রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০

ভাষার মুক্তি ও আমাদের চেতনা
অনলাইন ডেস্ক

‘মাতৃভাষা সমাসবদ্ধ পদ, ব্যাকরণের নির্দেশ অনুযায়ী ষষ্ঠীতৎপুরুষ। অভিধানে অর্থ লেখা আছে স্বদেশের ভাষা। কিন্তু অভিধানের অর্থে সকলের চিত্ত সন্তুষ্ট হয় না। হওয়ার কথাও নয়। ভাষার স্বভাবই হলো অস্পষ্ট থাকা, অন্তরাল সৃষ্টি করা। হরবোলার কৌতুকে মেতে উঠা। ভাষা খেলা করে জিবের আগায়, ঘোষিত হয় গলার মধ্য দিয়ে। প্রাণ লাভ করে ফুসফুস থেকে। এও বাইরের সত্য। আসলে ওর জন্ম বুকের মধ্যে। উৎস মানুষের মন। মন কি কোনো নিয়মের বশ হতে চায়? একই ভাষা একজনের মুখে মধু, অন্যজনের মুখে বিষ। সকাল বেলায় কলহের হাতিয়ার, দুপুরে কর্মের বাহন, অপরাহ্ণে শান্তির, সন্ধ্যায় স্বপ্নের। আমার মাতৃভাষা বাংলা, মাত্র এইটুকু বললেই কি সবটা উত্তর সম্পূর্ণ হয়?’ বলছিলেন একুশের অমর নাটক ‘কবর’ আর ভাষা আন্দোলনের একমাত্র নাট্য দলিলের নাট্যকার মুনীর চৌধুরী।

ভাষার ক্রমবিকাশের গতি ও প্রকৃতি আলোচনা করলে সহজেই বুঝতে পারা যায়। এই বৈজ্ঞানিক সত্যটি যে শুধু জীবজগতের প্রতি প্রযোজ্য তা নয়, ভাষার ক্ষেত্রে ও এই সত্য সমভাবে প্রযোজ্য। অর্থাৎ ভাষাও বিবর্তিত হয়। এই বিবর্তনের ফলে প্রাণী জগতের মতো ভাষা জগতের ‘যোগ্যতাময় ঊর্ধ্বতন’ নীতি সুস্পষ্টভাবে অভিব্যক্ত। পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে কোনো কোনো ভুল ভাষা আজও স্বগর্বে বেঁচে আছে। পৃথিবীর এই ভাষাগুলোকে জীবিত ভাষা ও বলা হয়। বাংলা ভাষা সেই অবস্থানে পড়ে না। আমরা মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলতে যতোটুকু স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি, তা অন্য কোনো ভাষায় সম্ভব নয়। আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলা ভাষা, এ ভাষা আমাদের রক্তে কেনা।

বাঙালি জাতির রাজনৈতিক বিকাশের ইতিহাস অতীব প্রাচীন হলেও পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছায় ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ এ উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার পর। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার আগেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে বির্তক শুরু হয়। উর্দুর পক্ষে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে বাঙালির ভাষা সংগ্রামের সূত্রপাত ঘটান আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও জিয়াউদ্দিন আহমদ। তার বক্তব্যের লিখিত প্রতিবাদ জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা না উর্দু’ শিরোনামে পুস্তিকা প্রকাশ করে তমুদ্দুন মজলিস। ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাসেম ছিলেন সেই মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা।

১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর করাচিতে পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গৃহীত হওয়ায় সংবাদটি পূর্ব বাংলায় পৌঁছামাত্র দেখা দেয় এক তীব্র প্রতিক্রিয়া। এদিন দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম প্রতিবাদ সভা। সভা শেষে একটি মিছিল পূর্ব বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী থাকা নাজিম উদ্দীনের বাসভবন বর্ধমান হাউস এবং মুসলিম লীগের মুখপাত্রের অফিসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।

১৯৪৮ সালের ২ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নতুন আহ্বায়ক হন ছাত্রনেতা শামসুল আলেম। এ দিনই ঘোষণা করা হয় ১১ মার্চ দেশব্যাপী প্রতিবাদ ও সাধারণ ধর্মঘটের। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ক্ষেত্রে গণপরিষদে মুসলিম লীগ নেতাদের অবিশ্বাসের প্রতিবাদ ছিলো এ ধর্মঘট। সেভাবে পাকিস্তান গণপরিষদের ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলা ভাষা ব্যবহারের দাবি অগ্রাহ্য হওয়ার প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ঢাকা শহরের ছাত্র সমাজ ধর্মঘট, প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ মিছিলের মধ্য দিয়ে প্রথম রাষ্ট্রভাষা দিবস প্রতি পালন করে।

বাংলা ভাষার দাবি এভাবে রাজপথ জনপথে আন্দোলন ও প্রত্যক্ষ সংগ্রামের রূপ নেয়। ওইদিন ছাত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জ, ঘনঘন ফাঁকাগুলি ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ এবং ভাড়াটে গু-াদের আক্রমণে বহু ছাত্র আহত হয়। সরকারি দমন নীতির ফলে অবশ্য ছাত্ররা দমে যায়নি বা আন্দোলনে কোনো প্রকার ভাটা পড়েনি। ছাত্ররা প্রাদেশিক পরিষদ ভবনের সামনে, বর্ধমান হাউসে প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সরকারি বাসভবনে, হাইকোর্ট ও সেক্রেটারিয়েটের সামনে প্রতিদিন বিক্ষোভ প্রদর্শন অব্যাহত রাখে। এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা খাদ্যমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ আফজাল ও শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদকে তাদের পদত্যাগপত্র স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে। শেষ পর্যন্ত এই বিক্ষোভ দমন করার জন্যে সেনাবাহিনী তলব করা হয়। পূর্ব পাাকিস্তানের তদানীন্তন জিওসি ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খানের নির্দেশে মেজর পীরজাদা একদল পদাতিক সৈন্য নিয়ে ছাত্র দ্বারা ঘেরাও পরিষদ ভবন থেকে খাজা নাজিমুদ্দীনকে পশ্চাৎ দ্বারা এবং বাবুর্চি খানার মধ্য দিয়ে বাইরে পাচার করে।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন প্রত্যক্ষ সংগ্রামের রূপ নেয় ১৯৪৭ সালের ১১ মার্চ। আন্দোলন প্রথম সপ্তাহেই এমন ব্যাপকতা লাভ করে যে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ১৫ মার্চ তারিখে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। সেই চুক্তিপত্রে থাকে-‘২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ হইতে বাংলা ভাষার প্রশ্নে যাহাদিগকে গ্রেফতার করা হইয়াছে তাহাদিগকে অবিলম্বে মুক্তি দান করা হইবে। আন্দোলনে যাহারা অংশগ্রহণ করিয়াছে তাহাদের কাহারও বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে না। সংবাদপত্রের উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হইবে। ২৯ ফেব্রুয়ারি হইতে পূর্ব বাংলার যে সকল স্থানে ভাষা আন্দোলনের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হইয়াছে সেখান হইতে তাহা প্রত্যাহার করা হইবে। ১৯৪৮ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পূর্ব বাংলা সরকারের ব্যবস্থাপক সভায় বেসরকারি আলোচনার জন্য যে দিন নির্ধারিত হইয়াছে সেই দিন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার এবং তাহাকে পাকিস্তান পরিষদ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পরীক্ষা দিতে উর্দুর সমমর্যাদা দানের জন্য একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে।’

এ চুক্তির কারণে বাংলা ভাষা আন্দোলন দমন করার জন্য সরকারি দমন নীতির তথা গ্রেফতার, ১৪৪ ধারা জারি বাংলা ভাষা আন্দোলনকে রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত আখ্যাদানের পরোক্ষ স্বীকৃতি পাওয়া।

ওই চুক্তিপত্রটি স্বাক্ষরিত হওয়ার আগে সংগ্রাম পরিষদের মুক্ত নেতারা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে বন্দী ছাত্রনেতা শামসুল হক, শওকত আলি, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুব ও শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখিয়ে চুক্তিপত্রটি অনুমোদন করিয়ে নিয়ে আসেন। ১৫ মার্চ সন্ধ্যায় বন্দী ছাত্রদের মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু আন্দোলন অব্যাহত থাকে। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ জিন্নাহ ঢাকার রমনার ঘোড়দৌড় ময়দানে এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতা দেন। রাষ্টভাষা সম্পর্কে ঘোষণা করেন-‘এটা আপনাদের কাছে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অপর কোন ভাষা নয়। যদি আপনাদের কেউ বিভ্রান্ত করার চেষ্ট করে সে হবে পাকিস্তানের প্রকৃত শত্রু। একটি রাষ্ট্রভাষা ছাড়া কোন জাতিই দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ ও টিকে থাকতে পারে না। ...সুতরাং রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারে উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’

২৪ মার্চ কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তনী ভাষণে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আবারও সেই বক্তব্য পেশ করেন। পাকিস্তানের জনক কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ওই ঘোষণা সভা ও সমাবর্তনে উপস্থিত ছাত্রদের প্রতিবাদ সূচক ‘না’ ধ্বনি দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলো। ২৪ মার্চ ভাষা আন্দোলনের নেতা শামসুল হক, কামরুদ্দীন আহমদ, আবুল কাসেম, তাজউদ্দীন আহমদ, নইমুদ্দীন আহমদ, শামসুল আলম, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও অলি আহাদ সমন্বয়ে গঠিত রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের একটি দল জিন্নাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে এই স্মারকলিপি দেন। জিন্নাহ এই দাবি অগ্রাহ্য করে।

১৯৪৯ সালের ১২ মার্চ পাকিস্তান গণপরিষদের শাসনতান্ত্রিক মূল নীতি-নির্ধারণ কমিটি গঠিত হয়েছিলো। ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৫০ সালে পেশকৃত ওই কমিটির রিপোর্টে উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ ছিলো। সেদিন মূল নীতি-নির্ধারণ কমিটির অগণতান্ত্রিক এবং পূর্ব বাংলার প্রতি বৈষম্যমূলক রিপোর্ট পূর্ব বাংলার মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছিলো। ১৯৫০ সালের ৪ ও ৫ নভেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত গঠনতন্ত্র সম্পর্কিত এক জাতীয় মহাসম্মেলনে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের জন্যে যে পাল্টা সুপারিশসমূহ পেশ করা হয় তাতে বলা হয়েছিলো। ‘পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা এবং উর্দু।’

১৯৫১ সালের ১৬ ও ১৭ মার্চ কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষকদের সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আহ্বান জানান, কারণ তা তার মতে বাঙালিদের গণহত্যার শামিল। ’৫২-এর ৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। এরপর ১১ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি সাফল্যের সঙ্গে পতাকা দিবস পালন করা হয়। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবি সম্মলিত ব্যাজ বিক্রয় আর ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের জন্যে অর্থ সংগ্রহে নামে ২১ ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘটের প্রস্তুতি চলে নিরবচ্ছিন্নভাবে। বাংলার মুসলমানরা যে শক্তি নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো সেই পাকিস্তান যখন এক দিবাস্বপ্নে পরিণত হলো তখন তারা নিজেদের অধিকার আদায় করে নিতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে। বাঙালি তার অন্ধবিশ্বাসের মোহ থেকে মুক্ত হয়েছে পাক সরকারের নিপীড়নে। একুশে ফেব্রুয়ারি ছিলো পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ সরকারের বাজেট অধিবেশন। জনতার আন্দোলনে ভীত সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মাসের জন্যে ঢাকা জেলাতে ধর্মঘট, সভা ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে।

সরকারের এ হটকারী নির্দেশ সমগ্র ঢাকায়, প্রবল বিক্ষোভের সঞ্চার হয়। এ সময় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের জরুরি সভায় সিদ্ধান্ত হয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আন্দোলন চালু রাখার। তবে এর মধ্যে বিরোধিতাও করে কেউ কেউ। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সব স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা বিচ্ছিন্নভাবে এসে জড়ো হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। গাজীউল হকের সভাপ্রধানে এক সভা শুরু হয়। রাষ্ট্রভাষা কমিটির আহ্বায়ক আবদুল মতিন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার বিষয়ে চূড়ান্ত দায়িত্ব ছেড়ে দেয় ছাত্রদের হাতে। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নেয়।

সভা থেকে ১০ জন করে দল গঠন করে মিছিল নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে কলা ভবনের গেট দিয়ে বের হতে থাকে। এ সময় পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে ও গণগ্রেফতার শুরু করে। প্রায় ২ ঘণ্টা এমন হওয়ার পর ছাত্ররাও ইটপাটকেল ছুড়ে পুলিশের মোকাবেলা করে। পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই আবদুল জব্বার ও রফিক উদ্দিন আহমদ শহীদ হন। আহত হন অনেকে। আহতদের মধ্য থেকে রাত ৮টায় শহীদ হন আবুল বরকত। সে ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র। ২২ তারিখে গায়েবানা জানাজার পর প্রতিবাদ মিছিল শুরু হলে সেখানেও পুলিশের গুলিবর্ষণ হয়। তখন শহীদ হন শফিউর রহমান। ২৩ তারিখে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের পাশে নিজেরাই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলে।

১৯৫৬ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হয়। পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা স্বীকৃতি লাভ করে। এতো আন্দোলন-সংগ্রাম ও প্রাণের বিনিময়ে অর্জন করা বাংলা ভাষা আজ সেই আসন রক্ষা করতে পারছে না ভীনদেশি ভাষার জন্যে। সেই সব ভাষাসৈনিকরা আজও হতাশা করে বলে এমনটা আমরা চাইনি। ভাষা নিয়ে কাজ চলছে তবে খুব ধীরগতিতে। বাংলা একাডেমির আরো সচল হওয়ার জন্যেও পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু সব যেনো কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। এতো বছর পর স্বীকৃতি পাওয়া বাংলা ভাষা এ অবস্থায় থাকবে তা কেউ ভাবেনি। স্বাধীন দেশের সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা থাকা সত্ত্বেও সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন হচ্ছে না। অফিস-আদালত স্কুলগুলোতে মাতৃভাষার প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ পাচ্ছে না। গণমাধ্যম থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপন বিলবোর্ড থেকে চাকরি নির্বাচন-সবক্ষেত্রে বিশুদ্ধ বাংলা আর বাংলা ইংরেজির মিশ্রণ আমাদের চেতনার মাঝে আঘাত আনলেও সচেতন হচ্ছে না কেউই।

ভাষার মাস আসলেই যেনো বাঙালি তার বাংলা রূপধারণ করে। ... উপরে বাংলা বর্ণমালার কথা বলে অথচ এই ভাষা নিয়ে স্লোগান বা সমাবেশে ইংরেজি উচ্চারণ করে। এ যেনো আমাদের অস্তিত্বের মাঝে আঘাত করা। বাংলা মায়ের ভাষা, মাতৃভাষা বিশ্বের মাঝে স্বীকৃতি পাওয়া ভাষার অবমূল্যায়ন হবে না। যথাযথ প্রচার ও ব্যবহার হবে সবখানে। ভাষা যেভাবে মুক্তি পেয়েছে সেভাবে চেতনাকে অক্ষুণ্ন রেখে মুক্তির স্বাদ গ্রহণ করবে বাঙালি আর সমুন্নত রাখবে মাতৃভাষার সব অহঙ্কারকে।

লেখক : সাহিত্যিক কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়