শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ যৌথ বাহিনীর ভ্রাম্যমাণ চেকপোস্ট ৯০ যানবাহনে তল্লাশি।। ১২ মামলায় ৬০ হাজার টাকা জরিমানা, ৬ গাড়ি জব্দ
  •   হরিণা থেকে দু মাদক ব্যবসায়ী আটক
  •   কয়েক কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ৩৯ জনের তথ্য চেয়েছে দুদক

প্রকাশ : ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ২১:৪৮

চাঁদপুরের সুনাম নষ্ট করছে বরিশালের পচা ইলিশ

মাছঘাটে সক্রিয় গোপন বাণিজ্যচক্র

উজ্জ্বল হোসাইন
চাঁদপুরের সুনাম নষ্ট করছে বরিশালের পচা ইলিশ
প্রতিকী ছবি

বাংলাদেশের ইলিশ মানেই চাঁদপুরের ইলিশ। চাঁদপুরের ইলিশ নামটি আজ একটি ব্র্যান্ড, জাতীয় গর্ব। কিন্তু সেই ব্র্যান্ড আজ হুমকির মুখে। গত ক’দিন ধরে চাঁদপুর বড় স্টেশন মাছঘাট এলাকায় বরিশাল থেকে আসছে শত শত মণ ইলিশ। যার বেশিরভাগই পচা, বরফে জমে থাকা বা নষ্ট। এই মাছগুলো বিভিন্নভাবে নতুন বরফে প্যাকেট করে বাজারে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে চাঁদপুরের ইলিশ নামে। এতে শুধু ভোক্তাকেই প্রতারিত করা হচ্ছে না, বরং চাঁদপুরের বহু বছরের সুনামও মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে।

বৃহত্তর বরিশাল থেকে পচা ইলিশ আসার একমাত্র সহজ গন্তব্য হচ্ছে চাঁদপুর । প্রতিদিন বিকেলে কিংবা তার আগে বরিশালের গলাচিপা, পটুয়াখালী, ভোলার দৌলতখান এবং মেহেন্দিগঞ্জ এলাকা থেকে মাছভর্তি ট্রলার ও ফিশিংবোট যাত্রা করে চাঁদপুরের উদ্দেশে। এই মাছগুলো সাধারণত ফিশিং বোটের হিমঘরে কয়েকদিন ধরে পড়ে থাকা নষ্ট মাছ। রাতের আঁধারে ২টা থেকে ৪টার মধ্যে এই ট্রলারগুলো চাঁদপুর বড় স্টেশন ও মাছঘাট এলাকায় ভিড়ে। এরপর সকাল থেকে শুরু হয় আনলোডের কাজ। সেখানেই শুরু হয় গোপন লেনদেন।

স্থানীয় সূত্র জানায়, এ কাজে জড়িত মাছঘাটের ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। তাদের প্রতিটির অধীনে কাজ করছে ২০-৩০ জন শ্রমিক, যারা ট্রলার থেকে এসব পচা মাছ নামিয়ে আড়তে নিয়ে আসে। এরপর ট্রাক ও পিকআপে করে সেগুলো চলে যায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।

এসব মাছের মধ্যে যেগুলো একটু ভালো সেগুলো ‘চাঁদপুরের ইলিশ’ নামেই বিক্রির জন্যে ঢাকার কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ী, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও ফেনীর বাজারে পাঠানো হয়।

স্থানীয় এক আড়তদার জানান, যে পচা মাছগুলো চাঁদপুর ঘাটে আসছে সেগুলোর সাথে অনেকেই জড়িত। কারণ বেপারীরা মাছ ঘাটে আনে যে মাছগুলো, সেগুলো কম-বেশি সবাই আড়তে বিক্রি করছে। তবে চাঁদপুর ঘাটে আসার পর আমরা জানতে পেরেছি ফিশিংবোটের মাছ পচা।

চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শবে বরাত সরকার জানান, নিষিদ্ধ সময়ে জেলেরা এই মাছগুলো ধরে সংগ্রহ করে রেখেছিলো। এখন সেই সময় শেষ হওয়ার পর বেপারীরা মাছগুলো ঘাটে নিয়ে আসছে বিক্রির জন্যে। পরে স্থানীয় ও গণমাধ্যমকর্মীরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করলে গত দুদিন প্রশাসনের লোকজন এসে দায়ীদের জরিমানা করে এবং পচা মাছ মাটিতে পুঁতে ফেলে।

খবরে জানা যায়, চাঁদপুরে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও যৌথ বাহিনীর  অভিযানে ১টি প্রতিষ্ঠানকে লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অভিযান পরিচালনাকালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯  অনুযায়ী  প্রশাসনিক ব্যবস্থা হিসেবে একটি মাছের ট্রলারে  নষ্ট পচা ইলিশ মাছ পাওয়ায় হেলাল মাঝি (মনপুরা, ভোলা) নামক একজন ব্যবসায়ীকে এক লাখ টাকা জরিমানা আরোপ করা হয়। এ ব্যক্তির পক্ষে  মো. মোস্তফা মাল নামক একজন স্থানীয় মৎস্য ব্যবসায়ী জরিমানার টাকা পরিশোধ করেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনায় যেসব মাছ ধরা পড়ে তা চাহিদার তুলনায় খুবই কম। আর যেহেতু চাঁদপুরের মাছের স্বাদ ও গন্ধ অতুলনীয়, তাই বরিশালের বেশিরভাগ মাছ চাঁদপুরের ইলিশ বলে চালিয়ে দেয়া হয়। আর এসব কাজে রয়েছে ছোট-বড় বহু সিন্ডিকেট। আর এসব সিন্ডিকেটের বেশির ভাগই চাঁদপুর মাছঘাটের আড়তদার। পচা ইলিশের বড়ো অংশের উৎস বরিশাল এবং মাছগুলো আসলে পচা বা বরফে জমে যাওয়া।

এক পাইকারি বিক্রেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গ্রাহক চাঁদপুরের নাম শুনে বেশি দাম দেয়। তাই ব্যবসায়ীরা সব মাছই চাঁদপুরের বলে বিক্রি করে। অনেকেই জানে না, ওই মাছের বেশির ভাগই আসলে বরিশালের ইলিশ।

২০১৭ সালে চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ও চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্সের উদ্যোগে রাজধানীর বসুন্ধরা কনভেনশন হলে অনুষ্ঠিত হয় প্রথমবারের মতো জেলা ব্র্যান্ডিং ফেস্টিভাল 'ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর'। সে অনুষ্ঠানে ইলিশের অর্ধশতাধিক রেসিপি তৈরি করে আগত অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয়। কথিত রয়েছে, সেখানে বড় স্টেশনের ক’জন মাছ ব্যবসায়ী নিম্নমানের ইলিশ সরবরাহ করেছিলেন।

ফলে অনুষ্ঠানে অতিথিদের জন্যে পরিবেশিত ইলিশের মধ্যে বেশ কিছু মাছের গন্ধ ও স্বাদে অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে। পরে জানা যায়, ওই মাছগুলো গুদামের স্টোর থেকে সরবরাহ করা হয়েছিলো। এ ঘটনার পর স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সুধী সমাজে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে লিখেছেন, চাঁদপুরের ইলিশ এখন শুধু নামেই বিখ্যাত, ভেতরে স্বাদহীন।

মাছঘাট এলাকার এক শ্রমিক বলেন, রাতের বেলায় ট্রলারগুলো আসে। আমরা মাছ নামিয়ে নতুন বরফে ভরি। সকালে ট্রাক আসে, মাছ চলে যায় ঢাকায়। টাকাও ভালো পাই, তাই কাজ ছাড়তে পারি না।

আরেকজন আড়তদার বলেন, এই ব্যবসায় অনেক বড়ো বড়ো লোকের অংশ আছে। প্রতিবাদে কেউ কথা বললে তাকে কাজ থেকে বের করে দেয়া হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই চক্রের সঙ্গে জড়িত কিছু প্রভাবশালী আড়তদার। ফলে অভিযান হলেও তা প্রায়ই আংশিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকে।

চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা মাঝেমধ্যে অভিযান চালাই। পচা মাছের অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে চক্রটি অনেক সংগঠিত ও সক্রিয়।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, অভিযানগুলো অনেকটাই চোখে ধুলো দেওয়ার মতো। অভিযান আসে মাঝে মাঝে, তখন তেমন আর কিছু পাওয়া যায় না। সব কাজই হয় আড়তদারদের মাধ্যমে।

চাঁদপুরের ইলিশ শিল্পের সঙ্গে জড়িত লাখো মানুষ--জেলে, আড়তদার, বরফকল মালিক, পরিবহন শ্রমিক, বিক্রেতা সবাই এই চক্রের কারণে ক্ষতির মুখে। যখন পচা ইলিশ চাঁদপুরের নামে বাজারে যায়, তখন তাজা মাছের বাজারমূল্য কমে যায়। ফলে প্রকৃত জেলেরা ন্যায্য দাম পায় না। এছাড়া, দেশের বাইরে রপ্তানির ক্ষেত্রেও এই প্রভাব পড়ছে।

এক রপ্তানি ব্যবসায়ী বলেন, বিদেশে এখন অনেক আমদানিকারক ‘চাঁদপুরের ইলিশ’ নিতে চায় না, কারণ কিছু কনসাইনমেন্টে নষ্ট মাছ পাওয়া গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. খুরশিদ জাহান বলেন, পচা ইলিশে সাধারণত হিস্টামিন, স্যালমোনেলা ও ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেয়। এই ধরনের পচা ইলিশ খেলে তীব্র খাদ্য বিষক্রিয়া, ডায়রিয়া, বমি এবং লিভারের ক্ষতি হতে পারে। অনেক সময় তা প্রাণঘাতিও হতে পারে।

বাংলাদেশ ফিশারিজ অ্যাক্ট ২০২০ অনুযায়ী, পচা বা নষ্ট মাছ বিক্রির অপরাধে সর্বোচ্চ ২ বছরের জেল ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে। কিন্তু চাঁদপুরে এ ধরনের মামলার সংখ্যা হাতে গোণা ক'টি।

এক আইনজীবী বলেন, প্রমাণের অভাব ও প্রভাবশালীদের চাপে অনেক মামলা শুরুই হয় না। ফলে চক্রটি নির্ভয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

স্থানীয় সাংবাদিক, ব্যবসায়ী এবং সচেতন নাগরিকরা বলছেন, চাঁদপুরের নাম বাঁচাতে হলে প্রশাসনকে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

চাঁদপুর প্রেসক্লাবের এক সদস্য বলেন, ইলিশ শুধু একটি পণ্য নয়, এটি চাঁদপুরের সংস্কৃতির অংশ। এই অপকর্ম বন্ধ না করলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ‘চাঁদপুরের ইলিশ’ শব্দটাই মানুষের কাছে অবিশ্বাস্য হয়ে যাবে।

স্থানীয় অধিবাসিরা বলছেন, ২৪ ঘণ্টা নজরদারিতে রেখে বড় স্টেশন মাঝঘাটে নিয়মিত মৎস্য বিভাগ, ভোক্তা অধিকার ও প্রশাসনের যৌথ অভিযান চালাতে হবে। ফিশিংবোট ও ট্রলারে বরিশাল ও চাঁদপুরের নৌ-পুলিশের তল্লাশি জোরদার করতে হবে। চাঁদপুরের ইলিশ নামে বিক্রি হওয়া মাছের জন্যে জেলা প্রশাসনের অনুমোদিত লোগো বা সার্টিফিকেট ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। ক্রেতাদের বোঝাতে হবে, সব ইলিশ চাঁদপুরের নয়। দোষীদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রভাবশালী হোক বা সাধারণ ব্যবসায়ী, পচা মাছ বিক্রির জন্যে দোষীদের আইনের আওতায় আনতে হবে।

চাঁদপুরের ইলিশ বাংলাদেশের গর্ব, কিন্তু এই গর্ব আজ প্রতারণার শিকার। বরিশাল থেকে আসা পচা ইলিশ চাঁদপুরের নামে বিক্রি করে একদল অসাধু ব্যবসায়ী রাতারাতি ধনী হচ্ছে। অথচ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রকৃত জেলে, ব্যবসায়ী ও দেশের ভাবমূর্তি। প্রশাসনের নীরবতা এবং জনগণের উদাসীনতা অব্যাহত থাকলে, চাঁদপুরের ইলিশ হয়তো একদিন ইতিহাস হয়ে যাবে। এখনই সময়, এই চক্রের বিরুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার, যাতে আবারও চাঁদপুরের ইলিশ তার সত্যিকারের প্রসিদ্ধি ফিরিয়ে আনতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়