প্রকাশ : ২১ জুন ২০২১, ১১:২৫
কালোত্তীর্ণ মহাকাল : দার্শনিক সমগ্রতায় বঙ্গবন্ধু ও উদ্ভাসিত বাংলাদেশ
‘স্বভূমি থেকে যে আঞ্চলিক ভাষা ঠোঁটস্থ করেছি/বলে রাখি, আমার গর্ব এখানেই এবং আমি আবৃত্তি করি আঞ্চলিক শব্দমালা; হোক তোমার অচেনা।’
উত্তর আয়ারল্যান্ডের অধিবাসী ১৯৯৫-এ সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী কবি সিমাস হিনি’র ‘অচেনা’ কবিতার (দাউদ হায়দার অনুদিত) কয়েকটি লাইন। ‘ডেথ অব ন্যাচারালিস্ট’ কাব্যগ্রন্থে অচেনা কবিতাটি স্থান পেয়েছে। কাব্য ও স্বদেশ জুড়ে যাদের সামান্যতম বিচরণ তাদের কাছে এ নামটি হয়তো কোনো প্রহেলিকার সৃষ্টি করবে না।
১৯৪৭-এর স্বাধীনতায় ভারত ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হয়। ইসলাম ধর্মের কারণে একীভূত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান। অথচ হাজার মাইলের ব্যবধানে বিচ্ছিন্ন এবং ভাষার দিক থেকেও আলাদা। এমনকি হরফেও ভিন্ন পশ্চিম পাকিস্তানের কথ্যরীতি। এ যেনো কেবল খ্রিস্টান ধর্মের দোহাই দিয়ে গ্রিস ও ব্রিটেনকে একদেশে পরিণত করা।
ইতিহাস কোনো ব্যক্তি বিশেষের কল্পনা বিলাসের অভিব্যক্তি নয়। ইতিহাস অগ্রসর হয় তথ্যের হাত ধরে। তথ্যের সাহায্যে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে বলেই ইতিহাস একটি বিজ্ঞান। তথ্য বিশ্লেষণে একে অন্যের থেকে ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন, বিশ্লেষণ পদ্ধতি ভিন্নতর হতে পারে, কিন্তু ইতিহাসে নিজস্ব মনগড়া কথা বলার কোনো অবকাশ নেই।
যা ঘটে তার বিবরণ, তার তথ্যনিষ্ঠ ও কালানুক্রমিক বর্ণনা এবং তার যুক্তিনিষ্ঠ ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণই ইতিহাস।
ইতিহাসের মূল লক্ষ্য একটি সমাজ ও জাতি। কোনো সমাজ বা জাতিতে এমন একজন ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে, যার কর্মশক্তি সে সমাজ বা জাতিকে এক নতুন মাহাত্ম্যে অভিষিক্ত করে, নতুনভাবে আলোড়িত করে একটি দেশ, সমাজ বা জাতিকে নবজন্ম দান করে।
বাঙালির প্রবহমান ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় অধ্যায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। স্বভাষার মর্যাদায় আন্দোলিত নান্দনিক ও শৈল্পিক অবয়বে গড়া একটি নিপুণ মানচিত্রে উদ্ভাসিত দেশ বাংলাদেশ। এদেশের দার্শনিক সমগ্রতা হাজার বছরের পুরানো।
শতাব্দীর মহানায়ক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর কালোত্তীর্ণ সমগ্রতায় পুঞ্জীভূত শক্তির প্রতীক।
প্রিয় মাতৃভূমিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার অভিপ্রায়ে ১৯৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
মুক্তিপাগল বাঙালি স্বদেশী ঐতিহ্য নিয়ে জীবন-মৃত্যুর সাথে একাকার হয়ে গেলো। এরপর ’৭১-এর ২৫ মার্চ পৃথিবীর ইতিহাসে এক নৃশংসতম কালো রাত্রি। রাত সাড়ে ১১টায় শুরু হয় ‘অপারেশন সার্চ লাইট’। জঘন্যতম গণহত্যা।
নিরপরাধ ঘুমন্ত জাতিকে নির্মূল করার ঘৃণিত হত্যা থেকে রেহাই পায়নি বাঙালি মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য সম্প্রদায়। পরিকল্পিত হত্যা ও ধ্বঃসযজ্ঞের পাশাপাশি শুরু করে গণধর্ষণ, লুট, অপহরণ, অগ্নিসংযোগ ও বন্দী নির্যাতন। মানুষ ছুটছে। নিরুদ্দেশ পথচলা। এ পথের যেনো শেষ নেই। গরুর গাড়িতে চেপে ছেঁড়া ছাতা মাথায় দিয়ে চলেছে বৃদ্ধা। আরেক বৃদ্ধাকে সাহায্যে এগিয়ে এসেছে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ। আশ্রয়হীন সহায়-সম্বলহীন সংসারহীন মানুষ। এ যেনো পথের মধ্যেই দুঃখের সংসার ছড়িয়ে দিয়ে জীবনটাকে বাঁচিয়ে রাখা। একরত্তি মেয়েটি একমুঠো ভাতের জন্যে তাকিয়ে আছে উনুনে চাপানো হাঁড়ির দিকে। আর সব হারানো জীবনের মর্মান্তিক এ মুহূর্তটুকুর নীরব সাক্ষী হয়ে পাশে শুয়ে রয়েছে পথের কুকুরটি।
আহার ও আশ্রয়ের সন্ধানে মানুষ শরণার্থী শিবিরগুলোতে ঠাঁই নিয়েছে। জন¯্রােত যেনো জল¯্রােতে পরিণত হয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা মেঘালয়ে ভরে গেলো শিবিরে শিবিরে। শুধু ক্যাম্প আর ক্যাম্প।
শরণার্থীদের গুরুভার বহন করতে বিশ^ সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানান সিনেটের এডোয়ার্ড কেনেডি। তাঁর ভাষায়, ‘এসব ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত মানুষকে তাদেরই সহ-শরণার্থীরা সীমান্তের ওপার থেকে বয়ে এনেছে। তারপরও বহুসংখ্যক লোকের বাড়ি-ঘর পাকিস্তানী সেনাদের গোলার শিকার হয়েছে। এছাড়া অকথিত সংখ্যক আহত মানুষ, যাদের গোনা হয়নি যাদের দেখা-শোনার কেউ নেই, পূর্ব বাংলার গ্রামীণ এলাকায় পড়ে আছে। সমস্যার যে আকৃতি তা’ কল্পনাকেও থমকে দেয় এবং পূর্ব বাংলা থেকে যারা পালিয়ে এসেছে, তাদের কাহিনী হৃদয়কে বিদীর্ণ করে। আজও ট্রাজিক অভিজ্ঞতা হচ্ছে নিষ্পাপ ও অশিক্ষিত গ্রামবাসীর। তারা নৃশংসতার কথা বলেছে, মানুষ জবাই করার কথা বলেছে, লুট ও অগ্নিকা-ের কথা বলেছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে হয়রানি ও লাঞ্ছিত হওয়ার কথা বলেছে। বহু শিশু রাস্তায় মারা যাচ্ছে। তাদের মা-বাবা তাদের বাঁচাতে অনুনয় জানাচ্ছে, ভিক্ষা চাচ্ছে। পূর্ব বাংলার ট্রাজেডি সমগ্র বিশ^ সম্প্রদায়ের জন্যে ট্রাজেডি। এ সঙ্কট নিরসনে বিশ^সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে।’
একইভাবে মাদার তেরেসা ও সানডে টাইমস্-এর বিখ্যাত সাংবাদিক নিকোলাস টোমালিন এবং প্রখ্যাত ফটোজার্নালিস্ট রোমানো ক্যানিওনি বিশ^সম্প্রদায়কে বাংলার বীভৎস ও নারকীয় পরিস্থিতির সহযোগিতায় এগিয়ে আসার উদাত্ত আহ্বান জানান।
নিষ্ঠুর এ বর্বরতার শুদ্ধ জবাব আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে অবশেষে স্বাধীনতার কাক্সিক্ষত লাল সূর্য উদিত হলো বাংলার আকাশে। কিন্তু মুক্তির অপূর্ণতা রয়ে যায়, স্বাধীনতার স্থপতি তখন নির্জন কারাগারে।
১৯৭২-এর ৮ জানুয়ারি। বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে মুক্তি পান। পিআইয়ের একটি বিশেষ বিমানে বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনে পাঠানো হয়। লন্ডনে তাঁর হোটেলের সামনে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি ঘোষণা করেন, ‘আমি আমার জনগণের মাঝে ফিরে যেতে চাই।’ ১০ জানুয়ারি সকালে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের আগ্রহে ব্রিটেনের রাজকীয় বিমান বাহিনীর এক বিশেষ বিমানে বঙ্গবন্ধু নয়াদিল্লী পৌঁছালে রাষ্ট্রপতি ভি.ভি. গিরি এবং প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘অশুভের বিরুদ্ধে শুভের জয় হয়েছে।’ ওইদিন বিকেলে ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করেন। লাখো মানুষের জন¯্রােতে বাঁধভাঙ্গা আবেগে অশ্রুসিক্ত জাতির পিতা বলেন, ‘আজ আমার জীবনের স্বাদ পূর্ণ হয়েছে।’
বাঙালি জাতির নবজাগরণের শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাসের নবসংস্কৃতি ও মানবতাবাদী জীবনদর্শনের রূপকার বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত এদেশের সোনার বাংলাকে সোনাছড়া রোদ্দুর দিয়ে জড়াতে চেয়েছেন।
১৯৮৪ সালে আগামী প্রকাশনী থেকে বিখ্যাত শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর প্রচ্ছদ পরিকল্পনায় বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছার পবিত্র স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, বাংলা একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক মযহারুল ইসলাম রচিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ গ্রন্থের ধারা বর্ণনার আলোকিত অধ্যায় উন্মোচনের প্রাক কথন।
শিক্ষাবিদ মযহারুল ইসলাম যখন দিল্লীতে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর সোস্যাল সায়েন্স রিচার্স সেন্টারে উপাচার্যের মর্যাদায় সিনিয়র ফেলো হিসেবে কর্মরত (১৯৮৪-৮৭) তখন বাংলা একাডেমী থেকে তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ গ্রন্থটি পরিমার্জন করে মুদ্রণের জন্য পা-ুলিপি একাডেমীতে জমা দেবার অনুরোধ জানানো হয়।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, যদিও গ্রন্থটির পরিমার্জিত পা-ুলিপি বাংলা একাডেমীতে জমা দেয়া হয়, কিন্তু নানা অজুহাতে একাডেমী গড়িমসি করতে থাকে। বাধ্য হয়ে শিক্ষাবিদ মযহারুল ইসলাম একাডেমী থেকে পা-ুলিপি ফেরৎ নিয়ে আসেন। ইতিহাসের বর্বরোচিত, নির্মম ও নৃশংস হত্যাকা- ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হবার পর কোনো এক অজ্ঞাত কারণে একাডেমীতে যত মুদ্রিত কপি ছিল যার পরিমাণ ছয়-সাত হাজারের কম হবে না, সমস্ত কপি পুড়িয়ে ফেলা হয় অথবা ধ্বংস করা হয়। বিষয়টি পরবর্তীকালে পরীক্ষা করে দেখার জন্য একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠনের দাবি জানানো হয়েছিল। সে দাবিটি কোনো গুরুত্বই পায়নি। ফলে একাডেমীর এতবড় একটি অন্যায় কর্ম বিচারের আড়ালেই সমাপ্ত হয়।
১৯৭৫-এর পর ইতিহাস বিকৃতির পালা শুরু হয়ে যায়। একটি জাতির জন্য তার পরিণাম যেমন অশুভ তেমনি অগৌরবের। বিকৃত ইতিহাস নিয়ে কখনো কোনো জাতি বড় হতে পারে না। ফলে এদেশে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিগুলো প্রবলভাবে মাথা তুলে দাঁড়াবার সুযোগ পেয়ে যায়।
২০০৯ থেকে ২০১৪ এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের শিলালিপিতে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিগুলোর একত্রিত প্রয়াসে মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে জাতি আজ গ্লানি থেকে মুক্তি পেয়েছে।
এবার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ গ্রন্থের শরীরে প্রবেশের পালা-(রাত্রিঃ রক্তঃ সূর্যঃ সম্ভাবনা; পৃষ্ঠা ঃ ৩৩ ও ৩৪)।
হতাশার দীর্ঘশ^াস ছড়িয়ে, রাত্রি এলো। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সূর্য ক্রন্দনের হাহাকারে আকাশ রাঙিয়ে পশ্চিমাকাশে অস্তমিত হল। রক্ত¯œাত ২৫ মার্চের রাত্রির মাধ্যমেই বাঙালির হাজার বছরের মুক্তি-স্বপ্ন বাস্তব রূপ ধারণ করেছে, জন্ম নিয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
পশ্চিমাকাশের গায়ে লাল লাল রক্তের চিহ্ন দেখতে দেখতেই স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মযহারুল ইসলাম সোবহানবাগ থেকে পদব্রজে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িতে এসে দাঁড়ালেন। ঘরে প্রবেশ করে দেখলেন সবাই ম্লান, সবার মুখেই হতাশার সুস্পষ্ট চিহ্ন। একমাত্র বঙ্গবন্ধুই মুখে সেনাপতির সুদৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে সবার সাথে আলাপ করছেন-একসঙ্গে তিন-চারজনকে নিয়ে ঘরের কোণায় বা পর্দার অন্তরালে চলে যাচ্ছেন এবং চুপি চুপি নির্দেশ দিচ্ছেন-
‘এক্ষণি চলে যাও, ঢাকা ছেড়ে নিজের এলাকায় চলে যাও-তারপর গড়ে তোল প্রতিরোধ-বাংলার মাটিকে স্বাধীন করতে সর্বশক্তি নিয়োগ কর।’
সময় গড়িয়ে চলেছে। একে একে সবাই চলে গেলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান। রাত তখন প্রায় ৯টা। তখনো ঘরে ছিলেন ফরিদপুরের ওবায়দুর রহমান, যশোরের কামরুজ্জামান, ময়মনসিংহের আবদুল মোমেন, খন্দকার মহম্মদ ইলিয়াস প্রমুখ। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ওবায়দুর রহমান, কামরুজ্জামান চলে গেলেন, কিছুক্ষণ পর ইলিয়াছ ভাইও বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমি (মযহারুল ইসলাম) তখন ঘরে একা। বঙ্গবন্ধু পাশে এসে বসলেন। রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা। ইতিমধ্যে বাংলা ও ইরেজিতে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটির মুসাবিদা সম্পন্ন হয়েছে। যেখানে ছিলেন- তাজউদ্দিন আহমদ, জেনারেল ওসমানী, তাঁদের সঙ্গে ছিলাম আমি। বঙ্গবন্ধু ডিকটেশন দিলেন, কলম ছিলো জেনারেল ওসমানীর হাতে। আমি সবিনয়ে বঙ্গবন্ধুর মুখের দিকে চেয়ে বললাম, ‘সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে সংগ্রামের নির্দেশ দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছেন’Ñ
বঙ্গবন্ধু কথা শেষ করতে দিলেন না। জাতির পিতা একটু মৃদু হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, সবাইকে পাঠিয়ে দিলাম, এবার আপনার পালা। এক্ষণি চলে যান-আজ রাতেই রাস্তা পার হতে না পারলে আর পারবেন না-রাজশাহী, পাবনা, সমগ্র উত্তর বাংলায় প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলুন; সংগ্রাম করুন, দেশকে জানোয়ারদের হাত থেকে মুক্ত করুন।’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি যাচ্ছি কিন্তু আপনাকে এমন নিশ্চিত বিপদের সামনে রেখে আমরা সবাই চলে যাব?’
বঙ্গবন্ধু আবেগে হাত চেপে ধরলেন। বললেন, ‘আমার জন্য ভাবতে হবে না বন্ধু! আপনি তো জানেন জীবনে কোনদিন কোনরকম পরিস্থিতি থেকে আমি পলায়ন করিনি।’
আমি বাধা দিয়ে বললাম, ‘এ তো পলায়ন নয়, আত্মরক্ষা। আর আত্মরক্ষাও নয়Ñআপনি আমাদের প্রধান নির্দেশদাতা-আপনার নির্দেশে অসহযোগ আন্দোলন সফল হয়েছে-এবার শুরু হবে সংগ্রাম।’
বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘সে সংগ্রামের নির্দেশ আমি দিয়েছি’।
‘আমি না থাকলেও আমার নির্দেশ থাকবে, সংগ্রাম চলবে, আর সে সংগ্রাম সফল হবে। এ আমার দৃঢ় বিশ^াস’।
-কিন্তু আপনাকে তো আমরা হারাতে পারি না।
জাতির পিতা দৃঢ়কণ্ঠে বললেন- ‘আমি কি এতই স্বার্থপর যে সাড়ে সাত কোটি মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে আমি নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাব? তাদেরকে আগুনের মুখে রেখে আমি চলে যেতে পারি না, আমি তা পারি না।’
-আপনার জীবনের মূল্য অনেক বেশিÑবাঙালির কাছে তার মূল্য অপরিসীম।
-বঙ্গবন্ধু বললেন,‘না, তা নয়। সংগ্রাম শুরু হলে দেখবেন রণাঙ্গনে হাজার হাজার মুজিব তৈরি হয়ে গেছে। তাছাড়া আমি যদি এই বাড়ি থেকে সরে যাই তাহলে ওরা যে সমগ্র ঢাকাকে ভস্মে রূপান্তরিত করবে।’
-সে কথা হয়তো কিছু সত্য। কিন্তু আপনি বাইরে না থাকলে অন্যান্য রাষ্ট্র বিশেষ করে ভারত আমাদের সংগ্রামে সাহায্য করবে কেন-কেন আমাদের তারা অস্ত্র দেবেন, আশ্রয় দেবেন?
জাতির পিতা বললেন, ‘আপনারা আশ্রয় পাবেন, অস্ত্রও পাবেন। সে ব্যবস্থা আমি সম্পন্ন করে রেখেছি। কিন্তু আমি নিজে যদি চলে যাই, কাল দেশ স্বাধীন হলে পরে যখন বাংলার মাটিতে ফিরে আসব, আমার হাজার হাজার মা-বোন-ভাইয়েরা এসে যখন বলবে ‘মুজিব, তুমি তো নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে সংগ্রাম করে জীবন রক্ষা করেছো, কিন্তু আমার স্বামী, আমার পিতামাতা, আমার ভাই, আমার বোন, এদের তুমি কী আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলে? ফিরিয়ে দাও, তাদেরকে তুমি ফিরিয়ে দাও’-তখন আমি তাদের কী জবাব দেব বলুন? না না আমি পারি না। আমি যেতে পারি না। মরতে হয় মরবো। মৃত্যুকে তো কোনোদিন আমি ভয় করিনি। কিন্তু ও সঁংঃ ংযধৎব ঃযব ংঁভভবৎরহমং ড়ভ সু ঢ়বড়ঢ়ষব ধষড়হম রিঃয ঃযবস. ও সঁংঃ ংযধৎব. ও পধহহড়ঃ ষবধাব ঃযবস ড়হ ঃযব ভধপব ড়ভ ভরৎব. ও পধহ হড়ঃ. আমি পারি না’।
আবেগে বঙ্গবন্ধু শেষের কথাগুলো ইংরেজিতেই বললেন। এরপর কিছুক্ষণ সবাই নিরব। নীরবতা ভেঙ্গে বঙ্গবন্ধু এবার উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘আপনি তাহলে আসুন। যদি বেঁচে থাকি তবে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে আবার দেখা হবে।’
জাতির পিতার হাত ছুঁয়ে বিদায় নিলাম। দুচোখে উত্তপ্ত অশ্রু বয়ে যেতে লাগলো। মনে হল যদি চিৎকার করে কাঁদতে পারতাম।
ঘরের বাইরে এসে দেখি করিডোরে উদাস নেত্রে স্থির গভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বন্ধু আবদুল মোমেন। আমি তাঁকে বললাম, ‘বঙ্গবন্ধু কিছুতেই নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে রাজি নন। আমি ব্যর্থ হয়েছি, আপনি শেষ চেষ্টা করে দেখবেন।’
বন্ধু মোমেন আশ^াস দিলেন। আর বন্ধুবৎসল কণ্ঠেই আমাকে সাবধানে থাকতে বললেন। কিন্তু রাত চারটার দিকে জানতে পেলাম যে, কারো অনুরোধেই বঙ্গবন্ধু বাড়ি ছাড়েননি। আমি বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাছাকাছি সোবহানবাগে একটি ছোট টিনের ঘরে আত্মগোপন করে ছিলাম। রাত দেড়টার দিকে বর্বর বাহিনীর আঘাত রূপ নিল ভয়াল ধ্বংসযজ্ঞে। সমগ্র ঢাকা জ¦লছে। চারপাশে শুধু হাহাকার আর আর্তনাদ! কয়েকজন বুলেটাহত লোক রক্তাক্ত দেহে আমার আশ্রয়স্থলের সামনে দিয়ে চলে গেল। শেষরাতে একজন প্রৌঢ়া ঝি’র মুখে শুনলাম যে, বঙ্গবন্ধুকে রাত একটা-দেড়টার দিকে বর্বর পাক সেনারা নিয়ে গেছে। স্ত্রী লোকটি আশেপাশের কোনো বাড়িতে কাজ করত। বহুকষ্টে সে সেখান থেকে পালিয়েছেÑকিন্তু সে দূরে পালিয়ে থেকেই লক্ষ্য করেছে যে একটি মিলিটারী গাড়ি বঙ্গবন্ধুকে তুলে নিয়ে চলে গেল।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর তর্জনী প্রতিস্থাপনের দৃষ্টান্ত অনুসরণযোগ্য। তাঁর হৃদয়ের প্রবল অনুভূতি অনেক ভাগ্যবিড়ম্বিত ব্যক্তিকেও করুণায় আবর্তিত করেছে। বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব চেতনার প্রতিবিম্ব একটি জাতির ইতিহাসকে মুক্ত করেছে মূল্যবোধহীন সামন্ত প্রথার নাগপাশ থেকে। বাঙালি জাতির জাগ্রত চলমানতা বিশ^ পরিম-লে সামগ্রিক আলোড়ন তুলেছে বঙ্গবন্ধুর আপোষহীন ও সাহসী নেতৃত্বের কারণে। তাই বাঙালি জাতি তাঁর অহংবোধে জীবন ও অসাম্প্রদায়িক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা, সমাজনীতি ও কল্যাণ বৃত্তি ধারণ করে সত্য ও সুন্দরের এক প্রাণময় বাংলাদেশ গড়বে-এটাই প্রত্যাশা এবং শান্তি ও উন্নয়নের রূপকার বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরি দেশরতœ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নত বাংলাদেশ এর সফল বাস্তবায়নে আমাদের কাক্সিক্ষত হাত প্রসারিত করে আমরা ফিরে পাবো চিন্তা ও অনুভূতির সুন্দর সোপান, আমরা ফিরো পাবো অন্তর্শক্তি। সৃষ্টি হবে যোগ্য উত্তরাধিকার, গর্বিত হবে অতীত, প্রাণময় বর্তমান এবং আলোকিত ভবিষ্যৎ আর চির অমলিন থাকবে উপলব্ধির শিলালিপিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু।
তথ্য সূত্র কৃতজ্ঞতায়-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব : মযহারুল ইসলাম।
লেখক পরিচিতি : সভাপতি, বঙ্গবন্ধু লেখক পরিষদ, চাঁদপুর জেলা শাখা।