শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।
  •   রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করলেন না সমাজী।

প্রকাশ : ১৯ জুন ২০২১, ২০:০১

অজানা অজন্তা

গাজী মুনছুর আজিজ
অজানা অজন্তা

দূর থেকে অজন্তার গুহাগুলোর দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি। এসব গুহা সম্পর্কে এর আগে অনেক গল্প পড়েছি বা শুনেছি। আহা, আজ সে গুহার সামনে নিজেকে দাঁড় করিয়ে ভালোই লাগছে। নিজেকেই মনে মনে বলি, অবশেষে আসতে পেরেছি। সঙ্গে আছেন বন্ধুবর মানিক।

ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র আওরঙ্গাবাদ শহর থেকে অজন্তার দূরত্ব প্রায় ১০১ কিলোমিটার। খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সাল থেকে সপ্তম খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নির্মিত এসব গুহা। মূলত বৌদ্ধ ভিক্ষুরা উপাসনার জন্যে নির্জন এ পাহাড়ে খোদাই করে গুহাগুলো তৈরি করেছেন। কেবল গুহা নয়, এসব গুহার ভেতর বৌদ্ধ ভিক্ষুরা নিপুণ হাতে পাথরের পাহাড় কেটে কেটে তৈরি করেছেন বুদ্ধের মূর্তিসহ নানা শিল্পকর্ম; শিল্পের ভাষায় যাকে ‘রিলিফ ওয়ার্ক’ বলে। এছাড়া গুহার ছাদ বা সিলিংয়েও অনেক শিল্পকর্ম আছে; যাকে শিল্পের ভাষায় ফ্রেসকো বলে। অবশ্য এসব ‘রিলিফ ওয়ার্ক’ আর ‘ফ্রেসকো’ অনেকটা ভাস্কর্যরীতিতে বা ভাস্কর্যের আদলে তৈরি। তাই সহজ ভাষায় আমরা এসব শিল্পকর্মকে ভাস্কর্যরীতির শিল্পকর্ম বলতে পারি। আর এসব ভাস্কর্যরীতির শিল্পকর্মের পাশাপাশি গুহাগুলোর দেয়ালে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা নানা রঙে তৈরি করেছেন বুদ্ধের জীবনী বা বুদ্ধের জাতককাহিনিসহ নানা চিত্রকর্ম। সব মিলিয়ে গুহাগুলো রহস্যঘেরা।

আমরা সকালের দিকেই গুহা দর্শনে এসেছি। তাই পর্যটকের ভিড় এখনো চোখে পড়েনি। এতে একটু ভালোই হলো, কম ভিড়ে বেশি উপভোগ করা যাবে।

প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ ফুট উচ্চতার খাড়া পাহাড়। এ খাড়া পাহাড়ের বুকে খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে গুহাগুলো। আর পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে বয়ে গেছে বাগোড়া নদী। বয়ে গেছে বললে ভুল হবে। এ পাহাড়ের সামনে দিয়ে বাঁক নিয়েছে নদীটি, পূর্ব থেকে পশ্চিমে। অনেকটা অর্ধচন্দ্রের মতো। তাই পাহাড়টিও অর্ধচন্দ্রের আকৃতি। এ অর্ধচন্দ্র আকৃতির পাহাড়টির কোলজুড়েই খোদাই করা সারি সারি গুহা। বলা যায় বাগোড়ার দুই পাশেই পাহাড়। অবশ্য এখন বাগোড়ায় পানির প্রবাহ একেবারেই কম।

যেখান থেকে গুহাগুলো শুরু হয়েছে, তার কিছুটা দূর থেকে গুহাগুলোকে অনেকটা বড় কোনো ভবনের দরজা-জানালার আকৃতি মনে হয়। আর গুহায় যাওয়ার যে সরু পথ, এটিও পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। একটু হেঁটেই আমরা আসি প্রথম গুহার সামনে। সামনে থেকে গুহাটির কারুকার্য দেখে সত্যিই মুগ্ধ হই। মূল গুহায় ঢোকার আগে যে বারান্দা আছে, তার সামনে ছয়টি স্তম্ভ। আর পাশে আছে দুটি স্তম্ভ। আট কোনা ও গোলাকার এ স্তম্ভগুলোর ওপরের অংশে খোদাই করা বুদ্ধমূর্তিসহ নানা মূর্তি, হাতি-ঘোড়া, ফুল-পাতা ইত্যাদি শিল্পকর্ম। এসব শিল্পকর্ম সত্যিই অবাক করার মতো। সামনে দেখে জুতা খুলে বারান্দা পার হয়ে প্রবেশ করি গুহার ভেতর।

চারপাশে একনজর চোখ বুলিয়ে রীতিমতো বিস্মিত। ছোটখাটো কোনো গুহা নয়, বেশ বড় গুহা। গুহা বললে ভুল হবে। মূলত এটি গুহাবিহার বা বৌদ্ধবিহার বা গুহামন্দির। কিংবা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের উপাসনালয় বলা যায়। চারপাশে পাহাড় কেটে কেটে তৈরি বুদ্ধের মূর্তি, দেয়ালে নানা রঙে আঁকা বুদ্ধের জীবনী বা বুদ্ধের জাতককাহিনি আর নানা শিল্পকর্ম দেখে ভাবি, কী করে সম্ভব পাথুরে পাহাড় কেটে এমন শিল্পকর্ম আর রঙিন দেয়ালচিত্র তৈরি করা? কিন্তু এমন অসংখ্য শিল্পকর্ম অজন্তার শিল্পীরা অজন্তার গুহায় প্রায় ৯০০ বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন। অবশ্য প্রথম গুহাবিহারটি তৈরি ৬০০ থেকে ৬৪২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। আর প্রথম গুহা বলতে নির্মাণের দিক থেকে প্রথম নয়, পাহাড়ের দিক থেকে প্রথম। তবে এ গুহার শিল্পকর্ম দেখার আগে অজন্তার গুহাগুলোর নির্মাণ ইতিহাস বা বিষয়বস্তু সম্পর্কে একটু জেনে নিই।

ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, বৌদ্ধ ভিক্ষু বা সন্ন্যাসীরা উপাসনা বা ধর্মচর্চা ও সংস্কৃতিচর্চার জন্যেই অরণ্যঘেরা নির্জন এ অজন্তার পাহাড় খোদাই করে গড়েছেন গুহাগুলো। ছোট-বড় মিলিয়ে গুহা আছে ২৯টি। আর্কেওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া তাদের প্রকাশনায় গুহার সংখ্যা ২৯টি দিয়েছে। অবশ্য এর মধ্যে ১৫ ও ১৫ এ দুটি মিলে একটি ধরা হয়েছে। সে হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে ৩০টি গুহা। এসব গুহা নির্মাণের শুরু খ্রিস্টপূর্ব ২০০ বছর আগে এবং তা চলে সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত। কে বা কারা অজন্তার এ গুহাবিহার বা উপাসনালয়ের নির্মাণকাজ শুরু করেছিলেন, সে তথ্য হয়তো জানার উপায় নেই। তবে এটা সত্যি যে শুরুটা বৌদ্ধ ভিক্ষু বা বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের হাতেই হয়েছে। অবশ্য পরবর্তী সময়ে এ গুহা খননকাজে সে সময়কার অনেক রাজা বা ধনী ব্যক্তিও ব্যয়ভার বহন করেন। এমনকি বৌদ্ধ ও হিন্দু, দুই ধর্মের ধনী লোকেরাই এসব গুহা খননে অর্থ দান করেছে বলে জানা যায়।

খোদাই করা এসব গুহা কোনোটি চৈত্য বা উপাসনালয়। কোনোটি বিহার বা সংঘারাম। মূলত চৈত্য গুহাগুলো উপাসনার জন্যেই। আর গুহাবিহারগুলোতে বুদ্ধের মূর্তির পাশাপাশি একাধিক ছোট ছোট কক্ষ আছে। এসব কক্ষ বৌদ্ধ ভিক্ষু বা সন্ন্যাসী বা তাদের ছাত্রদের কিংবা বৌদ্ধ শ্রমণদের থাকার জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সেজন্যে অজন্তার ৯, ১০, ১৯, ২৬ ও ২৯ নম্বর গুহাগুলো চৈত্য বা উপাসনালয়। বাকিগুলো বিহার বা সংঘারাম। এর মধ্যে ১০ নম্বর গুহাটি প্রধানতম চৈত্য বলে ধরা হয়। এছাড়া ১০, ৯, ৮, ১২, ১৩ ও ৩০ নম্বর গুহাগুলো নির্মাণের দিক থেকে প্রাচীন বা প্রথম দিকের। এগুলো খ্রিস্টপূর্ব ২০০ বছর থেকে পরবর্তী ২০০ বছরের মধ্যে নির্মিত। অন্যগুলো সপ্তম শতাব্দীর মধ্যে নির্মিত।

অজন্তার এসব গুহায় যেসব শিল্পকর্ম বা চিত্রকর্ম করা হয়েছে, তার অধিকাংশই বুদ্ধের জীবনীনির্ভর বা বুদ্ধের জাতককাহিনিনির্ভর। মূলত বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, বুদ্ধ তথাকথিত পূর্ব-পূর্বজন্মে যেসব লীলা করেছেন, সেই জাতিস্মর মহাপুরুষ কথিত সেই সব কাহিনিই জাতকের গল্প বা কাহিনি হিসেবে ধরা হয়। কথিত আছে, এমন গল্পের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। অবশ্য সব গুহাতেই অজন্তার শিল্পীদের চিত্রকর্মের দেখা মেলেনি। কিছু গুহার চিত্রকর্ম হয়তো অনেক আগেই নষ্ট হয়েছে। আবার কিছু চিত্রকর্ম অজন্তা নতুন করে আবিষ্কারের পরও নষ্ট হয়েছে নানা কারণে। তবে এখন অজন্তার ১, ২, ৯, ১০, ১৬ ও ১৭ নম্বর গুহায় বেশিসংখ্যক দর্শনীয় চিত্রকর্মের দেখা মিলবে।

অজন্তার গুহাগুলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বৌদ্ধ বিশ্বাসীরাই করেছেন, এটা সত্যি। তবু গুহাগুলোর ভেতরের ভাস্কর্যরীতির রিলিফ বা শিল্পকর্ম বা চিত্রকর্মগুলোতে দুটি ধারা বা দুটি যুগের ছাপ রয়েছে। একটি হীনযান বৌদ্ধ। অন্যটি মহাযান বৌদ্ধ। মূলত বুদ্ধের আদি অনুসারীরা হীনযানি বৌদ্ধ। তাঁরা বুদ্ধের মূর্তিপূজায় আগ্রহী ছিলেন না। তাই তাঁরা অজন্তার গুহায় বুদ্ধের মূর্তি খোদাই করেননি। এর বদলে তাঁরা বুদ্ধের সাংকেতিক কিছু চিহ্ন তৈরি করেছেন। যেমন স্তূপ, চরণচিহ্ন, পদ্ম ফুল, ধর্মচক্র, শূন্য রাজছত্র বা শূন্য রাজসিংহাসন ইত্যাদি। অজন্তার ৮, ৯, ১০, ১২ ও ১৩ গুহা মন্দিরগুলো এ হীনযান যুগের।

যদি এ গুহাগুলোতে বুদ্ধের মূর্তি বা ছবি দেখেন, তাহলে বুঝে নেবেন এগুলো পরবর্তীকালে মহাযান যুগের সংযোজন। এছাড়া বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে অন্য ধর্ম, বিশেষ করে হিন্দুধর্মের বিভিন্ন দর্শনের সংমিশ্রণ করে নতুন আরেকটি বৌদ্ধ ধারা ঘটেছিলো। এ ধারার অনুসারীরাই মহাযান যুগের বৌদ্ধ। তারা বুদ্ধের মূর্তিপূজায় আগ্রহী ছিলেন। সেজন্যে তারা অজন্তার গুহায় বুদ্ধের মূর্তিসহ বিভিন্ন মূর্তি খোদাই করেছেন ও বুদ্ধের ছবি এঁকেছেন। সে হিসেবে অজন্তার অধিকাংশ গুহাই মহাযান যুগে নির্মিত। তবে প্রতিটি গুহার শিল্পকর্মেরই রয়েছে আলাদা আলাদা কাহিনি বা বৈচিত্র্য।

বুদ্ধের জন্মসময় স্পষ্ট নয়। বিভিন্ন মতানুযায়ী খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩ বা ৫৬৬ বা ৫৫৬ বা ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে বুদ্ধের জন্ম হতে পারে। অথবা বলা যায় ষষ্ঠ থেকে চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে তাঁর জন্ম। তাঁর নাম ছিলো সিদ্ধার্থ গৌতম। ছিলেন রাজপুত্র। ২৯ বছর বয়সে রাজগৃহ ত্যাগ করে নির্জনে তপস্যা করে কথিত বোধিত্ব লাভ করে গৌতম বুদ্ধ নামে পরিচিত হন। তাঁর দর্শনই পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধধর্ম হিসেবে পরিচিতি পায়। তিনি বেঁচে ছিলেন ৮০ বছর। মূলত তাঁর দেহত্যাগের আনুমানিক ৫০০ বছর পর হীনযানি বৌদ্ধ ও মহাযানি বৌদ্ধ ধারা দুটি দাঁড়ায়। সে হিসেবে বুদ্ধের দেহত্যাগের আনুমানিক ২০০ থেকে ৩০০ বছরের মাথায় বৌদ্ধ ভিক্ষু বা সন্ন্যাসীরা অজন্তায় উপাসনা বা ধর্মচর্চার জন্য এ গুহাগুলো নির্মাণ শুরু করেন। তবে ৮০০ থেকে ৯০০ বছরে তিল তিল করে গড়ে ওঠা অজন্তা নবম বা দশম শতাব্দীতে হঠাৎই সম্পূর্ণভাবে পরিত্যক্ত হয় বলে অনুমান করা যায়। ঠিক কোন্ কারণে বৌদ্ধ ভিক্ষু বা সন্ন্যাসীরা তাঁদের গড়া বিশাল এ ধর্মশালা হঠাৎ ত্যাগ করেছেন, তার উত্তর আজও পৃথিবীবাসী জানে না। অন্য কোনো শক্তিশালী গোষ্ঠী নির্জন এ গুহাবাসীকে আক্রমণ করেছিলো, এমন নজিরও নেই। কোনো দুর্যোগ বা মহামারি দেখা দিয়েছিলো, এমন কিছুর তথ্যও মেলেনি। আবার তাঁরা যাওয়ার সময় গুহাগুলোর মুখ বন্ধ করেও যাননি। তাহলে তাঁরা ইচ্ছা করে বা অনিচ্ছায় বা কোনো কারণে নিজেদের গড়া এ গুহাবিহার ত্যাগ করেছেন, তার একমাত্র উত্তর অজন্তাবাসীই জানেন। যে রহস্যের সমাধান আজও মেলেনি। এরপর প্রায় হাজার বছর ধরে লোকচক্ষুর আড়ালেই ছিলো শিল্পসমৃদ্ধ অজন্তার এ গুহাগুলো।

অবাক করা বিষয় হলো, ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে যখন অজন্তা মানুষের নজরে আসে, তখন গুহাগুলোর মুখ খোলাই ছিলো এবং সেখানে কোনো ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন ছিলো না। এমনকি অজন্তাবাসীর কোনো ব্যবহৃত থালাবাটি, কলস, গ্লাস, বাসনপত্র, ভিক্ষাপাত্র, যবের মালা বা যষ্টি কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি। তাহলে? তাহলে আর কী, আগেই বলেছি রহস্যঘেরা এ অজন্তার গুহা। সে রহস্যের খোঁজ নেবো পরবর্তী গল্পে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়