প্রকাশ : ২০ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০৭
যুবদলের আহ্বায়কের নেতৃত্বে পুলিশের গাড়িতেই যুবককে পেটালেন নেতাকর্মীরা

নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক ইসমাইল হোসেন ইলিয়াসের নেতৃত্বে পুলিশের গাড়িতে মারজান উদ্দিন (২৯) নামে এক যুবক বেধড়ক মারধরের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে থানা প্রাঙ্গণে মব সৃষ্টির চেষ্টার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, মারধরকারীরা উপজেলা বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক ইসমাইল হোসেন ইলিয়াসের অনুসারী।
|আরো খবর
রোববার (১৯ অক্টোবর ২০২৫) বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও থানা প্রাঙ্গণে এ ঘটনা ঘটে। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ১১ জন আহত হয়েছে।
আহতরা হলেন : হেলাল উদ্দিন, ইমতিয়াজ, ফরিদ উদ্দিন, ওমর ফারুক, কোহিনুর বেগম, উম্মে কুলসুম, নাজিম উদ্দিন, মারজান উদ্দিন, সাইফুজ্জামান, শাহাব উদ্দিন ও মহিমা বেগম। এদের মধ্যে এক নারীসহ দুজনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পরে গুরুতর আহতাবস্থায় মারজান উদ্দিন ও তার বড়োভাই উপজেলার সুখচর ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা শাহাব উদ্দিনকে থানায় সোপর্দ করা হয়।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর ২০২৫) উপজেলার নলচিরা ইউনিয়নের লামছড়ি গ্রামের কামাল উদ্দিনের মেয়ে নিগার সুলতানাকে পারিবারিকভাবে বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়েতে নিজ গ্রামের হুজুরকে দাওয়াত না দিয়ে অন্য গ্রামের হুজুর দিয়ে বিয়ে পড়ানো হয়। এ নিয়ে সমাজের মসজিদ কমিটির ক্যাশিয়ার হেলাল মাঝির সাথে কামালের ছোট ভাই উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা শাহাব উদ্দিনের বাকবিতণ্ডা হয়। রোববার সকালে স্থানীয় রামচরণ বাজার থেকে শাহাব উদ্দিন বাড়ি ফেরার পথে নলচিরা ইউনিয়নের ১নম্বর ওয়ার্ডের রবিনের দোকানের সামনে হেলাল মাঝির নেতৃত্বে কিছু লোক তাকে মারধর করে। খবর পেয়ে শাহাব উদ্দিনের ভাই মারজান ও নাজিম ঘটনাস্থলে যায়। সেখানে তাদের বেধড়ক মারধর করে তিনজনকে কুপিয়ে আহত করে। পরে তারা বাড়ি চলে গেলে লামছড়ি গ্রামের তাদের দুটি বসতঘরে হামলা ভাংচুর করে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার লুটে নেয় এবং তাদের অবরুদ্ধ করে রাখে। পরে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ কল পেয়ে পুলিশ শাহাব উদ্দিন ও মারজানকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। এক পর্যায়ে উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক ইলিয়াসকে তার অনুসারীরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে ডেকে নেয়। সেখানে তার নেতৃত্বে পুলিশের সামনে শাহাব উদ্দিন ও তার ভাই মারজানের ওপর হামলা চালানোর চেষ্টা করে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবকদলের নেতাকর্মীরা। পরে হাসপাতাল থেকে থানায় নেওয়ার পথে হাসপাতালের ফটকের সামনে উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক ইলিয়াসের নেতৃত্বে পুলিশের গাড়িতে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীরা হামলা চালায়। পুলিশের গাড়িতেই পুলিশকে হেনস্তা করে মারজানকে বেধড়ক মারধর করে তার শরীর থেকে সব ব্যান্ডেজ খুলে নেয়। এরপর তারা থানার সামনে গিয়েও তার ওপর হামলা চালানোর চেষ্টা করে ব্যাপক হট্টগোল সৃষ্টি করে।
হেলাল মাঝি উল্টো অভিযোগ করে বলেন, শাহাব উদ্দিনের ভাইয়ের মেয়ের বিয়েতে আমাদের মসজিদের হুজুরকে দাওয়াত না দিয়ে অন্য হুজুরকে দাওয়াত দেওয়া হয়। আমি মসজিদের ক্যাশিয়ার হিসেবে বিষয়টি জিজ্ঞাসা করলে শাহাব উদ্দিন ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে হুমকি দেন। রোববার সকালে আমি স্থানীয় রামচরণ বাজারে উঠলে তিনি আমাকে দেখে হামলা চালান। ওই সময় তার আরো ৪ভাই এসে আমাদের ওপর হামলা চালায় এবং কুপিয়ে আহত করে। এতে আমাদের কয়েকজন গুরুতর আহত হয়। এদের মধ্যে কোহিনুর ও ফরিদ উদ্দিনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় জেলা সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়।
থানা প্রাঙ্গণে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে উপপরিদর্শক (এসআই) মিনহাজুলকে উদ্দেশ্য করে যুবদল নেতাকে বলতে শোনা যায়, আপনার মত মানুষ যদি....। তাকে আমরা হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসছি, তাকে মারার দরকার আছে। তার বিরুদ্ধে মামলা হবে। এক পর্যায়ে এসআই মিনহাজুল মাটিতে বসে গিয়ে প্রশ্ন করে, আমার সামনে আসামিকে মারধর করে কিভাবে। ওই ভিডিওতে ইলিয়াসকে থানা প্রাঙ্গণে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে দেখা যায়।
হাতিয়া উপজেলা স্বেচ্ছাসেবকদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক বাবর আজম বলেন, উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক ইলিয়াসের নেতৃত্বে এ হামলা চালানো হয়। এতে সাধারণ মানুষের কাছে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। ইলিয়াসের বিরুদ্ধে আগে থেকেই নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীমের অনুসারী হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। তবে অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে হাতিয়া উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক ইসমাইল হোসেন ইলিয়াস বলেন, আমার উপস্থিতিতে কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি। উল্টো আমরা আমাদের দলের কয়েকজন নেতা লাঠিসোটা দিয়ে আমাদের দলের লোকজনকে পিটিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছি। প্রথমে সমস্যা ছিলো বিয়ে নিয়ে। পরে এটা এনসিপি বনাম বিএনপি হয়ে গেছে। শাহাব উদ্দিন কৃষি অফিসের একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারি ও মূলত ছাত্রলীগের একজন লাঠিয়াল ছিলো। তার লোকজনের হামলায় প্রতিপক্ষের ৭জন আহত হয়েছে। আমরা আমাদের দলীয় নেতাকর্মীকে নির্দেশনা দিয়েছি, কারো ওপরে যেন কোনো আঘাত না হয়। যা হয়েছে, এতে দলের বদনাম আসবে, তোমরা যদি দলবদ্ধ হয়ে আঘাত করতে যাও।
এ বিষয়ে জানতে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীমের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও মুঠোফোনে সংযোগ পাওয়া যায়নি। তাই এ বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে জেলা যুবদলের আহ্বায়ক মন্জুরুল আজিম সুমন বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে এ বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে হাতিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মিনহাজুল আবেদীন বলেন, কৃষি কর্মকর্তার স্ত্রী উম্মে কুলসুম জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরে অবহিত করলে আমি আহত অবস্থায় অবরুদ্ধ দুই ভাইকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসি। এর মধ্যে প্রথমে কৃষি কর্মকর্তাকে চিকিৎসা দিয়ে থানায় হেফাজতে নেওয়া হয়। তার ভাই মারজানকে চিকিৎসা দিয়ে থানায় নিয়ে আসার পথে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে পুলিশের উপস্থিতিতে পুলিশের গাড়িতেই তার সকল ব্যান্ডেজ খুলে নিয়ে তাকে পিটানো হয়। ওই সময় হাসপাতালের ফটকের সামনে বিএনপির সহযোগী সংগঠনের সবাই ছিল।
হাতিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে এম আজমল হুদা বলেন, দুই গ্রুপই কোপাকুপি করছে। এক পর্যায়ে জনগণ কৃষি কর্মকর্তার বাড়িঘর ভাংচুর করছে। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা পুলিশ হেফাজতে আছে। দুই পক্ষই মামলা করবে। এটা পলিটিক্যাল কোনো বিষয় না। সাহাব উদ্দিন সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলীর দোসর ছিলো, ফ্যাস্টিট ছিলো। গত ৮-১০ বছর সে এখানে চাকরি করতেছে। সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার শর্তে তিনি আওয়ামী লীগের সাথে এসে দল ভারি করছে। আগে থেকেই জনগণের তার ওপর একটা রাগ ছিল।
ওসি আরও বলেন, পরবর্তীতে অন্য গ্রুপ থানা প্রাঙ্গণে এসে বলে ফ্যাস্টিসকে আমাদের হাতে তুলে দেন, আমরা তাকে নিয়ে যাব। এ নিয়ে থানার প্রাঙ্গণে উচ্চবাচ্য হয়েছে।