনা করেন- রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খতনা করা অবস্থায়ই দুনিয়ায় তাশরীফ আনেন। [নেহায়াতুল আরব-১/৭৭]

* আল্লাহর হাবীব দুনিয়ায় আগমনের সময় কোনো প্রকার অপবিত্র বস্তু তাঁর শরীরে ছিল না। পূত পবিত্র অবস্থায় দুনিয়ায় এসেছেন। [নেহায়াতুল আরব-১/৭৬]

* হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সম্মানে ঐ বছর সকল মা পুত্র সন্তান প্রসব করেন। [মাওয়াহেব-১/৭৬]

* হুজুরের শুভাগমনের সময় আম্মাজানের খেদমতে আল্লাহ তায়ালা জান্নাত থেকে বিবি আছিয়া এবং মরিয়ম আলাইহিমাস সালামকে পাঠান। [মাওয়াহেব-১/৭৬]

* হুজুরের আগমন মুহূর্তে পবিত্র কা’বাঘর আনন্দে সিজদায় পতিত হয়। [নেহায়াতুল আরব-১/৭৮]

* আম্মাজান আমিনা (রাদিঃ) বলেন- আমি দেখলাম শিশু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্মের পর একটি প্রবল রশ্মি সম্পন্ন নূরের মেঘ এগিয়ে আসলো এবং একজন ঘোষণা করলো তাঁকে আকাশ ও যমীন পরিভ্রমণ করিয়ে নিয়ে এসো যাতে প্রত্যেকেই তাঁর পরিচয় লাভ করতে পারে। (ফেরেশতারা তাঁকে নিয়ে পরিভ্রমণ করে) ফিরে আসার পর যখন আবার আমার শিয়রে রাখলো আমি দেখলাম আমার নয়নের টুকরাকে যেন পূর্ণিমার চাঁদের মত দেখা যায়। আর তাঁর থেকে মেশক আম্বরের তীব্র সুঘ্রাণ ছড়াচ্ছিল। [মাওয়াহেব-১/৭৭]

* নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুভাগমনের পরই স্পষ্ট কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন- ‘আশহাদু আল্ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্নি রাসূলুল্লাহ’। [তারিখুল খামিছ-১/২০৩]

সত্যিই তিনি তুলনার ঊর্ধ্বে নূরের মহান সত্তা। সকলকে তাঁর শুভাগমনের এই মাসে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নূরানী শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ জ্ঞাপন করছি। তাঁর কদম মোবারকের ফয়েজ দ্বারা ধন্য হোক আমাদের দুনিয়া-আখেরাতের জিন্দেগী। আমিন! বিহুরমাতি সায়্যিদিল মুরসালীন।

লেখক : প্রভাষক, ধানুয়া ছালেহিয়া ফাযিল মাদ্রাসা।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়