প্রকাশ : ০৭ জুলাই ২০২১, ০০:০০
করোনায় পৃথিবীর অগ্রযাত্রাকে দুটি ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। আমরা ২০১৯-এর পূর্ববর্তী পৃথিবীর সাথে আর কোনো দিন করোনা পরবর্তী পৃথিবীর মিল খুঁজে পাব না। এই পরিবর্তনটা হবে অস্বাভাবিকভাবে ভিন্ন এবং মৌলিক। নতুন অনেক কিছুর জন্যে প্রস্তুত হতে হবে মানব জাতিকে। এর মধ্যে কিছু পরিবর্তন স্থায়ী হয়ে উঠবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমাদের বিশ্বকে যেভাবে পাল্টে দিয়েছিল তেমনি করোনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে ব্যাপক মাত্রায় চেনা জানা বিশ্বকে পাল্টে দিতে পারে। জার্মানির চ্যান্সেলর এঙ্গেলা ম্যার্কেল ১৮ মার্চ দেশবাসীর উদ্দেশ্যে এক ভাষণে করোনা সংক্রমণকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সবচেয়ে বড় সঙ্কট বলেছেন।
মানব ইতিহাসে এই প্রথমবার এমন চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে শিক্ষাক্ষেত্রে। শিক্ষার্থীদের ওপর করোনা প্রভাব শীর্ষক ব্র্যাকের এক গবেষণার ফলাফলে উঠে এসেছে, করোনার সময়ে প্রায় ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থীকে গৃহস্থালি কাজ ও পরিবারকে সহযোগিতা করতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে ২২ শতাংশ শিক্ষার্থীর পরিবারে খাদ্য সঙ্কট রয়েছে। অন্যদিকে যাদের পরিবারে খাদ্য সঙ্কট ছিলো না এবং কোনো রকম আয়বর্ধক কাজ করতে হয়নি সেসব পরিবারের প্রায় ২৭ শতাংশ শিক্ষার্থী গল্প-গুজব বা আড্ডাবাজি করে দিন অতিবাহিত করছে। অন্যদিকে বিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সঠিক নির্দেশনা না পাওয়ায় ৪৪ শতাংশ, পরিবার থেকে সাহায্য না পাওয়ায় ১৯ শতাংশ এবং ঘরে পড়ার উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় ১১ শতাংশ শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে।
ইউনেস্কো ইতিমধ্যেই সতর্ক করে বলেছে, করোনা পরবর্তী বিশে^ আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া দেশগুলো ২০২১ সাল থেকে কাটছাঁট করবে তাদের শিক্ষা বাজেটে। গোটা বিশে^ই শিক্ষার বাজেটে প্রায় ৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘাটতি দেখা দিবে।
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বৈশ্বিক মহামারি করোনার মধ্যে একদম থেমে না থাকলেও পুরোপুরি চালু করা সম্ভব হয়নি। যেহেতু শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড এবং শিক্ষা ব্যবস্থার অগ্রগতি ও সাফল্যের উপরই দেশের সামগ্রিক উন্নতি নির্ভরশীল। বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে অনলাইন ক্লাসের কার্যকারিতা নিয়েও বিভিন্ন কারণে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ প্রায় ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বিভিন্ন কারণে এই ধরনের অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। এদের মধ্যে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থী, মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, ক্ষুদ্র ও নৃগোষ্ঠির শিক্ষার্থী, আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীরা রয়েছে। সুতরাং আমদের অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয় সমতা আনয়নে পুরোপুরি সক্ষম হয়নি।
সেভ দা সিলড্রেন-এর একটি আলোচনায় উঠে এসেছে, করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে হয়তো স্কুলেই যাওয়া হবে না প্রায় এক কোটি শিশুর। এই ভয়ঙ্কর তথ্যে আমাদের বুকটা ধুক করে কেঁপে উঠে।
এক সময় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সশরীরে উপস্থিতি ও চিন্তাভাবনা প্রকাশের মূলকেন্দ্র ছিল শ্রেণীকক্ষ। কিন্তু বর্তমান মহামারির ভয়াবহতায় পুরোটাই পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর তবে অদূর ভবিষ্যতে মহামারির অবসানের পর আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নিম্নোক্ত পরিবর্তনসমূহ সাধিত হবে। অফলাইন ও অনলাইন শিক্ষাক্রমে আমরা চলে আসবো। আমাদের পাঠক্রমের ৬০ শতাংশ অনলাইনে ও বাকি ৪০ শতাংশ অফলাইনে পড়ানো হবে। বেড়ে যাবে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার। ছাত্র-ছাত্রীরা বাসায় বসে পড়াশুনায় অভ্যস্ত হয়ে যাবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় মুখস্থ বিদ্যায় খাতায় লিখে ভালো ফলাফলের পরিবর্তে শুরু হবে প্রজেক্ট বেইজ মূল্যায়ন পদ্ধতি। যেখানে থাকবে ছাত্র-ছাত্রীদের মেধা বিকাশের অফুরন্ত সুযোগ আর সাথে থাকছে দুনিয়া জুড়ে তথ্য প্রবাহের আশীর্বাদ।
করোনা পরবর্তী শিক্ষা ব্যবস্থায় পেরেনটিং এডুকেশনের গুরুত্ব বাড়বে অর্থাৎ বাসায় বাবা-মারা হবে ছাত্র-ছাত্রীদের অন্যতম বড় প্রশিক্ষক। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলেজেন্সির ব্যবহারে শিক্ষার্থীরা হবে আন্তর্জাতিক মানের, আমাদের শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাবে।
করোনা পরবর্তী আমাদের করণীয়সমূহ :
* শিক্ষক প্রশিক্ষণ : শিক্ষক হলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রাণ। বর্তমান সমস্যা মোকাবেলায় তাদেরকে দক্ষ আধুনিক ডিজিটাল রিসোর্স তৈরি করার ক্ষমতা সম্বলিত প্রশিক্ষণ। তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার ও আধুনিক এডুকেশন টুলস ব্যবহারে শিক্ষকগণের দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।
* কারিকুলাম পুনঃসংস্করণ : বর্তমানে প্রয়োজন কমিউনিটি বেইজড বা ক্রাউড সোর্স কারিকুলাম যার মাধ্যমে যার যতোটুকু প্রয়োজন ততটুকু কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করবে। দক্ষতাভিত্তিক ও মেধার বিকাশ ও সেলফ ডেভেলপমেন্টমূলক নানা কার্যক্রম কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
* এডুকেশনাল রিসোর্স : প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, তাই প্রতিটি শিক্ষার্থীকে শিক্ষা উপকরণ হিসেবে ইলেকট্রনিক ডিভাইস প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। স্বল্পমূল্যে শিক্ষার্থীদেরকে ইন্টারনেট সুবিধা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফ্রি ইন্টারনেট প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।
* মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষা : আমাদের শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে আরও সুদৃঢ় ও আত্মপ্রত্যয়ী হওয়ার জন্যে মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষা প্রয়োজন। সর্বোপরি প্রজেক্ট বেইজ লানির্ং সিস্টেমে শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করা।
* পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশীপ : করোনাকালীন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়। উভয়ে মিলে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও আগামীকে মোকাবেলার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।
* মিশ্র শিক্ষার প্রবর্তন : করোনা পরবর্তী জগতে ৪০ শতাংশ পাঠ অফলাইনে গতানুগতিক পন্থায় দেয়া হবে, বাকি ৬০ শতাংশ অনলাইন ভিত্তিক হবে। এতে একজন ছাত্রের বুদ্ধিগত বিকাশ সম্ভব। করোনা পরবর্তী পৃথিবী অনলাইন শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেবে।
* দূরশিক্ষণ ব্যবস্থা : ছাত্ররা ঘরে বসেই পড়াশুনা করবে নানা অভিনব পন্থা অবলম্বন করে। তাই ভবিষ্যতে কাজ ও পড়াশুনা একাধারে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে এবং দূরশিক্ষণে বিপ্লব সাধিত হবে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, আগামী দিনে ছাত্র-ছাত্রীরা মুখস্থ বিদ্যার ওপর ভর করে ভালো ফলাফল করতে পারবে না। ভবিষ্যতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিক্ষার ক্ষেত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। পরীক্ষার প্রশ্নসমূহ বিশ্লেষণাত্মক হবে এবং ছাত্র-ছাত্রীদের আরও সৃজনশীল করে তুলবে। সেজন্য আমাদের প্রয়োজন শিক্ষাবান্ধব বাজেট। বর্তমানে আমদের দেশে জিডিপির ২.২ শতাংশ বরাদ্দ করা হয় শিক্ষায়, যা অপ্রতুল। বর্তমানের শিক্ষায় এই বৈষম্য দূর করার জন্য সরকারের শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেট আরো বাড়াতে হবে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে তৈরি করতে হবে এডুকেশন ফান্ডিং। এই করোনা মহামারি আমদেরকে যেভাবে সমস্যায় ফেলেছে তেমনিভাবে উত্তরণের অনেক সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। শিক্ষা ও অর্থ ব্যবস্থার সংস্কারের মাধ্যমে জাতীয়ভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা উপকরণ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করে সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। সেজন্যে সবার সমন্বিত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা খুবই জরুরি। সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই আমরা সফলতা পাবো ও শিক্ষা বৈষম্য অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
লেখক ও কলামিস্ট : মোঃ শাহ্ নেওয়াজ মজুমদার।
ইমেইল : [email protected]