সাংবাদিকতা ও সম্পাদনায় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য ও কাব্যচর্চার পাশাপাশি পত্রিকায় সাংবাদিকতা ও সম্পাদনায় ছিলো তৎকালীন সময়ে তাঁর অসামান্য অবদান। তিনি হয়তো ভেবেছেন, তাঁর রচনাবলি ভারত তথা বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে জানাতে হবে এবং ব্রিটিশ শাসনভার থেকে উৎখাত করতে তাঁর লেখনি কাজ করবে।

তাই শুধু কবিতা কিংবা গানই নয়, সাংবাদিকতার মাধ্যমেও কাজী নজরুল ইসলাম বিপ্লবী ধারার সূচনা করেন। অত্যাচারী বিদেশী শাসক, দেশীয় তোষামোদকারী ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে শক্তিশালী ও শাণিত সম্পাদকীয় লিখে শাসকদের ভীত কাঁপিয়ে তোলেন তিনি।

মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতবর্ষে সে সময়ে যে অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে ইংরেজ শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে গণবিপ্লব হয়, তা শাণিত ও বেগবান করতে কাজী নজরুল ইসলাম লেখালেখি ছাড়াও ‘নবযুগ’ পত্রিকার মাধ্যমে সাংবাদিকতার জগতে আবির্ভূত হন। ১৯১৪-১৯১৯ প্রথম বিশ^যুদ্ধোত্তর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে গণজাগরণ সৃষ্টিসহ ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে-তা তিনি বুঝেছেন।

ফলে ইংরেজদের অন্যায় শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির মধ্যে গণজাগরণ সৃষ্টি এবং গণবিপ্লবে মদদ দেয়ার অভিযোগে অধিকাংশ পত্র-পত্রিকা তখন রাজরোষেরও শিকার হয়। কিছু কিছু পত্রিকার প্রকাশনাও বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপরও থেমে থাকেন নি কবি নজরুল। বাঙালির আর্থ-সামাজিক, মানবিক বিপর্যয়ে গভীরভাবে মর্মাহত কবি নজরুল তাঁর মনে বাঙালির পরাধীনতা থেকে মুক্তির বাণী অনুধাবন করেন।

তিনি শোষণের শৃঙ্খলভাঙার প্রত্যয়ে যেমন অগ্নিঝরা কবিতা লিখেছেন, তেমনি সাংবাদিকতার মাধ্যমে গণমানুষকে একত্র করতে সম্পাদকীয়ও লিখেছেন। রাশিয়ার বিপ্লব, তুরস্কের তরুণ তুর্কিদের অভিযান এবং আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রাম কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সাংবাদিকতায় অনুপ্রাণিত করে।

কবিতায় বিদ্রোহী ধারা সূচনার পর সাংবাদিকতার ইতিহাসেও তিনি দুঃসাহসিক, বিপ্লবী ধারার সংযোজন ঘটান। সমকালীন রাজনীতির মনোভাব আশ্রয় করে ভাষার হুল ফোটাতেন তিনি। সংবাদপত্রে তিনি সম্পাদনার কাজ না করলে তাঁর রচনাবলি যে অত্যাচার, শোষণ, শাসনের বিরুদ্ধে লেখা-তা তৎকালীন বাঙালী ও বাংলা ভাষাভাষী মানুষ জানতে পারত না। তাই তিনি সংবাদিকতা ও সংবাদপত্রগুলোতে বিভিন্ন ছদ্মনাম ব্যবহার করে কবিতা ও প্রবন্ধ লিখে পাঠাতেন। প্রকাশকগণও তা ছাপতেন।

১৯২০ সালের ১২ জুলাই শেরে-এ-বাংলা একে ফজলুল হক কৃষক প্রজা পার্টি গঠন করতে ও জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে ‘নবযুগ’ নামে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। প্রকাশক হিসেবে তাঁর নাম থাকলেও সম্পাদনা বা সম্পাদক ছিলেন বিদ্রোহী কবি নজরুল ও কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ। এ পত্রিকার মাধ্যমেই বিদ্রোহী কবি নজরুলের সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয়।

জানা যায়, হক সাহেবের বাড়ি ৬নং ট্রার্নার স্ট্রীটের বাড়ির নিচ তলায় পত্রিকার অফিস ছিলো। পত্রিকাটি প্রকাশের পর বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। কারণ এ পত্রিকাটিতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম যা লিখতেন তা ছিলো স্বাধীনতা-চেতনার উদ্দীপক। মাঝে মধ্যে ব্রিটিশ শাসকদের পক্ষ থেকে অনেক হুমকি-ধমকিসহ সাবধানতার চিঠি বা বার্তা পত্রিকা অফিসে আসত। ফলে এসব নানা কারণে হক সাহেবকে বলে ১৯২০ সালের ডিসেম্বর মাসে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ‘নবযুগ’ ছেড়ে দেন। যার ফলে জানুয়ারি মাসেই এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।

এরপর ১৯২২ সালে নজরুলের সম্পাদনায় প্রকাশ পায় ‘ধূমকেতু’। সাপ্তাহিক মানে সপ্তাহে ১ বার। কিন্তু এটি বের হতো সপ্তাহে দুবার। আর প্রথম সংখ্যাতেই প্রকাশিত হয় ‘ধূমকেতু’ কবিতাটি। ধূমকেতু পত্রিকার প্রকাশক ছিলেন আফজালুল হক, সম্পাদক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি সম্পাদকের পরিবর্তে সারথি শব্দটি ব্যবহার করতেন। পত্রিকার ব্যবস্থাপক ছিলেন শান্তিপদ সিংহ। সম্ভবত দৌলতপুর ও কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার এক বছরের কিছু সময় পরে কাজী নজরুল ইসলাম সাপ্তাহিক ধূমকেতু পত্রিকাটি বের করেন।

নজরুলের ক্ষুরধার লেখনির কারণে তখন পত্রিকাটি দ্রুত জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে যায়। সাহিত্য স¤্রাট কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে তিনি লিখেনও। কিছুদিন পর এর কার্যালয়টি কলেজ স্ট্রীট থেকে প্রতাপ সাহা লেনে স্থানান্তর হয়।

ধূমকেতুর মাধ্যমে নজরুলের সাংবাদিকতার প্রতিভার বিকাশ ঘটে। প্রবন্ধের পৃষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাণী লেখা ধূমকেতু পত্রিকাটি কেনার জন্যে মোড়ে মোড়ে তৎকালীন তরুণরা দাঁড়িয়ে থাকত। বিক্রির সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকলে গ্রাহকরা আগাম টাকা দিয়ে রাখত হকারকে। কারণ, ধূমকেতুর সাংবাদিক নীতি-আদর্শ ছিল অর্ধ-চেতনদের ঘা মেরে জাগিয়ে তোলা, অর্থাৎ এটি ছিল গণজাগরণমূলক। যার মূল উদ্দেশ্যটি ছিল ব্রিটিশ শাসনের অবসান।

নজরুল বিশ^াস করতেন, ব্রিটিশদের বিতাড়ন করা না গেলে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙা যাবে না। আর এর জন্যে প্রয়োজন গণজাগরণ সৃষ্টির মাধ্যমে সশস্ত্র বিপ্লবে অংশগ্রহণ। ধূমকেতু জাতির অচলায়তন মনকে জাগিয়ে তুলতে, বাঙালি সমাজকে বৈপ্লবিক চিন্তাধারায় উদ্দীপ্ত করতে সহায়ক হয়।

কবিতা, প্রবন্ধ ও হাস্যকৌতুক ইত্যাদির মধ্য দিয়ে একদিকে শাসক শ্রেণির অত্যাচার, অবিচার ও শোষণ এবং অপরদিকে হিন্দু-মুসলমান সমাজের জড়তা, দুর্নীতি ও ভ-ামির বিরুদ্ধেও কলম ধরেন নজরুল। সম্পাদকীয় প্রবন্ধ হিসেবে ধূমকেতুর প্রবন্ধগুলো অতিমাত্রায় কাব্য-গুণান্বিত ছিল। এগুলোতে বিচার-বিশ্লেষণের উপস্থিতি কম হলেও দেশের যৌবন-রক্তে এ সব দুঃসাহসী ও নির্ভীক প্রবন্ধ ছিলো আবেগ ও উদ্দীপনার অগ্নিঝরার মত। সংবাদের হেডিং প্রণয়নে মাঝে মাঝে রঙ্গ-ব্যঙ্গের ছোট ছোট কবিতা ও প্যারোডির ব্যবহারে সংবাদগুলো যেমন হতো উপভোগ্য, তেমন মর্মস্পর্শী।

১৯২৩ সালের ১২ আগস্ট মাসে শারদীয় সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি প্রকাশের জন্যে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় গ্রেপ্তারের আদেশ আসে। তৎকালীন হুগলি প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট মি. সুহাইন হো তাঁকে এক বছরের সশ্রম কারাদ- দেন।

১৯২২ সাল মোতাবেক ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ৯ আশি^নের সংখ্যায় নজরুলের ‘বিদ্রোহীর কৈফিয়ত’ কবিতা প্রকাশিত হয় ধূমকেতুতে। এতে ইংরেজ সরকারের দৃষ্টি আসার পর কবি নজরুল রাজরোষের শিকার হন। ১৯২৩ সালের মার্চ মাসে ধূমকেতু বন্ধ হয়ে যায়।

এরপর শ্রমিক, প্রজা, স্বরাজ সম্প্রদায় সংগঠনের মুখপত্র হিসেবে ‘সাপ্তাহিক লাঙ্গল’ প্রকাশিত হয় ১৯২৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ১৯২৬ সালের ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত ঐ পত্রিকাটি চলে আসছিলো। নজরুল এটির পরিচালক পদে ছিলেন। লাঙ্গলে কবি নজরুলের বেশ কিছু কবিতা প্রকাশ করার সুযোগ হয়।

জেলে বসেও তিনি রাজবন্দীদের সঙ্গে জেল কর্তৃপক্ষ দুর্ব্যবহার করেছে মর্মে কবিতা লিখে এর প্রতিবাদ জানান। জেলে বসে তিনি অনেক কবিতা ও গান রচনা করেন।

শিকল পরা ছল মোদের...। ফলে শেষ পর্যন্ত সকল জেলে বন্দীদের ঐক্যবদ্ধ করেন। জেল কর্তৃপক্ষ বুঝতে পেরে তখন তাকে অলিপুর জেল থেকে ১৯২৩ সালের ১৪ এপ্রিল হুগলী জেলে প্রেরণ করেন। হুগলী জেল থেকে কবি নজরুল কবি স¤্রাট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য খানা লিখে উৎসর্গ করেন।

হুগলী জেলে তিনি কারা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও অনশন শুরু করেন। অবশেষে তাঁর মা জাহেদা খাতুন চুরুলিয়া থেকে ও কুমিল্লা থেকে ধর্ম মা বিরজা সুন্দরী তাঁর অনশন ভাঙতে কলকাতা আসেন। ১৯২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর তিনি জেল থেকে মুক্তি পান। এখান থেকে কবি চলে আসেন কুমিল্লায়। এখানে আসার পর ১৯৩০ সালে ‘প্রলয় শিখা’ কবিতাটি লিখেন।

এ কাব্যগ্রন্থটির কারণে তিনি আবারও ব্রিটিশদের রোষানলে পতিত হন। এতে ১৯৩১ সালে কবিকে ৬ মাসের সশ্রম কারাদ- দেয়া হয়। কবি নজরুল হাইকোর্টে আপীল করলে এ সময় গান্ধী ‘আরউইন’ চুক্তির ফলে তিনি অব্যাহতি পান। এভাবে কবি সাংবাদিকতায় কবিতা আর গান লিখে ভারতের স্বাধীনতাপ্রাপ্তি তরান্বিত করতে সহায়তা করেন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি তৎকালীন একজন ভারতীয় হয়ে বৃটিশদের কাছে লিখনির মাধ্যমে স্বাধীনতা চান।

তাই ভারতের তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে কেবলমাত্র জেলে পুরেই ক্ষান্ত হয়নি, তাঁর কয়েকটি বইও বাজেয়াপ্ত করে। ১৯২২ সালে নজরুলের প্রথম গদ্যগ্রন্থ যুগবাণী রাজদ্রোহের অপরাধে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। এরপর ১৯২৪ সালে ‘বিষের বাঁশি’ এবং ১৯৩০ সালে ‘প্রলয় শিখা ’ কাব্যগ্রন্থটি একই অপরাধের জন্য বাজেয়াপ্ত করেন। এর জন্যেই তাঁকে পুনরায় ৬ মাসের কারাদ- দেয়া হয়। কিন্তু ‘গান্ধী আরউইন’ চুক্তির কারণে সে দ- থেকে তিনি অব্যাহতি পান।

কবির প্রকাশিত কবিতা ও গানের সংকলন ‘সর্বহারা’, প্রবন্ধ সংকলন ‘রুদ্রমঙ্গল’, নির্বাচিত কবিতা সংকলন ‘সঞ্চিতা’ ইত্যাদি গ্রন্থগুলোর ওপরও পুলিশের শ্যেনদৃষ্টি ছিলো। কবি কাজী নজরুলের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ নিষিদ্ধ হয়নি। তবে যখনই বইটি বাজারে আসত তখনই পুলিশ এগুলো জব্দ করে নিয়ে যেত।

তাঁর রচিত ‘সঞ্চিতা’র জন্য রাষ্ট্র বিভাগে নজরদারি ফাইল খোলা হলেও তা’ বাজায়েপ্ত করতে পারেনি। তবে ‘ফণিমনসা’ বাজেয়াপ্ত করার সুপারিশ করে পাবলিক প্রসিকিউটর ও তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার চিঠি লিখেছিলেন। এভাবেই কাজী নজরুলের লেখনির ওপর রোষানলের ছাপ পড়ে।

তথ্যসূত্র : মোঃ হাবিবুর রহমান রচিত ‘ছোটদের নজরুল’ নবারুণ ও বাংলাদেশ সচিত্র মাসিক প্রত্রিকা, শেখ মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম রচিত ‘নজরুল জীবনের ট্র্যাজেডি’, ডাঃ আনিস আহমেদের সম্পাদনায় ‘কাজী নজরুলের জীবনী’ এবং ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত ছবি)