শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ২৮ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০৪

জোরপূর্বক 'সাধুর চুল' কর্তন: ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ওপর নৃশংস আঘাত ও প্রশাসনের নীরবতা!

হালিম উদ্দিন আকন্দের ঘটনা সমাজে ন্যায় ও মানবিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে?

মো. জাকির হোসেন
জোরপূর্বক 'সাধুর চুল' কর্তন: ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ওপর নৃশংস আঘাত ও প্রশাসনের নীরবতা!
ছবি :৭০ বছর বয়সী হালিম উদ্দিন আকন্দ,সংগৃহীত

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও সমগ্র দেশের মনোযোগ কেড়েছে। ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার কোদালিয়া গ্রামের ৭০ বছর বয়সী হালিম উদ্দিন আকন্দকে জোরপূর্বক ধরে চুল কেটে দেওয়ার দৃশ্য সেখানে ধরা পড়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, বৃদ্ধ ব্যক্তি নিজের ওপর আঘাত ঠেকাতে চেষ্টা করছেন, কিন্তু তিন-চার জনের একযোগে আক্রমণের ফলে তিনি শেষ পর্যন্ত বেহুঁশ হয়ে পড়েন। এটি শুধু একটি ব্যক্তির উপর হামলা নয়; এটি **ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মানবিক মর্যাদার ওপর নৃশংস আঘাত**।

স্থানীয়রা হালিম উদ্দিনকে সাধারণত হালিম ফকির বা সাধু নামে চেনে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ফকিরি জীবন যাপন করছেন। স্থানীয়দের বর্ণনা অনুযায়ী, তিনি মানসিকভাবে সুস্থ, সামাজিকভাবে স্বাভাবিক এবং সংসার জীবনে পুত্র ও কন্যার জনক। প্রায় ৩৭ বছর ধরে তার মাথায় জট এবং দাড়ি ছিল, যা তার আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি অঙ্গ। এছাড়া তিনি হজরত শাহজালাল (রহ.) ও শাহ পরাণ (রহ.)-এর ভক্ত। এই চুল ও দাড়ি তার আধ্যাত্মিক পরিচয়ের প্রতীক, যা হঠাৎ ও জোরপূর্বক কর্তনের মাধ্যমে তার মর্যাদা ও স্বাধীনতা নস্যাৎ করা হয়েছে।

ঘটনার দিন হালিম উদ্দিন নিজেই বলেন, “আমারে ফালায়া দিয়া হুতাইয়া চুল কাটছে। হেইবেলা আমি বেহুঁশ হয়ে গেছিলাম। এরপর থেকে আমি বাজারে যাই না, কাজকামও করতে পারি না।” এটি প্রমাণ করে, শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবে তার ওপরও কতটা প্রভাব পড়েছে। স্থানীয়রা জানান, এই হামলার পরে বৃদ্ধ ব্যক্তি পুরোপুরি গৃহবন্দি হয়ে পড়েন এবং দৈনন্দিন কাজকর্মে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না।

আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে এই ঘটনা স্পষ্টভাবে শারীরিক আঘাত, অবৈধ বাধা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হয়। বাংলাদেশের Penal Code অনুযায়ী, ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে আঘাত করা (Section 323), অবৈধভাবে আটক বা বাধা দেওয়া (Section 341), এবং অপ্রত্যাশিতভাবে শারীরিক বল প্রয়োগ করা (Section 352) প্রযোজ্য। হালিম উদ্দিনকে বাধ্য করে চুল কাটার ঘটনায় এই তিনটি ধারা প্রযোজ্য, কারণ এটি তার শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক নিরাপত্তার ওপর হামলা।

স্থানীয় প্রশাসন ইতিমধ্যেই খোঁজখবর নিয়েছে। তারাকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ টিপু সুলতান বলেছেন, “বৃদ্ধ ব্যক্তি হালিম ফকির হিসেবেই পরিচিত। যারা তার চুল কাটেছে, তারা স্থানীয় নয়। স্থানীয় কেউ তাদের চিনতে পারেনি। যদি বৃদ্ধ আইনি পদক্ষেপ নিতে চান, আমরা ব্যবস্থা নেব।” উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাকির হোসাইনও জানিয়েছেন, “বৃদ্ধের সঙ্গে থানার ওসিকে খোঁজ নিতে বলা হয়েছে। যদি ঘটনা সত্য হয়, আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তবে, ঘটনার ধারা এবং সামাজিক প্রভাব বিবেচনা করলে প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপের তৎপরতা আরও জরুরি।

ঘটনাটি শুধু ব্যক্তিগত আঘাত নয়; এটি সমাজের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের ওপরও আঘাত। সাধু, ফকির ও বাউল সম্প্রদায়ের প্রতি এমন হামলা সামাজিক সহিষ্ণুতা ও ধর্মীয়-আধ্যাত্মিক স্বাধীনতার প্রতি হুমকি। হালিম ফকিরের চুল ও দাড়ি শুধু তার ব্যক্তিগত পরিচয়ের অংশ নয়; এটি তার আধ্যাত্মিক জীবনধারার একটি প্রতীক। সমাজের দায়িত্ব হলো এই ধরনের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও আধ্যাত্মিক অনুশীলনের প্রতি সম্মান বজায় রাখা।

আইনের পাশাপাশি সমাজকেও প্রতিটি নাগরিকের স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষা করতে সচেতন হতে হবে। প্রত্যক্ষদর্শী, ভিডিও ফুটেজ এবং অন্যান্য প্রমাণ সংগ্রহ করে দোষীদের আইনি শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। প্রশাসনের নীরবতা বা জটিলতা এমন ঘটনা পুনরায় ঘটতে উসকানি দিতে পারে। দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া না হলে, বয়স্ক এবং আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের উপর সহিংসতার ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে।

হালিম উদ্দিনের ঘটনা দেখিয়েছে, বয়স্ক ও মানসিকভাবে সুস্থ ব্যক্তিদের শারীরিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কতটা জরুরি। এটি রাষ্ট্র এবং সমাজের নৈতিক দায়িত্বও। আইন অনুযায়ী যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না হলে, সমাজে সহিংসতা, অবমাননা এবং অমানবিক আচরণ বাড়তে পারে। সঠিক তদন্ত এবং কার্যকর আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে কেবল দোষী শাস্তি নিশ্চিত হবে না, বরং সমাজেও ন্যায়, মানবিকতা এবং সহনশীলতা প্রতিষ্ঠা পাবে।

হালিম ফকিরের মতো বয়স্ক ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা প্রত্যেক নাগরিক এবং রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। এই ধরনের ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, সামাজিক সংহতি, নৈতিকতা এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষায় সক্রিয় থাকা জরুরি।

লেখক: অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, চাঁদপুর জেলা বিএনপি।

ডিসিকে/এমজেডএইচ

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়