রবিবার, ১০ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৩ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   দেবর-ভাবীর পরকীয়ায় বলি হলো দেবর
  •   হেরেম শরীফে নামাজ শেষে দুর্ঘটনায় আহত কামরুজ্জামান মারা গেছেন
  •   শাহবাগে অবস্থান ও ঋণ দেয়ার নামে চাঁদা আদায়কালে ফরিদগঞ্জে আটক দুই।। মুচলেকা দিয়ে ছাড়
  •   হাজীগঞ্জে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত যুবকের মৃত্যু
  •   প্রেমে ব্যর্থতায় দু কিশোরের আত্মহত্যা

প্রকাশ : ১৮ জানুয়ারি ২০২২, ১১:২৮

স্মরণের আবরণে মরনেরে যত্নে রাখে

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
স্মরণের আবরণে মরনেরে যত্নে রাখে

পঞ্চাশের দশকের সেই ঝড়ো উত্তাল দিনগুলোতে ঢাকার রাস্তায় রিকশার মধ্যে খাকি পোশাক পরা একজন মানুষকে টিনের চোঙা হাতে কোন জনসভা বা প্রতিবাদ মিছিলের ঘোষণা প্রচারের কাজে দেখেননি এমন লোক তখন ছিলো না বললেই চলে। এই মানুষটি এম. এ. ওয়াদুদ। মুসলিম লীগ সরকার তখন গু-াবাহিনী পুষতো। তাদের কাজ ছিলো বিরোধী দলের জনসভা ভেঙে দেওয়া। বিরোধী দলের নেতাদের মারধর করা। ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে আওয়ামী লীগ আহূত শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর একটি জনসভা একবার মুসলিম লীগের গু-াবাহিনী দিনে-দুপুরে ভেঙে দেয়।

এরপর এই গু-াবাহিনীকেও প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেন এম. এ. ওয়াদুদ। তাঁকে সহায়তা করার জন্য দাঁড়ান বাদশা মিয়া। পুরনো ঢাকার এক মহল্লা-নেতা। কিন্তু গুন্ডামির প্রতিরোধে গুন্ডামি নয়। ওয়াদুদ ভাইয়ের নেতৃত্বে শান্তিরক্ষাকারী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হয়। ওয়াদুদ ভাই সামরিক বাহিনীর মতো এই বাহিনীতে নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষা করেছেন। তাঁরা কোথাও গু-ামি করেননি। কিন্তু তাঁদের উপস্থিতিতেই মুসলিম লীগের গুণ্ডারা পালিয়ে যেতো। এই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী পরিচালনায় ওয়াদুদ ভাইয়ের কমান্ড সকলেই মাথা পেতে মেনে নিতো। এমনই ছিলো তাঁর ব্যক্তিত্ব।

আমি তাঁর এই সাহস এবং গুণ্ডামি প্রতিরোধে শান্তিপূর্ণ ভূমিকার অতুলনীয় উদাহরণ নিজে প্রত্যক্ষ করেছি ১৯৫৩ সালে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে (২১ ফেব্রুয়ারি) সর্বদলীয় উদ্যোগে ঢাকায় বিশাল ছাত্র মিছিল করার আয়োজন করা হয়। তদানীন্তন নূরুল আমিন সরকারের ইচ্ছা ছিল না এই মিছিল করার অনুমতি দেওয়ার। প্রাদেশিক সরকারের চীফ সেক্রেটারি মোহাম্মদ ইসহাক সর্বদলীয় প্রতিনিধিদলকে জানালেন, ‘শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে এই ছাত্র মিছিলের অনুমতি দেওয়া যাবে না।’

প্রতিনিধিদল বলল, রাস্তায় পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা না হলে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব আমরা নেব। কোনো গ-গোল হলে সরকারের কাছে আমরা দায়ী হবো। অনেক বাগ্্বিত-ার পর চীফ সেক্রেটারি মিছিলের অনুমতি দিতে রাজি হলেন। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এম. এ. ওয়াদুদ এবং ছাত্র ফেডারেশনের (পরবর্তীকালে ছাত্র ইউনিয়ন) পক্ষ থেকে মোহাম্মদ সুলতান মিছিলের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নেন।

সরকারী ক্ষমতার বলে ছাত্র মিছিল বন্ধ করতে না পারায় মিছিল ভাঙা এবং ছাত্র নেতাদের নির্যাতনের জন্য প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকার এক কৌশলের আশ্রয় নেয়। ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের (তখন নাম ছিলো ভিক্টোরিয়া পার্ক) কাছে প্রভিন্সিয়াল লাইব্রেরী নামে ছিল একটি বইয়ের দোকান। এই দোকানের মালিক ছিলেন কট্টর মুসলিম লীগপন্থী। তাকে পরামর্শ দেওয়া হলো, ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে সারা শহরে ধর্মঘট পালিত হবে। একটি দোকানপাটও খোলা থাকবে না। কিন্তু ছাত্র মিছিলকে উস্কানি দেওয়ার জন্য প্রভিন্সিয়াল লাইব্রেরীর মালিক তার বইয়ের দোকান খোলা রাখবেন।

উদ্দেশ্যটি অত্যন্ত স্পষ্ট। ’৫৩ সালের ওই ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে সারা শহরে একটি দোকানপাটও খোলা নেই। কিন্তু প্রভিন্সিয়াল লাইব্রেরী খোলা। বিশাল ছাত্র-জনতার মিছিল বাহাদুর শাহ পার্ক অতিক্রম করে সদরঘাটের দিকে যাওয়ার সময় এই বইয়ের দোকান খোলা দেখে নিশ্চয়ই ইট-পাটকেল মারবে। উত্তেজক সেøাগান দেবে। তখন পার্কের ভেতর বসিয়ে রাখা পুলিশ শান্তিশৃঙ্খলা ভঙ্গ হচ্ছে এই অজুহাতে মিছিল ভেঙে দেবে, ছাত্রদের বেধড়ক মারপিট করবে, ছাত্র-নেতাদের গ্রেফতার করবে।

তেপ্পান্ন সালের এই বিশাল মিছিলে আমিও ছিলাম। মিছিল শুরু হওয়ার গোড়াতেই ওয়াদুদ ভাইকে খাকি পোশাকে হুইসেল হাতে কমান্ডারের ভূমিকায় দেখলাম। তাঁর কঠোর নির্দেশ এই মিছিলে কোনো সেøাগান দেওয়া চলবে না। এই মিছিল হবে মৌন মিছিল। একুশে ফেব্রুয়ারির হত্যাকা-ের নীরব প্রতিবাদ। তাঁর এই নির্দেশ সকলেই মেনে নেন। এমনকি আতাউর রহমান খানের মতো প্রবীণ নেতারাও।

বাহাদুর শাহ পার্কে মিছিল পৌঁছতেই প্রভিন্সিয়াল লাইব্রেরী খোলা দেখে মিছিলের মধ্যে উত্তেজনা দেখা যায়। ওয়াদুদ ভাই হুইসেল হাতে ক্রমাগত দৌড়াচ্ছেন, নির্দেশ দিচ্ছেন। খবরদার, ওই লাইব্রেরীর দিকে কেউ তাকাবে না। মিছিলকে উত্তেজিত করতে না পেরে লাইব্রেরীর ভেতর থেকে কিছু লোক অশ্রাব্য ভাষায় মিছিলের নেতাদের অনেকের নাম ধরে গালি দিতে থাকে। মনে হচ্ছিল এই ক্রমাগত উস্কানির মুখে মিছিল থেকে বুঝি লাইব্রেরীটির ওপর আক্রমণ হয়। না, হয়নি। ওয়াদুদ ভাইয়ের বজ্রকণ্ঠের সতর্কবাণী গোটা মিছিলকে সুশৃঙ্খল রেখেছে।

ওয়াদুদ ভাইয়ের মধ্যে এই বিশাল নেতৃত্বগুণ সেদিন আমাদের হতবাক করেছিল। ’৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির এই অভূতপূর্ব মিছিল ইতিহাস সৃষ্টিকারী মৌন মিছিল, কালো ব্যাজধারী এই বিশাল মিছিল থেকে একটি সেøাগানও দেওয়া হয়নি। কেবল আমরা যখন সেন্ট্রাল জেলের সামনের রাস্তা অতিক্রম করছি, তখন একটি মাত্র সেøাগান দেওয়া হয়েছে, ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’। ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে মুসলিম লীগ সরকারের দ্বারা বিনাবিচারে শয়ে শয়ে রাজনৈতিক বন্দী জেলের জানালার গরাদের ভেতর থেকে হাত বের করে, কিছু বন্দী জেলের ছাদে উঠে মিছিলকে হাত নেড়ে অভিনন্দন

জানিয়েছেন। সেদিনের ছাত্র-জনতার বিশাল মিছিল, ওয়াদুদ ভাইয়ের কঠোর সেনাপতিত্ব আমার জীবনের এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা।

আমি ওয়াদুদ ভাইকে নিয়ে কিছু স্মৃতিচিত্র আঁকতে বসেছি। তাঁর জীবনালেখ্য লিখতে বসিনি। তাঁর জীবনালেখ্য লিখলে একটা বড় বই লিখতে হয়। তিনি নবপর্যায়ে ছাত্রলীগের (১৯৪৮) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাপর্বেও তিনি ছিলেন সামনের কাতারের একজন তরুণ কর্মী। অসাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ইয়ুথ লীগ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও তাঁর ছিল অসামান্য অবদান। তখনকার ইয়ং টার্ক্সÑশেখ মুজিব, মোহাম্মদ ইমাদুল্লা, নূরুদ্দীন, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা প্রমুখের তিনি অন্যতম। ভাষা আন্দোলনের অগ্রসেনানী। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে অকুতোভয় যোদ্ধা। সবচাইতে বড় পরিচয় পাকিস্তানের তৎকালীন পূর্বাংশে প্রথম এস্টাবলিশমেন্টবিরোধী একটি জনপ্রিয় দৈনিকের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। পাকিস্তান আমলে তিনি কতবার জেলগমন করেছেন এবং কতদিন আন্ডারগ্রাউন্ডে দুঃসহ জীবনযাপন করেছেন, তার কোনো হিসেব নেই। স্বাধীন বাংলাদেশেও সামরিক শাসকদের দ্বারা তাঁকে নির্যাতিত হতে হয়েছে।

আমি আবারও তাঁর স্মৃতিচিত্রে ফিরে যাই। ‘ইত্তেফাক’ তখন সবে দৈনিক হয়েছে। চার পৃষ্ঠার কাগজ। বের হয় ৯, হাটখোলা রোডের প্যারামাউন্ট প্রেস থেকে। কাগজটির বিপুল চাহিদা। কিন্তু উচ্চমূল্যে বিদেশী নিউজপ্রিন্ট কিনে চাহিদামতো কাগজ ছাপানো যায় না। দেশে তখন নিউজপ্রিন্ট তৈরি হয় না। বিদেশ থেকে আমদানি করা নিউজপ্রিন্টের ওপর নির্ভর করতে হয়। তার দাম আবার বেজায় চড়া।

একদিন হয়েছে কি, ইত্তেফাককে যিনি নিউজপ্রিন্ট সাপ্লাই দিতেন, তার কাছে বহু টাকা বাকি পড়ে গেছে। তিনি বললেন, অন্তত কিছু টাকা না পেলে তিনি নিউজপ্রিন্ট দেবেন না। মানিক ভাই টাকার জন্য অনেক চেষ্টা করলেন। সেদিন রবিবার, ব্যাংক বন্ধ (তখন বাংলাদেশে শনিবার, রবিবার ছুটির দিন ছিল)। মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিব তখন ঢাকার বাইরে মফস্বল ট্যুর করছেন। শেষ পর্যন্ত ওয়াদুদ ভাইয়ের ডাক পড়লো। মানিক মিয়া বললেন, ওয়াদুদ মিয়া, ইত্তেফাকের প্রকাশ কি আজ বন্ধ রাখতে হবে? ওয়াদুদ ভাই নির্দ্বিধায় বললেন, না, বন্ধ থাকবে না। নিউজপ্রিন্টের টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কোথা থেকে হবে সে কথা তিনি জানালেন না। কিন্তু মানিক ভাই জানতেন, ওয়াদুদ ভাইয়ের কথার নড়চড় হবে না। কাগজ বের হবেই।

যথাসময়ে নিউজপ্রিন্ট এলো। ইত্তেফাক ছাপা হলো। কিন্তু ওয়াদুদ ভাইকে ডাক্তারের পরামর্শমতো প্রায় অর্ধদিন বেডে থাকতে হলো। কারণ, তিনি ঢাকা মেডিক্যালে গিয়ে নিজের শরীরের রক্ত বিক্রি করে সেই টাকা নিউজপ্রিন্ট সাপ্লায়ারকে দিয়ে এসেছেন। ওয়াদুদ ভাইয়ের ওপর মানিক মিয়ার নির্ভরতা এতটাই ছিল। ১৯৫৬-৫৭ সালের দিকে ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়ার দৈনিক পত্রিকা ‘মিল্লাত’ যখন চলছে না তখন কাগজটির প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ওয়াদুদ ভাই খবরটা শুনে মানিক ভাইকে বললেন, কাগজটা বন্ধ হবে কেন? এতগুলো সাংবাদিক বেকার হবে। আমরা কাগজটা নিলে কেমন হয়?

মানিক ভাই বললেন, কাগজটার কাটতি কিছুই নেই। দেনাও প্রচুর। এই মরা কাগজ কি আবার জেতা করা যাবে? ওয়াদুদ ভাই বললেন, ‘নিশ্চয়ই যাবে। এ কাগজ মরতে দেওয়া উচিত নয়। আওয়ামী লীগের জন্য আরেকটি দৈনিক দরকার।’ মানিক ভাই কাগজটার দায়িত্ব মোহন মিয়ার কাছ থেকে নিলেন এবং তার পরিচালনাভার দিলেন ওয়াদুদ ভাইকে। ওয়াদুদ ভাই ইত্তেফাকের রামকৃষ্ণ মিশন রোডের অফিস থেকে নিজের দফতর গোটালেন সদরঘাটের কাছে ওল্ড কোর্ট রোডের মিল্লাত অফিসে।

এক মাসের মধ্যে মিল্লাতের চেহারা ফিরে গিয়েছিল। মরা নদীতে যেন আবার জোয়ার এসেছিল। আহমেদ-উর রহমান মিল্লাতে সম্পাদকীয় বিভাগে ছিলেন। তাঁকে দিয়ে ওয়াদুদ ভাই রাজনৈতিক কলাম লেখানো শুরু করেন। আহমেদ-উর রহমান বামপন্থী ছিলেন। এই বামপন্থীদের প্রতি ওয়াদুদ ভাইয়ের ছিল দারুণ মানবিক প্রবণতা। আহমেদ পরে ‘ইত্তেফাকে’ ভীমরুল নামে মিঠেকড়া কলাম লিখে খ্যাত হন। ১৯৬৫ সালের মে মাসে কায়রো বিমান দুর্ঘটনায় তিনি আরও অনেক সাংবাদিকসহ মারা যান।

আমি তখন ‘ইত্তেফাকের’ সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করি। ওয়াদুদ ভাই হঠাৎ একদিন ‘ইত্তেফাকে’ এসে হাজির। আমাকে বললেন, ‘তোমাকে মিল্লাতেও একটা রাজনৈতিক কলাম লিখতে হবে। সামান্য কিছু পারিশ্রমিক দেব।’ ওয়াদুদ ভাইয়ের কথায় না বলা ছিল অসম্ভব। তাঁর নির্দেশে মিল্লাতে আমি একটি রাজনৈতিক কলাম লেখা শুরু করি। মিল্লাত মোটামুটি ভালোই চলছিল। কিন্তু আইয়ুব খান পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করার পর পত্রিকাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওয়াদুদ ভাই ‘ইত্তেফাকে’ ফিরে আসেন।

ওয়াদুদ ভাই শুধু মাঠের রাজনীতি করতেন না; নেপথ্যে আওয়ামী লীগের ঐক্য ও অস্তিত্ব রক্ষাতেও তাঁর অবদান ছিল অতুলনীয়। ১৯৫৬-৫৭ সালের দিকে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দলের তরুণ ও প্রগতিশীল অংশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এটা দলের প্রবীণ নেতা আতাউর রহমান খানসহ অনেকের সহ্য হচ্ছিল না। দুই গ্রুপের বিরোধ প্রকাশ্য হয়ে ওঠে। এই বিরোধে নারদ মুনির খেলা খেলছিলেন আরেক প্রবীণ নেতা আবুল মনসুর আহমদ। আতাউর রহমান খান তখন পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ দলীয় প্রাদেশিক সরকারের মুখ্যমন্ত্রী। আবুল মনসুর আহমদের ইচ্ছা ছিল, আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে মতবিরোধ উস্কে দিয়ে কমপ্রোমাইজ-ক্যান্ডিডেট হিসেবে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হবেন।

দলের এই অন্তর্দ্বন্দ্বে সোহ্রাওয়ার্দী বিব্রত হয়ে পড়েন। তিনি মানিক মিয়া ও ওয়াদুদ ভাইয়ের পরামর্শ চান। ওয়াদুদ ভাই নেতাকে আশ্বাস দেন, তিনি এই বিবাদ বাড়তে দেবেন না। আতাউর রহমান ও শেখ সাহেব দু’জনের বিরোধ মিটিয়ে তিনি দু’জনকে করাচীতে শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর কাছে পাঠিয়ে দেবেন। ওয়াদুদ ভাই সত্যই তাঁর মিশনে সফল হয়েছিলেন। তিনি শেখ মুজিব ও আতাউর রহমানের কাছে কিছুদিন ঘোরাঘুরির পর তাঁদের দু’জনকে একত্রে করাচী পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। সোহ্রাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর যখন আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন নিয়ে দলের প্রবীণ ও নবীন অংশের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয় তখন ওয়াদুদ ভাই শেখ মুজিবের নেতৃত্বে দলের পুনরুজ্জীবনের পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিলেন। ছয় দফা উত্থাপনের সময়েও ওয়াদুদ ভাই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার একনিষ্ঠ সমর্থক।

ওয়াদুদ ভাইকে নিয়ে অনেক স্মৃতির মধ্যে একটা দিনের স্মৃতি আমার মনে এখনো উজ্জ্বল হয়ে ফুটে আছে।

১৯৬৯ সালের ১ জুন। মানিক মিয়া আকস্মিকভাবে রাওয়ালপিন্ডিতে মারা গেছেন। ঢাকায় সবাই শোকাচ্ছন্ন। তখন পাকিস্তানে সামরিক শাসন চলছে। শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান সামরিক শাসকের কাছে ঢাকার বিশেষ একটি স্থানে মানিক মিয়াকে সমাহিত করার জন্য একটু জমি চেয়ে টেলিফোন করেছিলেন। সামরিক শাসক তাতে না বলেছিলেন। তখন মানিক ভাইয়ের পরিবার রামকৃষ্ণ মিশন রোডে তখনকার ইত্তেফাক ভবনেই সিঁড়ির মুখে (বাড়িটি তখন একতলা ছিল) তাঁকে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে ‘ইত্তেফাক’ অফিসে মাটি খোঁড়ার কাজও শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওয়াদুদ ভাই আপত্তি জানান। তিনি বলেন, ‘ইত্তেফাক’ অফিসের সিঁড়ির মুখে মানিক ভাইকে কবর দেয়া হলে তাঁর প্রতি অসম্মান জানানো হবে। তিনি ছিলেন মাটি ও মানুষের সবচাইতে কাছাকাছি একজন সম্পাদক। তাঁকে তাঁর প্রিয় মাটি ও মানুষের কাছেই সমাহিত করা হোক। অতঃপর আজিমপুর গোরস্তানে মানিক মিয়াকে দাফন করা হয়।

আজিমপুর গোরস্তানে মানিক ভাইয়ের সমাধি খনন হওয়ার পর তাঁর মৃতদেহ কবরে শোয়ানোর জন্য বঙ্গবন্ধু এবং ওয়াদুদ ভাই দু’জনেই কবরে নেমেছিলেন। ধূলি ধূসরিত অঙ্গে দু’জনেই কবর থেকে উঠে আসার পর শেখ মুজিব ভাঙা কণ্ঠে ওয়াদুদ ভাইকে বলেছিলেন, ‘ওয়াদুদ এখন চলো। মানিক ভাইকে কবরে রেখে গেলাম।’ আমি নিকটেই দাঁড়িয়েছিলাম। ওয়াদুদ ভাই বলেছিলেন, ‘মানিক ভাইয়ের দেহটা কবরে রেখে গেলাম, কিন্তু তিনি আমাদের সঙ্গে আছেন।’

আজ দীর্ঘদিন পর মনে হচ্ছে, বত্রিশটা বছর মহাকালের গর্বে তলিয়ে গেছে। ওয়াদুদ ভাইও আজ আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু তিনি আছেন এবং চিরকাল থাকবেন।

প্রকাশ কাল : লন্ডন ৩ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার, ২০১৫

সূত্র : অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদারের ফেসবুক হতে নেয়া।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়