প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০
যে সময়ে আমাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা, সেই সময়ের হাত ধরে শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের ধাপগুলো অতিক্রম করলেও দেশের প্রকৃত ইতিহাসের কিছু অধ্যায় অজানাই রয়ে যায়। ছোটবেলা থেকে আমরা পাঠ্যপুস্তক থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যতোটুকু জেনেছি, তাতে যে বিষয়টি একেবারেই অনুপস্থিত ছিলো বলে মনে করি, সেটি হলো মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা। অথচ এই দেশের বীর সাহসী অসংখ্য নারী জীবন বাজি রেখে নানা রকম কায়দা-কৌশলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাদের অবদানের কথা বরাবরই উপেক্ষিত রয়ে গেছে। এই নারী যোদ্ধারা কখনও সংগঠক, কখনও সেবিকা, কখনও আশ্রয়দাতা, কখনও চিকিৎসক, কখনও গুপ্তচর, কখনও সক্রিয়ভাবে অস্ত্র হাতে শত্রুর মোকাবিলা করেছেন।
অনেক ত্যাগের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল, সেই স্বাধীন দেশে নারী যোদ্ধাদের অনেকেই দিনের পর দিন মানবেতর জীবনযাপন করেছেন। তবু দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসার কারণে তারা খেতাব বা স্বীকৃতির পেছনে ছোটেননি। কারও কাছে হাত পাতেননি। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সেলিনা পারভীন, কবি মেহেরুন্নেছা, আয়েশা বেদৌরী চৌধুরী, ভাগীরথীরর অসামান্য ত্যাগ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অম্লান।
মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের পত্রিকা ‘শিলালিপি’র সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে সেলিনা পারভীনকে ১৩ ডিসেম্বর বিজয়ের মাত্র তিন দিন আগে তাকে হানাদার বাহিনী তুলে নেয় এবং ১৮ ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তার লাশ পাওয়া যায়।
১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কবি মেহেরুন্নেছা দেশপ্রেম, একুশের চেতনা, স্বাধীনতার বোধ নিয়ে কবিতা লিখেছেন। ২৩ মার্চ নিজ বাড়িতে বাংলার পতাকা উত্তোলন করে সাহসের সঙ্গে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়েছিলেন। ২৭ মার্চ মিরপুরে নিজ বাড়িতে দুই ভাই, মাসহ কবি মেহেরুন্নেছাকে হত্যা করা হয়।
রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে ওঠার কারণে আয়েশা বেদৌরী চৌধুরী দেশের রাজনীতি নিয়ে বেশ সচেতন ছিলেন। চিকিৎসা পেশাকে তিনি মুক্তিযুদ্ধে কাজে লাগিয়েছেন। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মুহূর্তে শত্রুরা তার গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি করলে তিনি শহীদ হন।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ভাগীরথীর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তার ওপর নেমে আসা জুলুম দুনিয়ার আর কোথাও কোনো নারী ভোগ করেছে কি-না সন্দেহ। যুদ্ধের সময় তিনি ছদ্মবেশে গুপ্তচরের কাজ করতেন। একাত্তরের মে মাসে পিরোজপুরের বাগমারা কদমলী গ্রামে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং বিধবা নারী ভাগীরথীকে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে এসে পাশবিক নির্যাতনে জর্জরিত করে। এক সময় মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে পাকিস্তানি সেনাদের মন জয়ের কৌশল গ্রহণ করেন। তাতে সুবেদার সেলিম তার প্রতি নির্ভর করে প্রস্তাব দেয়, যদি ভাগীরথী গ্রামে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর এনে দিতে পারে তাহলে তাকে পুরস্কার দেওয়া হবে। ভাগীরথী এতেই সুযোগ পেয়ে যান। তিনি নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর খবর পৌঁছে দিতেন পাকিস্তানি সেনাদের। তবে সে খবর পুরোটাই ছিল বিভ্রান্তিকর। যা অনুসরণ করে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যেতো। এর প্রতিশোধ নিতে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বীরপ্রতীক তারামন বিবি, সেতারা বেগমের ত্যাগের কথাও আমাদের জানা। বীরাঙ্গনা রিজিয়া খাতুন, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী মহান মুক্তিযুদ্ধের একেক জ্বলন্ত অগ্নিকন্যা। কখনও পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন, কখনও বিহারি, কখনও বাঙালি হায়েনাদের লালসার শিকার হয়েছেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। নিজ এলাকার মানুষও তাকে ঘৃণার চোখে দেখেছে, তবু কেউ তাকে মুক্ত করতে এগিয়ে আসেনি। শিরিন বানু মিতিল, আইভি রহমান, এসএম আনোয়ারা বেগম, মালেকা বেগম, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, বাসন্তী রাণী গুহঠাকুরতা, নীলিমা ইব্রাহিম এ রকম হাজারো নারী কেন্দ্র থেকে প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাজ করে গেছেন দেশমাতাকে মুক্ত করতে। তাদের অবদান কোনো অংশেই কম নয়।
মুক্তিযুদ্ধে নারী-পুরুষ উভয়েরই অসামান্য অবদান রয়েছে। চিরঅম্লান এ নারীদের আত্মত্যাগের ইতিহাস জানার সুযোগ করে দিতে হবে এ প্রজন্মকে।