শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।
  •   রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করলেন না সমাজী।

প্রকাশ : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০

মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ ও রবীন্দ্রবীক্ষায় মানুষের ধর্ম

সৌম্য সালেক

মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ ও রবীন্দ্রবীক্ষায় মানুষের ধর্ম
অনলাইন ডেস্ক

মানুষের চূড়ান্ত অভিলক্ষ্য আত্মপ্রতিষ্ঠা। আত্মিক আবাহনে কিংবা জৈব পরম্পরায় সে তার অবস্থানকে অক্ষুণ্ন রাখতে উদ্গ্রীব। নিজের অবস্থান সংক্রান্ত জানানের ব্যগ্রতা এবং অস্তিত্ব রক্ষার অন্তরীণ আহ্বান তাকে নিরন্তর নাড়া দিয়ে যায়, তাই সে চেতনে অবচেতনে কর্মে ও মননে সেই গোপন অভিলক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয় না। রবীন্দ্রনাথ মানুষের এই নিত্য প্রবণতার দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘মানুষের একটা দিক আছে সেখানে বিষয়বুদ্ধি নিয়ে সে আপন সিদ্ধি খোঁজে। সেইখানে ব্যক্তিগত জীবন-যাত্রা নির্বাহে তার জ্ঞান, তার কর্ম, তার রচনাশক্তি একান্ত ব্যাপৃত। সেখানে সে জীবরূপে বাঁচতে চায়’। মার্কিন মনোবিজ্ঞানী আব্রাহাম মাসলো, ‘চাহিদা সোপন তত্ত্ব’ নামে মানুষের আকাঙ্ক্ষার পাঁচটি ধাপ নির্ণয় করেন, সেগুলো হলো : জৈবিক চাহিদা, নিরাপত্তার চাহিদা, সামাজিক প্রতিপত্তি ও ভালোবাসার চাহিদা, আত্মতৃপ্তির চাহিদা এবং আত্মপ্রতিষ্ঠার চাহিদা। মাসলোও তাঁর তত্ত্বে মানুষের চূড়ান্ত চাহিদা বা অভিলক্ষ্য হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠাকে নির্বাচন করেন। যদিও মাসলোর তত্ত্বে বস্তু ও বাণিজ্যের স্থান রয়েছে, যেখানে এক ধরনের সচেতনতা দৃশ্যমান। মাসলোর মত অনুযায়ী একটি চাহিদা পূর্ণ হওয়ার প্রেক্ষিতে মানুষ পরবর্তী চাহিদা পূরণের দিকে ধাবিত হয় অর্থাৎ স্পষ্টত এটি একটি সচেতন প্রক্রিয়া। কিন্তু আমাদের আলোচনা মানুষের চিরন্তন ধর্ম ও প্রবণতার প্রতি সেখানে মানুষ চেতনে-অবচেতনে অভিলক্ষ্যের অনুগামী। যেখানে মানুষ সীমা ও সম্ভাব্যতা মোতাবেক নিজের প্রতিষ্ঠাকে দৃঢ়তা দিতে চায়। সেই আত্মপ্রতিষ্ঠাই মানুষের হৃদয়ের একান্ত প্রবণতা। বস্তু কিংবা ভাব যে বিবেচনাতেই হোক মাসলো তাঁর তত্ত্বে আত্মপ্রতিষ্ঠাকে শীর্ষে তুলেছেন বলে, এই আলোচনায় তাঁর তত্ত্বের গুরুত্ব রয়েছে।

মানুষ তার আত্মিক অবস্থানকে অক্ষুণ্ন রাখতে কালে কালে প্রতিষ্ঠা করে যাচ্ছে নানা কীর্তি ও স্থাপনা, আবিষ্কার-উদ্ভাবনসহ সৃজনশীল রচনার মাধ্যমে সে নিজকে জানান দিতে চায়। জীবন শেষ হবার আগেই সে সন্তানের ব্যাপারে মনোযোগী হয়ে উঠে। শত কষ্ট সহ্য করেও সে চায় সন্তান বড় মানুষ হয়ে উঠুক। মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর ভাষায়, ‘সন্তান যে তাহার নিজেরই নব সংস্করণ’। আত্মিক প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মানুষ সন্তানের মধ্য দিয়ে এভাবে জীবনের প্রতি তার আকাঙ্ক্ষাকে পূর্ণ করতে চায়। এজন্য দেখা যায়, নিজের অপূর্ণতাগুলোর বাস্তবায়নে মানুষকে সন্তানের দিকে তাকিয়ে থাকতে; এতেও যেনো তার তৃপ্তি। কিন্তু মানুষের এই চাওয়ার কিছু নেতিবাচকতা আছে। কেননা প্রতিটা শিশুই নিজস্ব কিছু চিন্তা, আকাঙ্ক্ষা ও লক্ষ্য নিয়ে বেড়ে ওঠে। এক্ষেত্রে কাহলিল জিবরানের ‘দি প্রফেট’ গ্রন্থে লেখা ‘শিশুদের বিষয়ে’ অনুচ্ছেদ থেকে নেয়া নিম্নোক্ত পাঠ স্মর্তব্য : ‘তোমাদের শিশুরা তোমাদের শিশু নয়। নিজের জন্য জীবনের যে ব্যাকুলতা তারই পুত্রকন্যা ওরা। ওরা তোমাদের মধ্য দিয়ে আসে কিন্তু তোমাদের কাছ থেকে নয়। আর তারা তোমাদের সাথে থাকলেও তোমরা তাদের মালিক নও। তোমরা তাদেরকে ভালোবাসা দিতে পারো কিন্তু তোমাদের চিন্তাভাবনা নয়, কারণ তাদের নিজেদের চিন্তাভাবনা রয়েছে’। নিজেদের চিন্তাভাবনাকে পূর্ণতাদানের জন্য সন্তানের ওপর জোর করে কোনো বিষয় চাপিয়ে দিলে সাময়িক সান্ত¡না হয়ত পাওয়া সম্ভব কিন্তু সন্তানের জন্য সেটা সফলতা বয়ে আনতে পারবে না। সন্তানের ওপর চরমপন্থা আরোপ করে তৃপ্তি লাভের প্রচেষ্টা আত্মপূর্ণতার উত্তম পথ হতে পারে না। প্রতিজন মানুষেরই নিজস্ব চিন্তা এবং কামনার লক্ষ্যবস্তু রয়েছে, তবে চূড়ান্ত অর্থে তা হয়তবা আত্মপূর্ণতার দুর্গম পথে নিজেই চালিত। আত্মপ্রতিষ্ঠার এই ধর্ম যে কেবল ব্যক্তি মানুষের প্রবণতা তা কিন্তু নয় বরং বস্তুবিশ্বের সমগ্র বিষয়, অনুষঙ্গের মধ্যেই গভীর প্রচ্ছন্নতায় নিজের সংহত অবস্থানের প্রতি এই দৃঢ় ঐক্য দেখা যায়। এখানে প্রসঙ্গত মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর ‘অনন্ত তৃষা’ থেকে সামান্য পাঠ তুলে দিচ্ছি, ‘সামান্য লোষ্ট্র খণ্ড যেখানে বসিয়া আছে সেখানে তুমি বসিতে পারিবে না। যতই কেন ক্ষুদ্র হউক না, সে যেখানে আপন অধিকার সাব্যস্ত করিয়া লইয়াছে সেখান হইতে সে সহজে নড়িবে না। তাহাকে সরাইতে চেষ্টা কর সে প্রতিরোধ করিবে। তুমি তাকে পদাঘাত কর, সেও প্রতিঘাত করিবে, তোমার পায়ে বেদনা দিবে। তুমি ইহাকে প্রতিক্রিয়া (Newton's lwa of Reaction) বলিয়া মনে কর’। এ রকমভাবে জগতের সকল প্রাণী ও বস্তুসমূহের মধ্যে আত্মপ্রতিষ্ঠার এক অন্তরীণ কামনা অবচেতনভাবেই সক্রিয় রয়েছে। মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ তাঁর ‘মানুষের ধর্ম্ম’ গ্রন্থে অনন্ত তৃষা, আদিম প্রেরণা, চৈতন্যবাদ, জড়বাদ, ধ্রুব কোথায়, জীবন ও নীতি, পরমাণু জগৎ ও প্রাণশক্তির উন্মেষ, বস্তুরূপ ও বস্তু, জীবন প্রবাহ, বিজ্ঞান যুগে ধর্ম ও সভ্যতা এবং পারমার্থিক জগৎ ও জীবন বিষয়ক নানা দার্শনিক ডিসকোর্সের মাধ্যমে আত্মপ্রতিষ্ঠা, অন্তরীণ শক্তি ও ধ্রুব সন্ধানের পথে তাঁর যুক্তি ও অভিজ্ঞার বিবৃতি দিয়েছেন। ‘The Religion of Man' শীর্ষনাম করে অক্সফোর্ডসহ বিভিন্ন স্থানে দেয়া কয়েকটি বক্তৃতার সংকলন রবীন্দ্রনাথের-মানুষের ধর্ম; যেখানে ‘মানবসত্য’ শিরোনামে ডিসকোর্সগুলোর একটি ভূমিকা রচনাও অন্তর্ভুক্ত আছে। রবীন্দ্রনাথ মানবসত্য তথা মানবতার সার্বিক কল্যাণকে উপলক্ষ করে, এক সামষ্টিক-কল্যাণ মন্ত্রের প্রতি দৃষ্টিপাত করেছেন, সেখানে মানুষের পূর্ণতার সত্যগুলো নিহিত। তিনি বলেছেন, ‘যা আমাদের ত্যাগের দিকে তপস্যার দিকে নিয়ে যায় তাকেই বলি মনুষ্যত্ব, মানুষের ধর্ম।’ মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ ‘মানুষের ধর্ম্ম’ গ্রন্থে মানুষের চূড়ান্ত প্রবণতার কথা বলেছেন আর রবীন্দ্রনাথ মানবতামুখী উচিত কর্মনিষ্ঠাকে মানুষের ধর্মরূপে চিহ্নিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের মানুষের ধর্মে তাই উন্নত ও মানবতামুখী নির্দিষ্ট মানুষের সমাবেশ আর মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ যে ধর্মের কথা বলেছেন সেটা মানব সমাজের একটি অন্তরীণ প্রবণতা, যাতে সচেতন কিংবা অবচেতনের আলাদা কোন ভেদ নেই। এখানে দেখা যায়, একটি ধারার মধ্যে ইতিবাচকতা বা নেতিবাচকতায় পার্থক্য নেই আর অন্য ধারা লক্ষ্যস্থিত উন্নত ও সভ্য মানুষের উচিত সমবায়। একজন ব্যক্তির মধ্যেই এই দুই ধর্ম অর্থাৎ মানবসত্য ও আত্মপ্রতিষ্ঠা একই সাথে সক্রিয় থাকতে পারে, কেননা কল্যাণকর্মও আত্মপ্রতিষ্ঠার বড় আলোকিত দিক।

দুই.

রবীন্দ্রনাথের মানবসত্যকামী-এসব ধর্ম চিন্তার প্রধান আশ্রয়স্থল বেদ, উপনিষদ, লোক বিশ্বাস এবং অভিজ্ঞতা। মানুষ আছে তার দুই ভাবকে নিয়ে একটা তার জীবভাব আর একটা বিশ্বভাব। ‘পাদোহস্য বিশ্বা ভূতানি ত্রিপাদস্ব্যামৃতং দিবি’। - ঋগ্বেদ থেকে এই শে¬াক উচ্চারণ করে তিনি বলছেন, ‘যে দিকে সে বিচ্ছিন্ন নয়, যে দিকে তার পূর্ণতা, যে দিকে ব্যক্তিগত সীমাকে সে ছাড়িয়ে চলেছে, সে দিকে বিশ্বমানব’। একান্ত ব্যক্তিক কামনার বাইরে এসে দ্বার খুলে বিশ্বভূমির দিকে ফিরে বিশ্বমানবের প্রতি প্রসারিত হতে তিনি ইঙ্গিত করেছেন, যেখানে বিশ্বসমষ্টিকে একটি এককে বিবেচনার মাধ্যমে কল্যাণ প্রচেষ্টার দিকে কবির দৃষ্টি। ব্যক্তিগত প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির দ্বন্দ্বে মানুষ যখন নানা ভ্রান্তির মধ্যে পড়ে ন্যায় কর্ম থেকে দূরে সরে যায়, খ্যাতি ও ভোগের আয়োজন থেকে যখন বেরিয়ে আসে বিপন্ন মানুষ, সেই বিক্ষিপ্ত বিবাদ ও কান্নার পটভূমি ছেড়ে কবি মন তখন চলে যায় নিষ্কাম, নির্বিরোধ, পথিক ভিখারির আপনভোলা গানে-

‘আমি কোথায় পাব তারে

আমার মনের মানুষ যে রে

হারায় সেই মানুষে তার উদ্দেশ্যে

দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে’।

আলাদা আলাদা মানুষ এবং একটি মানবসঙ্গের সমষ্টির অবিচ্ছিন্নতাকে প্রকাশ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ একটি চমৎকার উদাহরণ দিয়েছেন-‘দশ টাকার (একটা) নোট পাওয়া গেল, বিশেষ রাজত্বে তার বিশেষ মূল্য, একে দেখবা মাত্র যে জানে যে, এই কাগজখানা স্বতন্ত্র দশ সংখ্যক টাকার সংঘরূপ, তা হলেই সে একে ঠিক জানে। কাগজখানা ঐ সংঘের প্রতীক’। একে ভেঙে যেমন ভিন্ন ভিন্ন মান দেয়া যাবে, আবার একত্রেও এই টাকার স্বতন্ত্র ক্রয় সামর্থ্য রয়েছে। এই তত্ত্বের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ সমগ্রের একক-অস্তিত্ব ও সক্ষমতাকে জানানের প্রয়াস চালিয়েছেন। প্রসঙ্গত, তিনি মানুষের সত্তার পরিচয় জ্ঞাপক দুটি অনুষঙ্গ-অহং এবং আত্মা সম্পর্কে বলেছেন- ‘প্রদীপের সঙ্গে একটিকে তুলনা করা যায় আর একটিকে শিখার সঙ্গে’। প্রদীপের প্রকরণের মধ্যে নানা ভেদ রয়েছে, সোনার প্রদীপ, মাটির প্রদীপ। আর শিখা কেবল নিজকেই প্রকাশ করে না বরং অন্য সবকিছুকেই প্রকাশ করে। প্রদীপের সীমা ছাড়িয়ে সে প্রবেশ করে নিখিলের মধ্যে। উপনিষদণ্ডআত্মা সম্পর্কে বলছেন, ‘তমেবৈকং জানথ আত্মানম’- সেই আত্মাকে জানো সেই এককে, যাকে সকল আত্মার মধ্যে এক করে জানলে সত্যকে জানা হয়। এখানে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য হচ্ছে, ‘আত্মার লক্ষণকে যে জানে সেই মুনি, সেই শ্রেষ্ঠ। আত্মার লক্ষণ হচ্ছে শুভবুদ্ধি; যে শুভবুদ্ধিতে সকলকে এক করে’। আজ বিশ্বব্যাপী অমানবতার খেলা চলছে। যে পতিত অবহেলিত তার সম্পদ হরণ থেকে তাকে হত্যা পর্যন্ত বিরুদ্ধবাদীর বুক একটু কাঁপছে না। মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুদ্ধের স্বাভাবিক নিয়ম ভেঙে নিরস্ত্র অসহায় মানুষের ওপর বোমা ফেলতে বা তাদের হত্যা করতে গিয়ে সামান্য কৃপা প্রদর্শন করা হচ্ছে না। এসব যুদ্ধ তো আসলে প্রভুত্ব প্রদর্শনের অন্যায্য হস্তক্ষেপ ছাড়া কিছুই না। তবু যুদ্ধেরও শৃঙ্খলা আছে, আর সেই শৃঙ্খলা ভাঙা বড় অধর্ম, কেননা সেখানেই মানুষের বাঁচা-মরার শর্ত সর্বাধিক নিকটবর্তী। যুদ্ধের নীতি সম্পর্কে এখানে রবীন্দ্রনাথের উপস্থাপনাটি পেশ করছি, ‘যুদ্ধকালে যে মানুষ রথে নেই, যে আছে ভূতলে, রথী তাকে মারবে না। যে ক্লীব, যে কৃতাঞ্জলি, যে মুক্তকেশ, যে আসীন, যে সানুনয়ে বলে ‘আমি তোদেরই’ তাকেও মারবে না। যে ঘুমাচ্ছে, যে বর্মহীন, যে নগ্ন, যে নিরস্ত্র, যে অযুধ্যমান, যে যুদ্ধ দেখছে মাত্র, যে অন্যের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত, তাকেও মারবে না। যার অস্ত্র গেছে ভেঙ্গে, যে শোকার্ত, যে পরীক্ষিত, যে ভীত, যে পরাবৃত্ত, সত্যের ধর্ম অনুসরণ করে তাকেও মারবে না। সত্যের ধর্ম বলতে বোঝায় মানুষের মধ্যে যে সত্য তাঁরই ধর্ম, মানুষের মধ্যে যে মহৎ তাঁরই ধর্ম। যুদ্ধ করতে গিয়ে মানুষ যদি তাঁকে অস্বীকার করে তবে ছোট দিকে তার জিত হলেও বড়ো দিকে তার হার। উপকরণের দিকে তার সিদ্ধি, অমৃতের দিকে যে বঞ্চিত’। ক্ষমা ও মহানুভবতার বিবৃতি দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘শক্রকে নিধনের পরিমাণ আছে, শক্রকে ক্ষমার পরিমাণ নেই’। এই শৃঙ্খলার অবনতিতে পতিত আজ মানবসমাজ, তাই হাজার বছরের ঐতিহ্যের নানা সৌকর্যসমূহ আজ ভেঙে ধূলায় পড়ে আছে। এই অবনতি কেবল নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বা দেশের নয়, বরং বিশ্ববাসীর-বিশ্বজনের।

রবীন্দ্রনাথ মানুষের ধর্ম সংক্রান্ত তৃতীয় বক্তৃতায় সোহ্হমতত্ত্ব সম্পর্কে কথা বলেছেন, সোহ্হম মানুষের সামষ্টিক কল্যাণের ধারণা। সোহ্হম সমস্ত মানুষের সম্মিলিত অভিব্যক্তির মন্ত্র, একজনের নয়। ব্যক্তিগত শক্তিতে নিজে কেউ যতটুকু মুক্ত হচ্ছে সেই মুক্তি তার নিরর্থক যতক্ষণ না সে তা সকলকে দিতে পারে। আর যাঁরা মহাত্মা তাঁরা বিশ্বকর্মা। মানবসত্য সংক্রান্ত আলোচনায় তিনি বলেছেন, মানুষের জন্মভূমি তিনটি। বাসস্থান, স্মৃতিলোক এবং আত্মিকলোক। এই আত্মিকলোককে বলা যায় সর্বমানবচিত্তের মহাদেশ। এই ব্যাপক চিত্ত ব্যক্তিগত নয়, বিশ্বগত। তিনি বারবার ভূমা তথা পরমাত্মার কথা বলতে চেয়েছেন, তবে সেটা মানবলোক ত্যাগ করে বৈরাগ্য সাধনের পথে নয়। ‘মানুষকে বিলুপ্ত করে যদি মানুষের মুক্তি, তবে মানুষ হলুম কেন?’- তিনি মানুষের মাঝে থেকে সার্বিক কল্যাণকামিতার মাধ্যমে ভূমাকে উপলব্ধির কথা বেশি বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিক সুখের চেয়ে কল্যাণকামী আনন্দ উদ্যাপনের কথা বলেছেন। আমরা তাঁর গীতবাক্যে পাই, ‘আমি যখন ছিলেম অন্ধ, সুখের খেলায় বেলা গেছে পাইনি তো আনন্দ’। এই একান্ত সুখের খেলা সম্পর্কে কবি পূর্বজনমের স্মৃতি স্মরণ করেছেন, কিন্তু যে আনন্দ সন্ধান তিনি পৃথিবীতে মানুষের মাঝে আয়োজনে উদ্যাপনে পেয়েছেন, তাকেই মহার্ঘ্য বলতে চান। সুখ একান্ত ব্যক্তির আর আনন্দ সার্বিক উদ্যাপনের। ‘আনন্দ মাঝারে সব উঠিতেছে ভেসে ভেসে/আনন্দে হতেছে কভু লীন/চাহিয়া ধরণী-পানে নব আনন্দের গানে/মনে পড়ে আর-এক দিন’। মানবসত্য প্রতিষ্ঠার ধর্মকে পরম অভিলক্ষ্য করে তিনি শেষে বলেছেন ‘মানবনাট্যমঞ্চের মাঝখানে যে লীলা তার অংশের অংশ আমি। সব জড়িয়ে দেখলুম সকলকে। এই যে দেখা একে ছোট বলব না। এ-ও সত্য। জীবনদেবতার সঙ্গে জীবনকে পৃথক করে দেখলেই দুঃখ, মিলিয়ে দেখলেই মুক্তি’। এই মিলিয়ে দেখার সাধনাই মানুষের উচিত ধর্ম। এই মিলাতে যাবার পথে যা বাধা আছে তাকে অপসারণে প্রবৃত্ত হবার কালে, দুঃখই পরম পাবার আকাঙ্ক্ষাকে প্রশস্ত করবে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পাঠ, স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে যে চৈতন্য লাভ করেছেন, সেই আলোক প্রজ্ঞান থেকেই প্রশান্ত মনে এমন জিজ্ঞাসা রাখেন,

‘ওগো অন্তরতম

মিটেছে কি তব সকল তিয়াষ

আসি অন্তরে মম’।

তিন.

মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ আত্মপ্রতিষ্ঠাকে জীবজগতের চূড়ান্ত অভিলক্ষ্যরূপে দেখাতে চেয়েছেন। জীব সকলের এমনকি বস্তুসমষ্টির মধ্যেও এক আদিম-প্রেরণা সেই আকাঙ্ক্ষাকে পূর্ণ করতে সক্রিয় রয়েছে। তিনি দেখাতে চান, একটি কচি উদ্ভিদ দেহ কিসের প্রেরণায় তার নিজের চেয়ে সহস্রগুণ মাটি ছেদে অঙ্কুরিত হয়ে নিজেকে প্রদর্শন করে। ‘জীব শুধু বাঁচিয়া থাকতেই সন্তুষ্ট নহে, সে যুগ যুগান্তরের ভিতর দিয়া আপনাকে প্রসারিত করিতে চাহে’।- এই আদিম উদগ্র কামনাই মানুষকে সৃষ্টিশীলতার দিকে, প্রতিষ্ঠার দিকে চেতনে অবচেতনে তাড়া দিয়ে যায়। বরকতুল্লাহ বলতে চান, এই আকাঙ্ক্ষা এতই প্রসারিত যে, মৃত্যুর হানাকে মানুষ মানতে বাধ্য হলেও, সে কখনোই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার চির সমাপ্তি ঘটাতে চায় না। এখানে ব্যাপক যুক্তি উত্থাপন করে তিনি বলেছেন, তাহলে জগতে যে ভালো, যে সহ্যশীল, যে ক্ষমাশীল, যে ন্যায়ের পথে খুন হয়েছে তার কি কোনই প্রাপ্তি রবে না। মৃত্যুই যদি চির সমাপ্তি হয়, তাহলে যে দুর্দান্ত, যে কৃতজ্ঞ, যে হত্যাকারী ছিল, যে জঘন্য দুষ্কৃতির মাধ্যমে লোকের শান্তি ভঙ্গ করেছে তার কি কোন শাস্তি নেই? সব কিছু কি মৃত্যু মীমাংসা করতে পারে?- এসব মানুষ মেনে নিতে চায় না, পারে না। আর মানুষের এসব অন্তরীণ অভিঘাত যথার্থরূপে ধ্বনিত হয়েছে প্রত্যাদিষ্ট ধর্মসমূহে, যা শুনে মানুষ তৃপ্তি পায়। বরকতুল্লাহ মানুষের চিরকালীন আসক্তির এসব গূঢ় কথাই দারুণভাবে তুলে ধরেছেন।

মানুষ স্বর্গের দেশে বিরাট অভ্রভেদী প্রাসাদ গড়িয়াছে, প্রাসাদের ধারে উদ্যোগ, অদূরে স্নিগ্ধধারা প্রবাহিনী, সাহচর্যের জন্য লক্ষ লক্ষ চির নারী, সেবার জন্য চির বালক দল। যুগে যুগে স্থান কাল ভেদে স্বর্গের চিত্র বদলেছে; সভ্যতার পরিবর্তনের সাথে সাথে স্বর্গের রূপও ভিন্নতর হয়েছে। গ্রীকগণের স্বর্গচিত্র ছিল, ‘এক মহাপ্রান্তর, সেখানে অনন্ত বসন্তের হাওয়া বিরাজিত-অনন্ত কিরণধারা কোমলভাবে প্রবাহিত’। হিন্দুস্থান নদীমাতৃক ও কুসুম সুরভিত। তাই ঋষিযুগের হিন্দুগণের স্বর্গে, ‘মন্দাকিনী কলনাদে প্রবাহিত, বিবিধ কুসুম ধারে ধারে প্রস্ফুটিত, অব্যাহত শান্তিতে গোলকধাম শীতলিত। শ¬থবৃন্ত রাশি রাশি কুসুম ভূপতিত হইয়া কোমল তৃণশয্যার উপর অপূর্ব কুসুমাস্তরণ সৃষ্টি করিয়াছে। অযুত অপ্সরা গীতকাকলী মুখরিত মঞ্জুবীথিকায় অপূর্ব নর্ত্তনে ক্রীড়া করিতেছে’। স্বর্গের সংবাদ নিয়ে যখন ঈশা (আঃ) অবতীর্ণ হন, তখন জগতে রাজশক্তির প্রবল প্রভাব। শিল্পকলা ও সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত। তাই এ স্বর্গ একটি আদর্শ রাজ্য : ‘স্বর্গরাজ্যের চতুরসীমা অভেদ্য প্রাচীরে বেষ্টিত, মাঝে তার শান্তিময় জনপদ। ফেরেশতাগণ বিশ্বপিতার চতুষ্পার্শে অপূর্ব তানলয় সহকারে স্তুতিগান গাহিতেছে, স্তরে স্তরে কুসুমরাশি ফুটিয়া আছে। কুসুমাস্তরণের মধ্য দিয়া কলনাদে অমৃতের নদী প্রবাহিত হইতেছে’। ইসলাম যে স্বর্গের চিত্র নিয়ে আসে তার মধ্যে আরবীয় আকাঙ্ক্ষার প্রতিকৃতি দেখা যায়। ‘আরবের মরুদেশে স্নিগ্ধসলিল প্রস্রবণ সুমধুর ফলোদ্যান ও ছায়াবর্ষী খর্জুর বৃক্ষের ন্যায় আনন্দদায়ক আর কিছুই নাই। যে স্বর্গে এ সকলের অভাব আছে, আরববাসীর চক্ষে সে স্বর্গ যে নিতান্ত অসর্ম্পূণ তাহাতে সন্দেহ নেই’। পুণ্যবানদের জন্য যেমন স্বর্গরূপ তেমনি পাপীদের নরকের চিত্রও যুগে যুগে মানুষের ধর্ম ও কল্পনার আয়তনে বদলে গেছে। যতই মানুষ জটিল থেকে জটিলতর ও অধিক ভয়াবহ শাস্তির কল্পনা ধারণা করতে সক্ষম হয়েছে, ততই তাদের নরকের চিত্র আরও ভীষণ থেকে ভীষণতর রূপ ধারণ করেছে।

মানুষ তার নিজের যাপনকে অর্থবহ করতে স্বর্গ-নরকসহ আরো অগণ্য ভাবনা কল্পনায় স্বার্থক জীবনের স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকে। সে উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে যে, তার নিজের অন্তরই সকল অভিব্যক্তির আধার। এখানে বরকতুল্লাহর অভিমত, ‘তপস্যা বা আরাধনার পথে আবহমান কাল মানুষ নিজের অন্তরের সেই অন্তরতম মহাশক্তির স্বরূপ উপলব্ধি করিতে প্রয়াসী, তাই মানবের নিকট নির্জন আরাধনা ধর্ম্ম, প্রকাশ্য উপসনাও ধর্ম্ম’। বরকতুল্ল¬াহ তাঁর দ্বিতীয় আলোচনা ‘আদিম প্রেরণা’-তে এক অমোঘ অন্তরীণ প্রেরণাকে মানুষের নিভৃত চেতনার উৎসাহকরূপে চিহ্নিত করেছেন। সত্য ও পরিশুদ্ধরূপে নিজকে তুলে ধরতে সেই প্রেরণা মানব মনকে তাড়া দিয়ে যায়, সে আহ্বান বা নির্দেশ কেউ শুনতে পায়, কেউ পায় না। সেই প্রেরণা যে কেবল মানুষের মনে সক্রিয় তা নয় বরং জীব-জড় প্রত্যেক বস্তুর মধ্যেই আদিম শক্তিরূপে তার সংহত অবস্থান। সেই চেতনা ক্ষুদ্র অণু পর্যন্ত বিস্তৃত, এমনকি পরমাণুর বিচ্যুতি ঠেকাতেও ক্রিয়াশীল। বস্তুবিশ্বের শৃঙ্খলা, স্থিতি ও কার্যকরণে সেই প্রেরণার অবস্থান অত্যন্ত নিপুণ ও অনন্য। সেই প্রেরণার রূপ বিচিত্র, বিভিন্ন পাত্রে, মর্মে ও চেতনায় সেই জগৎরূপ কালাতীত সৌন্দর্যে কবির দৃষ্টি আকর্ষণ করে : ‘আঁ খোদাওন্দী কে দর আরেজে ওজুদ/হর জমাঁ খোদরা ব নকশে ওয়া নমুদ’- ফরিদউদ্দিন আক্তার। ‘অর্থাৎ তুমি সেই সর্বাধিরাজ যিনি এই দৃশ্যমান জগৎরূপ দর্পণে নিজেকে প্রতি যুগে নব নব রূপে প্রতিফলিত করিতেছে’। প্রতিষ্ঠার আকর্ষণের সাথে মানুষের সত্যরূপ পরিগ্রহপূর্বক এক অনিন্দ্য অধিগমনের কথা লেখক এভাবে তুলে আনেন : ‘পানির ধর্ম্ম যেমন নিষিক্ত করা, অগ্নির ধর্ম্ম যেমন দাহন করা, মানুষের ধর্ম্ম তেমনি আপনার সত্যকার রূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়া, সসীমের গ-ী পার হইয়া অসীমের সহিত একাকার হওয়া। সে-ই মানুষের যথার্থ স্বরূপ’। মানুষ তার একান্ত অবকাশে নিজের সত্যকে উদ্ভাবনে চেষ্টাশীল হবে, সেই সত্য যেমন বস্তুজগতের মধ্যে প্রকাশিত তেমনি ব্যক্তির অন্তরাত্মার মধ্যেও সে বিভূতি অবিশ্রাম খেলা করে, প্রয়োজন কেবল সন্ধানের সংযত অভিনিবেশ। সকল প্রত্যাদিষ্ট ধর্মের মধ্যেই এই একান্ত অভিনিবেশ সম্পর্কে জোর দেয়া হয়েছে, যাতে মানুষ তার নিজের ঐশ্বর্য, নিজের অভিলক্ষ্য ও প্রকৃতি সম্পর্কে অনবহিত থেকে না যায়। বরকতুল্ল¬াহ তাঁর রচনাগুচ্ছে আলোচনার বিভিন্ন সূত্রে এনেছেন- অগাস্ট কোঁৎ, স্টুয়ার্ট মিল, হার্বাট স্পেন্সার, হেগেল, ইবনে খালদুন, রুমি, হাফিজ, উপনিষদ ও ষড়দর্শন, গ্রীক দর্শন, পিথাগোরাস, ইলিয়াটিক মত, এনাক্সাগোরাস, ডিমোক্রিটাস, পে¬টোর অতীন্দ্রিয় জগৎ, অধিচৈতন্য, জড়বাদ, একত্ব ও বহুত্ব, পরমাণু জগৎ এবং আধুনিক বিজ্ঞানসহ নানা চিন্তার নির্যাস। তবু চিন্তা ও মত প্রক্ষেপণে বরকতুল্ল¬াহ বিজ্ঞান ও যুক্তির চেয়ে অধিক ভাবনিষ্ঠ। প্রেরণাশক্তির আওতায় তিনি মরমীদের অলৌকিক নানা ক্রিয়ালাপকেও স্থান দিয়েছেন।

‘মানুষের ধর্ম্ম’ (১৯৩৪) গ্রন্থে দর্শনের নানা জটিল বিষয়ানুষঙ্গকে তিনি যে প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপন করেছেন এমন দৃষ্টান্ত বিরল। দর্শনচর্চায় আর যেসব বাঙালির কৃতিত্ব চোখে পড়ে তাঁরা হলেন- দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, রামমোহন রায়, শিবনারায়ণ রায়, গোবিন্দ চন্দ্র দেব, রামতনু লাহিড়ি, বিবেকানন্দ ও কেশবচন্দ্র। মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ এঁদেরই একজন। আর বাঙালি মুসলিম লেখকদের কথা বলতে গেলে তিনি কেবল পূর্বসূরিই নন, অনন্যও বটে। বরকতুল্ল¬াহ দুটি দিক বিবেচনায় মার্কসীয় মতবাদ গ্রহণ করেননি। প্রথমত এ মতবাদে ঈশ্বর বা ধর্মবিশ্বাসের স্থান নেই। তিনি মনে করেন, ধর্মবিশ্বাস ছাড়া জীবনে নানা বিড়ম্বনার সৃষ্টি হয়। ধর্ম মানুষের অন্তরের পিপাসার জন্য শেষ শান্তি-বারি। ধর্মহীন মানুষ বিপন্নতা, নৈরাজ্য এবং বিষাদে আক্রান্ত হয়, কারণ বস্তু ভিন্ন তাদের কোনো অন্তরীণ আশ্রয়স্থল নেই। দ্বিতীয়ত তাঁর ধারণা, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার না থাকলে ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছা লুপ্ত হয়ে যায়। তাঁর প্রশ্ন, প্রতিটি মানুষ যেখানে ‘রাষ্ট্রের মজুর’ সেখানে স্নেহ-মায়া-প্রীতি-মহত্ব ইত্যাদি মানবিক গুণাবলি বিকাশের সুযোগ কোথায়?

চৈতন্যের সর্বময়তা, আত্মপ্রতিষ্ঠা এবং আদিম প্রেরণা শক্তি সম্পর্কে ব্যাখ্যা ও যুক্তি প্রকাশপূর্বক মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ তাঁর দর্শনে, এক বিশ্বময়-চেতনার অস্তিত্বের উপর গুরুত্ব তুলে ধরেন। সর্বোপরি তিনি বলতে চান, মানুষের অন্তরগঠনে বিজ্ঞানের সীমবদ্ধতা রয়েছে। চিন্তা, ধর্ম ও নৈতিকতা মানুষের মূল্যবোধ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে। এজন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত বিকাশের পাশাপাশি তিনি ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেন। মানুষ স্বর্গীয় সত্তার প্রতিরূপ হওয়ার জন্য নিজের আসল প্রকৃতি অর্জন করা ছাড়া কিছুই না; আর সেই সত্যকার রূপে প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাই মানুষের অভিলক্ষ্য। এই সত্য প্রকৃতি অর্জনের লক্ষ্যই- মানুষের ধর্ম। স্বরূপ ও প্রকৃতি সন্ধানের এমন ভেতর-বাহিরকার একান্ত অভিনিবেশই মানুষকে তার অভিলক্ষ্যের দিকে নিয়ে যায়, এখানেই মনে করি মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর মানুষের ধর্ম চিন্তার সারাৎসার নিহিত।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়