শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ৩৩ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:৪৬

মায়ের অজানা অপেক্ষা

আব্দুল্লাহ আল মামুন
মায়ের অজানা অপেক্ষা

অনেক বছর আগে পাহাড়ঘেরা এক ছোট্ট গ্রাম ছিলো। তার নাম পাতিয়া। গ্রামটি ছিল শান্ত-নিরিবিলি, সরল জীবনযাত্রার। মানুষগুলো ছিল দরিদ্র, কিন্তু পরস্পরের প্রতি ছিল এক অদ্ভুত ভালোবাসা। আধুনিক চিকিৎসা, বিদ্যুৎ বা শহরের কোনো সুযোগ সুবিধা তাদের ভাগ্যে জোটেনি। প্রকৃতির উপর নির্ভর করেই তারা দিন কাটাতো।

হঠাৎ একদিন অদ্ভুত এক রোগ সেই গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে মানুষ ভেবেছিল সাধারণ পেটব্যথা। কিন্তু দিন যত গড়ায়, রোগীরা তীব্র যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করতে থাকে। এ রোগে আক্রান্তদের প্রথমে অসহ্য পেটব্যথা হতো, তারপর দুর্বল হয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো। এক মাসের মধ্যে গ্রামের প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষ মারা যায়। আতঙ্কে চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে যায়।গ্রামজুড়ে শুধু শোক আর কান্নার স্রোত বইতে থাকে।

সে সময় গ্রামের মানুষদের চিকিৎসা সম্পর্কে কোনো জ্ঞান ছিল না। ওষুধ ও পাওয়া যেত না। গ্রামে একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেনÑনাম ইলিয়াস। গ্রামবাসী তাকে জ্ঞানী মানুষ বলে মানতো। তিনি এক রাতে অদ্ভুত একটি স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্নে একটি অজানা কণ্ঠ তাকে বললÑ

“এ রোগের ওষুধ আছে... তবে তা পেতে হলে একটি বোবা ছেলেকে জীবিত কবর দিতে হবে।”

প্রথমে ইলিয়াস তা গুরুত্ব দিলেন না। কিন্তু টানা তিন রাত একই স্বপ্ন দেখে তিনি অস্থির হয়ে উঠেন। অবশেষে তিনি গ্রামের প্রবীণ ও সম্মানিত লোকদের ডেকে বিষয়টি খুলে বলেন। ভয় ও হতাশায় জর্জরিত মানুষজন শেষমেশ এই ভয়ংকর শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়।

গ্রামে সত্যিই একটি বোবা ছেলে ছিল। সে সারাদিন বাজারে ঘুরে বেড়াতো।গাছের ছায়ায় বসে থাকতো।আর কখনো মানুষের কাজ করে খাবারের বিনিময়ে পেট ভরতো। সে ছিল সহজ, সরল ও অসহায়। গ্রামের সবাই তাকে চিনতো, কিন্তু তার কণ্ঠহীনতার কারণে কেউ তাকে ঠিকমতো বোঝার চেষ্টা করতো না।

একদিন গ্রামের কিছু লোক খাবারের লোভ দেখিয়ে তাকে কবরস্থানে ডেকে নিয়ে যায়। আগে সেখানে একটি গভীর কবর খুঁড়ে রাখা হয়েছিল। বোবা ছেলেটি হয়তো ভেবেছিল তাকে খাবার দেওয়া হবে, কিংবা খেলার জন্য ডাকা হয়েছে। কিন্তু যখন তাকে জোর করে মাটির গর্তে ঢেলে দেওয়া হলো, তখন সে প্রাণপণে হাত নেড়ে, মাটি আঁকড়ে, মুখ থেকে শব্দ বের করার চেষ্টা করতে লাগলো। তার চোখে তখন শুধু আতঙ্ক আর অসহায় কান্না।

উপস্থিত লোকেরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। কেউ কেউ কাঁদতে কাঁদতে মাটি চাপা দিতে লাগলো। সবার চোখে এক প্রশ্নÑ

“এটা কি ঠিক কাজ?”

মাটি চাপা দেওয়ার সময় বোবা ছেলেটির চোখ দুটি ফাঁকা আকাশের দিকে স্থির হয়ে গিয়েছিল। হয়তো সে শেষবারের মতো বাঁচার জন্য প্রার্থনা করেছিল। কিন্তু কারও হৃদয় গলেনি। কবরের ঢিবি ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে উঠলো, আর তার নিচে চাপা পড়লো এক অসহায় প্রাণ।

বোবা ছেলেটির ছিল এক বিধবা মা। দরিদ্র হলেও ছেলেকে নিয়ে তার বেঁচে থাকাটুকুই ছিল। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ছেলে বাজার থেকে ফিরে এলে মা তার জন্য অল্প খাবার রাখতো। কিন্তু একদিন, দুদিন, তিন দিনÑছেলে আর বাসায় ফিরলো না।

মা প্রথমে ভেবেছিল হয়তো কোথাও ঘুরতে গিয়ে অসুস্থ হয়েছে। দিন দিন তার বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত অশান্তি জন্ম নিল। গ্রামের মানুষের চোখ এড়িয়ে তিনি কবরস্থানের পাশে খুঁজেছেন, কিন্তু কেউ তাকে কিছু জানায়নি। হয়তো গ্রামের মানুষ অপরাধবোধে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, কিংবা ভয়ে কিছু বলেনি।

অবশেষে দীর্ঘ খোঁজাখুঁজির পর অসহ্য দুঃখে সেই মা একদিন একাকীত্ব, ক্ষুধা ও যন্ত্রণায় মৃত্যুবরণ করেন। তার চোখ বুজে আসার সময়ও হয়তো মনে প্রশ্ন জেগেছিলÑ

“আমার ছেলে কি বেঁচে আছে, নাকি সেও মারা গেছে?”

কিন্তু সেই উত্তর তিনি কখনো জানতে পারেননি।

গ্রাম হয়তো কিছুদিন রোগমুক্ত হয়েছিল, কিন্তু সেই গ্রামের বুকের ভেতর থেকে গিয়েছিল এক অভিশাপÑএক বোবা ছেলের আর্তনাদ আর তার মায়ের অশ্রু। সেই কবরস্থানের পাশে এখনো রাতের অন্ধকারে কেউ গেলে কানে ভেসে আসে বোবা ছেলেটির নীরব আর্তচিৎকার...।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়