প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:১৭
রায় দিয়ে ‘বাবার ট্রাস্টে’ টাকা নেন বিচারপতি
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি খুরশীদ আলম সরকার। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে ২০২২ সালের শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টের কোম্পানি বেঞ্চের দায়িত্ব পালন করেছেন। আর এই দায়িত্ব পালনকালে গাইবান্ধার ‘ফুলছড়ি হাজী সাত্তার’ ট্রাস্টকে তিনি ‘ডোনেশনের’ নামে কোটি কোটি টাকা দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন। এ ট্রাস্ট তার বাবা হাজী এম এ সাত্তারের নামে গঠিত। এ ছাড়া তার এলাকার বেশিরভাগ মসজিদ-মাদ্রাসা-মন্দিরে তিনি কোম্পানি কোর্ট থেকে আদেশের মাধ্যমে ডোনেশন (অনুদান) দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। একটি মসজিদে চার দিনের ব্যবধানে ১১ লাখ টাকার ডোনেশন দিয়েছেন।
|আরো খবর
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোম্পানি কোর্টের ডোনেশনের টাকা এলাকার মসজিদ-মাদ্রাসায় দেওয়ার পেছনে তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। কারণ, তার আসন গাইবান্ধা-৫ থেকে তার স্ত্রী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেছেন। এলাকার মানুষের মন জোগাতে এবং নির্বাচনী মাঠে নিজেদের কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখতে কোম্পানি কোর্টকে ব্যবহার করেছেন। তার এসব কর্মকাণ্ড উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের জন্য করা আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং বহুমাত্রিক দুর্নীতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, বিচারপতি খুরশীদ আলম সরকার ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। তার বাবার নাম আলহাজ এম এ সাত্তার সরকার এবং মা আসমা সাত্তার। বাড়ি গাইবান্ধার ফুলছড়ির কালিরবাজার। তিনি ২০১৩ সালের ৭ অক্টোবর হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর থেকে তিনি বেঞ্চের একজন জুনিয়র বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ২০১৭ সালের মে মাসের দিকে তাকে হাইকোর্টের একক কোম্পানি বেঞ্চের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর পর থেকেই কোম্পানি কোর্ট থেকে ডোনেশনের নামে টাকা বাগিয়ে নিতে শুরু করেন।
‘আচরণবিধিতে যা বলা আছে’
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের জন্য ৩৯ দফার আচরণবিধি চূড়ান্ত করে দেন আপিল বিভাগ। ২০১৭ সালের ২ আগস্ট তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির রায়ে এসব আচরণবিধি উল্লেখ করা হয়। এই আচরণবিধিতে বিচারকদের পেশাদারিত্ব ও নৈতিক মানদণ্ড কেমন হবে, কোন কোন বিষয়ে তারা সচেতন থাকবেন, কোন ধরনের আচরণ পরিহার তাদের করতে হবে, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে কোন কোন বিষয়ে তাদের সতর্ক থাকতে হবে—এসবের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয় ওই রায়ে। রায়টি এখনো বহাল রয়েছে।
ওই রায়ে দেওয়া আচরণবিধির ১৫ নম্বর ধারায় বলা হয়, দেশ-বিদেশের কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কোনো বিচারক জড়িত থাকতে পারবেন না। ২১ ধারায় বলা হয়, একজন বিচারক জনবিতর্কে অংশ নিতে পারবেন না। প্রকাশ্যে কোনো রাজনৈতিক বিতর্কেও অংশ নিতে পারবেন না। এমনকি বিচার বিভাগে মুলতবি রয়েছে, এমন কোনো বিষয়েও বিতর্কে জড়াতে পারবেন না। ২৫ নম্বর ধারায় বলা হয়, একজন বিচারককে তার আচরণ ও কাজ দিয়ে বিচার বিভাগের মর্যাদা ও জনগণের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে।
২৯ নম্বর ধারায় বলা হয়, বিচারকের পরিবারের কোনো সদস্য যদি কোনো মামলার কোনো পক্ষের প্রতিনিধিত্ব করেন, তা হলে ওই বিষয়ে বিচারক অংশ নিতে পারবেন না। ৩০ নম্বর ধারায় বলা হয়, আইন পেশায় জড়িত রয়েছেন এবং মক্কেলকে আইনি সহযোগিতা দেন, এমন কোনো ব্যক্তিকে বিচারক তার বাসস্থানে স্থান দেবেন না। ৩১ নম্বর ধারায় বলা হয়, একজন বিচারক তার পরিবারের কোনো সদস্যকে এমন কোনো সামাজিক বা অন্য কোনো সম্পর্কে জড়াতে দেবেন না, যা তার আদালতের কোনো বিষয়কে প্রভাবিত করতে পারে। ৩২ নম্বর ধারায় বলা হয়, একজন বিচারক কারও সম্পদ ব্যবহার করতে পারবেন না বা এমন কারও কাছ থেকে ঋণ নিতে পারবেন না, যার দ্বারা বিচারকাজে প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পরিবারের সদস্যদেরও এমন কাজ থেকে বিরত রাখবেন। ৩৪ নম্বর ধারায় বলা আছে, বিচারক বা বিচারকের পরিবারের সদস্যরা বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনের জন্য কোনো উপহার চাইবেন না, কোনো উপহার বা ঋণ নেবেন না।
তথ্যসূত্র :কালবেলা