প্রকাশ : ২০ জুন ২০২৫, ০০:৪২
ইরান নয় শুধু, ইতিহাসই জবাব দিচ্ছে এবার ইসরায়েলকে
১৯৬৭-র ছয় দিনের অপমানের ছায়া ভেদ করে ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে লড়ছে ইরান—পেছনে পুরো আরব জগতের অতৃপ্ত আত্মা।

মধ্যপ্রাচ্য কখনো শান্তির ভূমি ছিল না—বিশেষ করে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে। তবু ইতিহাসে কিছু মুহূর্ত থাকে, যা যুগান্তকারী—পিছনের অপমান ঘোচাতে সামনে যারা দাঁড়ায়, তাদের মনস্তত্ত্বে, কৌশলে ও প্রতিরোধে তা প্রকাশ পায়। ২০২৫ সালে ইরান ও তার মিত্রদের যে যুদ্ধনীতি আজ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দেখা যাচ্ছে, তা কেবল একটি চলমান সংঘাতের চিত্র নয়, বরং দীর্ঘস্থায়ী এক ইতিহাসের প্রতিক্রিয়া।
|আরো খবর
১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে আরব বিশ্বের অপমান
১৯৬৭ সালের ৫ জুন ইসরায়েল মিশরের বিমানঘাঁটিতে চমকপ্রদ হামলা চালিয়ে যুদ্ধে প্রথম ধাক্কা দেয়। তারপর মাত্র ছয় দিনের মধ্যে ইসরায়েল জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা, সিনাই উপদ্বীপ ও গোলান মালভূমি দখল করে নেয়। এই যুদ্ধ আরব বিশ্বের কাছে শুধু ভূখণ্ড হারানোর যুদ্ধ ছিল না, এটি ছিল মনোবল ধ্বংসের এবং সম্মানহানির।
মিশরের গামাল আবদেল নাসের, যিনি আরব জাতীয়তাবাদের মুখ ছিলেন, এই যুদ্ধে কার্যত রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হন। তার ‘প্যান আরবিজম’-এর স্বপ্ন চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। সিরিয়া, জর্ডান ও মিশর একত্র হলেও সমন্বয়ের অভাব, গোয়েন্দা ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক দ্বিধাদ্বন্দ্বের কারণে তারা ব্যর্থ হয়। পশ্চিমা দেশগুলো ইসরায়েলকে নানাভাবে সহায়তা করে এবং আরব বিশ্ব একে একে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বিশ্ব কূটনীতিতে আরব রাষ্ট্রগুলো প্রান্তিক হয়ে পড়ে।
নাকসা থেকে নব্য প্রতিরোধ: ইতিহাস কি পুনরাবৃত্ত হচ্ছে?
আরবরা ১৯৪৮ সালের ‘নাকবা’ (বিপর্যয়) ও ১৯৬৭ সালের ‘নাকসা’কে (অধিক বিপর্যয়) ইতিহাসের সবচেয়ে লজ্জাজনক অধ্যায় হিসেবে মনে করে। সেই স্মৃতি শুধু বইয়ের পাতায় নেই—তা আরব মানসপটে আজো তাজা। নতুন প্রজন্ম, যারা জন্ম নিয়েছে পরাজয়ের পর, তাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে প্রতিরোধের এক মানসিকতা। ইরান সেই ইতিহাসকে রাজনৈতিক ও কৌশলগতভাবে নতুন করে ব্যবহার করছে।
ইরান সরাসরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আহ্বান দেয়নি, বরং মধ্যপ্রাচ্যে একধরনের বিকল্প প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো—হামাস, হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুথি এবং ইরাক ও সিরিয়ার শিয়া মিলিশিয়ারা—একত্র হয়ে এক ‘প্রক্সি ফ্রন্ট’ তৈরি করেছে। এই ফ্রন্ট ২০২৪-২৫ সালে যুদ্ধক্ষেত্রে দৃশ্যমান হয়েছে এক অভূতপূর্ব সামর্থ্যে।
গাজা: যেখানে প্রতিরোধ ইতিহাসের কেন্দ্রে
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের দীর্ঘ অবরোধ, বিমান হামলা ও মানবিক সংকট এমন এক মাত্রায় পৌঁছেছে যে, সেখানে প্রতিরোধ এক জীবনধারায় পরিণত হয়েছে। হামাসের নেতৃত্বে এবং ইরানের সহায়তায় গাজায় যে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে, তা শুধুই গাজার সীমায় আটকে নেই। এটি এখন এক প্রতীক—আরব বীরত্বের, অপমানের প্রতিশোধের।
বিশ্বের দৃষ্টি যখন ইউক্রেন যুদ্ধ, অর্থনৈতিক সংকট কিংবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দিকে, তখন গাজার মানুষ প্রতিদিন মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছে। ইসরায়েল দাবি করে তাদের প্রতিক্রিয়া আত্মরক্ষামূলক। কিন্তু বাস্তবতা হলো, শিশু, নারী ও সাধারণ মানুষ প্রতিদিন নিহত হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো যার বিরুদ্ধে একাধিক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এই নৃশংসতা আর চুপচাপ সহ্য করার মতো মনোবল আর আরব দুনিয়ায় নেই।
ইরান: পেছনে ইতিহাস, সামনে পরমাণু ও রাজনীতি
ইরান শুধু প্রতিরোধে নেতৃত্ব দিচ্ছে না, বরং ইতিহাসের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এক টেকসই কৌশল তৈরি করেছে। পরমাণু শক্তি, উপসাগরীয় অঞ্চলে সামরিক ঘাঁটি, মিত্র শক্তিগুলোর মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধ কৌশল—সব মিলিয়ে ইরান এখন এক পরাশক্তির পথে। ১৯৬৭ সালে যা মিসর করতে পারেনি, ইরান তা রাজনৈতিক পরিপক্বতা দিয়ে করছে।
তবে এটি নিছক সামরিক কৌশল নয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইরান পশ্চিমা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ‘প্রতিরোধের মুখ’ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। পশ্চিমা বিশ্ব যেখানে ইরানকে ‘সন্ত্রাসের মদদদাতা’ হিসেবে চিহ্নিত করে, সেখানে দক্ষিণ বিশ্ব ও ইসলামী দুনিয়ায় তারা ‘নতুন সালাহউদ্দিন’-এর ভূমিকায়।
ইসরায়েলের সংকট: ঘরে-বাইরে চাপ বাড়ছে
ইসরায়েল বরাবরই সামরিক কৌশলে আধিপত্য দেখিয়ে এসেছে। কিন্তু ২০২৪ সালের গাজা অভিযানে তারা আন্তর্জাতিকভাবে যে সমালোচনার মুখে পড়েছে, তা নজিরবিহীন। হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার নেতৃত্বে ৫০টিরও বেশি দেশ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এমন পরিস্থিতি ১৯৬৭ কিংবা ১৯৭৩ সালের পর আর দেখা যায়নি।
সামাজিক দিক থেকেও ইসরায়েলে বিভাজন বেড়েছে। নেতানিয়াহুর সরকার অভ্যন্তরীণ বিরোধ, বিচার বিভাগীয় সংস্কার বিতর্ক ও দূর্নীতির অভিযোগে বিপর্যস্ত। এসব পরিস্থিতি ইরান ও তার মিত্রদের আরও উজ্জীবিত করেছে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট: ফিলিস্তিন ইস্যুর পুনরুত্থান
ফিলিস্তিন ইস্যু বহুদিন আন্তর্জাতিক মিডিয়ার প্রাধান্য থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ২০২৩-২৪ সালের গাজা যুদ্ধ ও ইরান-ইসরায়েল সংঘর্ষ ফিলিস্তিনকে আবার বিশ্বমানচিত্রের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে জাতিসংঘ পর্যন্ত এখন ফিলিস্তিন নিয়ে কথা হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে বিক্ষোভ, মানবাধিকার সংস্থার বিবৃতি, এবং সামাজিক মাধ্যমে জেগে উঠা নতুন প্রজন্ম ফিলিস্তিনের পক্ষে যে জনমত তৈরি করছে, তা ৬৭ সালের চেয়ে বহু গুণ বেশি শক্তিশালী। ইসরায়েলি ন্যারেটিভ এখন চ্যালেঞ্জের মুখে।
ইতিহাস জেগে উঠেছে, এবার নির্ধারণ সময়ের
২০২৫ সালে ইরান ও ইসরায়েলের দ্বন্দ্বে শুধু দুটি দেশের ভবিষ্যত নির্ধারিত হচ্ছে না, নির্ধারিত হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যত, ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, আরবদের সম্মানের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও ইতিহাসের দায়মুক্তি। ৬৭’র অপমান আজ আর কেবল স্মৃতি নয়, এটি এক প্রজন্মের জাগরণ।
ইতিহাস ভুলে যায় না। যারা ইতিহাস ভুলে যায়, তারা বারবার পরাজিত হয়। আর যারা ইতিহাসকে শিখিয়ে দেয়, তারা প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠে। এবার ইসরায়েল তার সামনে শুধু ইরানকে দেখছে না—দেখছে ইতিহাসকে। সেই ইতিহাস এবার প্রশ্ন করছে: কে অপরাধী? কে ন্যায়পক্ষ? কে বিজয়ী হবে এই দীর্ঘ যুদ্ধ শেষে?
লেখক :মো. জাকির হোসেন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, চাঁদপুর জেলা বিএনপি।
ডিসিকে/এমজেডএইচ