প্রকাশ : ১০ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে ভালো কাজ করা সম্ভব নয়; আমি কখনোই এই কথার সঙ্গে একমত ছিলাম না। বরং আমি সব সময় মনে করি, ফেসবুকের মতো জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে ভালো কাজকে দ্রুত সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব। প্রতিটি জিনিসেরই ভালো এবং মন্দ দুটি দিক রয়েছে। তাই আমরা যখন কোনো মাধ্যমকে ভালো কাজের জন্যে ব্যবহার করে থাকি, তখন তা সকলের জন্যেই কল্যাণকর হয়ে ওঠে। ফেসবুকের বদৌলতেই জানতে পারি, খুলনা শহরে মুনতাসীর মামুন নামের এক ভদ্রলোক নিজের বাড়ির সামনে বাচ্চাদের বই পড়ার জন্যে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি স্থাপন করেছেন। শুধু তাই নয়, বাচ্চারা যাতে বই পড়ার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে, সেজন্যে পড়া শেষ হলে প্রতিটি বইয়ের জন্যে বাচ্চাদের উপহার হিসেবে অর্থও দিয়ে থাকেন তিনি! বিষয়টি জানতে পেরে আমি মুনতাসীর মামুনের এই কাজটিকে সচক্ষে দেখার জন্য বেশ আগ্রহ অনুভব করি। সুযোগটাও এবার হয়ে গেলো।
আমাকে প্রায়ই খুলনা শহরে আসতে হয়। এবার এখানে এসেই ওনার সঙ্গে মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করি। উনি আমাকে বিস্তারিত ঠিকানা জানালেন এবং সহজ যোগাযোগের জন্যে মোবাইল নাম্বারও দিলেন। একেবারে পড়ন্ত বিকেলে মুজগুন্নি আবাসিক এলাকায় মুনতাসীর মামুনের বাড়ির সামনে; যেখানে উনি বই নিয়ে বসেন, সেখানে গিয়ে হাজির হলাম। একইসঙ্গে দুটি দৃশ্য নজরে পড়লো আমার। রাস্তার একদিকে খোলা মাঠ। ওখানে ছেলেরা মহানন্দে ক্রিকেট খেলছে। শরীরকে ফিট রাখতে খেলাধুলার কোনো বিকল্প নেই। নিঃসন্দেহে এটা ভালো কাজ। রাস্তার অপর দিকের দৃশ্যটা দেখার জন্যেই মূলত আমি এখানে এসেছি। একটি টেবিলের ওপর ছড়ানো রয়েছে বই। পাঁচ-ছয়টা ছেলেমেয়ে বই উল্টেপাল্টে দেখছে। ওরা সবাই মুনতাসীর মামুনের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি থেকে বই নিতে এসেছে।
মামুন ভাই তখন ওখানে ছিলেন না। কয়েক মিনিট পরই উনি বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন; হাতে আরও বই। আজকাল বাচ্চারা নতুন নতুন বই চায়। বুঝতে পারলাম, ওদের আবদার মেটাতে বেশ পরিশ্রম করা লাগে। আমি একটি চেয়ার নিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। ছোট ছোট বাচ্চারা কী আগ্রহ নিয়ে বইগুলো দেখছে! আর কেউ যদি তার পছন্দসই কোনো বই পেয়ে যায়, তাহলে তার চোখেমুখে খুশির ঝিলিক স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সবাই এসে পুরানো বই ফেরত দিয়ে খুঁজে খুঁজে নতুন বই বগলদাবা করে নিয়ে যাচ্ছে। তারমানে এরা সবাই পুরানো পাঠক। মামুন ভাই জানালেন, প্রতিদিন ছোট ও বড় পাঠক মিলিয়ে প্রায় ৪০-৫০ জন বই নিয়ে যায়। ছোট্ট এই জায়গাটার জন্যে এই সংখ্যা একেবারে কম নয়। বাচ্চাদের বই পাঠের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে তিনি যে সকল অভিনব পদ্ধতি বের করেছেন, এটা সম্ভবত তারই সুফল।
খ.
শিশুদের প্রতি ভালোবাসা জানানো একজন বিবেকবান মানুষের জন্যে অপরিহার্য। অনেকভাবেই এই কাজটি করা সম্ভব। তবে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো, তাদের ভালো কাজের প্রতি উৎসাহিত করা; সমাজের ও নিজের জন্যে উপকারী কোনো কাজে লাগিয়ে দেয়া। বই পড়া হলো সবচেয়ে ভালো কাজের মধ্যে একটি। এই কাজটির প্রতি শিশুদের আগ্রহী করে তুলতেই নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন মুনতাসির মামুন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়াশোনা করে তিনি এখন খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ)-তে কর্মরত। সুতরাং তিনি যে একজন ব্যস্ত মানুষ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই সীমাহীন ব্যস্ততার মধ্য থেকেও শিশুদের জন্য কিছু কাজ করা, তাদের সঙ্গে বিকেলের এই সময়টুকু কাটাতে পারা নিঃসন্দেহে অনেক কষ্টের এবং গৌরবের। তিনি নিজস্ব চিন্তায় একটি সহজ পদ্ধতিও বের করেছেন শিশুদের নানামুখী ধ্বংসাত্মক প্রবণতা থেকে বইয়ের কাছে টেনে আনতে। আমি দেখলাম, তিনি বই ফেরত দেয়ার পর শিশুদের হাতে টাকা তুলে দিচ্ছেন। জিগ্যেস করলাম, তাদের কীভাবে টাকা দেয়ার কাজটি করেন? মুনতাসীর মামুন আমাকে জানালেন, কেউ যদি ১০০ পৃষ্ঠার কম কোনো বই পড়তে পারে, তাহলে তার জন্য বরাদ্দ থাকে পাঁচ টাকা; আর কেউ যদি এরচেয়ে মোটা বই পড়ে ফেলতে পারে, তাহলে সে পায় দশ টাকা। এখন কোনো বাচ্চা যদি এই টাকার লোভেও বই পড়া শুরু করে, তাহলে অবশ্যই একটা সময়ে এসে বইয়ের প্রতি তার ভালোবাসা পোক্ত হয়ে উঠবে। আর এভাবেই একদিন সে সত্যিকারের বইপ্রেমিক হিসেবে গড়ে উঠবে।
বর্তমান সময়ে এসে পড়াশোনার জন্যে বই অনেক সহজলভ্য হয়েছে নিঃসন্দেহে। আমরা যখন ছোট ছিলাম, পড়ার জন্য কোনো বই ছিল না হাতের নাগালে। এলাকায় কোনো লাইব্রেরি ছিল না। স্কুলের লাইব্রেরিতে সামান্য যে কয়েকটি বই ছিল, সেগুলোও এনে পড়ার তেমন উপায় ছিল না। একদিকে যেমন বই পাওয়া কঠিন ছিল, অপরদিকে পরিবার থেকেও পাঠ্যবইয়ের বাইরে সৃজনশীল কোনো বই কিনে দেয়ার সামর্থ্য ছিল না। তাই সে সময় অনুভব করতাম, ইশ! যদি কোনো লাইব্রেরি থেকে বই এনে পড়তে পারতাম! আশার কথা হলো, এখন দেশের প্রায় সকল জায়গাতেই লাইব্রেরি গড়ে উঠছে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই রয়েছে নিজস্ব লাইব্রেরি। তাছাড়া মানুষ এখন পূর্বের চেয়ে সচেতন হয়েছে। সবাই অনুভব করতে শুরু করেছে, শুধুমাত্র ক্লাসের বই পড়েই একজন শিক্ষার্থী নিজেকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে সমর্থ হয় না। তাই প্রচুর পরিমাণ ভালো মানের বইপুস্তক পড়া প্রয়োজন। অভিভাবকদের চিন্তায় ইতিবাচক পরিবর্তন এলেও শিশুরা এখন পড়াশোনার চেয়ে ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়েই বেশি ব্যস্ত। তাই তাদেরকে বইয়ের কাছে টেনে আনা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিরাট চ্যালেঞ্জের বিষয়। মুনতাসির মামুন যে পরিকল্পনা করেছেন, তাতে এই সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়েছে। সুতরাং এই পক্রিয়াকে সমাজের সকল স্তরে ছড়িয়ে দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
গ.
একজন মানুষের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আসলে কী? সে শুধু নিজে খেয়ে-পরে সুখে-শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করবে এরকম কিছু? আমরা যারা নিজেদের সামাজিক জীব হিসেবে মনে করি, তাদের চিন্তা কিন্তু একেবারে এমন সরল নয়। শুধুমাত্র নিজে ভালোভাবে জীবন অতিবাহিত করাকেই ভালো থাকা বলে না; নিজেদের পাশাপাশি যদি সমাজের আর দশজন মানুষকে ভালো রাখা না যায়, তাদের দুর্দিনে পাশে থাকা না যায়, তাহলে তাকে কি ভালো থাকা বলা যেতে পারে? হয়ত আমাদের সমাজে এরকম দু-একজন আত্মকেন্দ্রিক মানুষ থাকতে পারে। তবে মোটের ওপর সবাই-ই চেষ্টা করেন, মানুষের জন্য কিছু করতে। এই প্রচেষ্টা থেকেই নানান ধরনের সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে উঠেছে। দেশের কোনো প্রান্তে যদি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা বিপর্যয় দেখা দেয়, খেয়াল করে দেখবেন, একদল তরুণ সেখানে বাজপাখির মতো ছুটে গেছে। এই কাজটি তারা নিজেদের দায়িত্ববোধ থেকেই করে থাকে; কেউ তাদের ওপর এটি চাপিয়ে দেয়নি। আবার অনেকেই নিজেদের অর্থ এবং সময় ব্যয় করেন অকুণ্ঠচিত্তে। এই কাজ থেকে কেউ কোনো প্রতিদান আশা করেন না। আপনি কীভাবে একে মূল্যায়ন করবেন?
একটি সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে হলে এর তরুণ প্রজন্মকে জ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করে গড়ে তুলতে হয়। জ্ঞান এমনই এক সম্পদ, যা একটি জনগোষ্ঠীকে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে আসতে পারে। পৃথিবীর প্রতিটি সভ্যতার অগ্রগতির পেছনের গল্প অনুসন্ধান করতে গেলে এই সত্যটিই আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। আজকে যে রাষ্ট্রগুলো নিজেদের উন্নত ও সুসংহত হিসেবে গড়ে তুলেছে, তারাও জ্ঞানের কদর করেই এ পর্যন্ত এসেছে। তাই সভ্য জাতি গঠনে জ্ঞানের অপরিহার্যতার কথা কেউই অস্বীকার করে না। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই প্রজন্মের মধ্যে জ্ঞানের প্রতি তেমন কোনো আগ্রহ নেই। হতে পারে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই এই সমস্যার বীজ লুকিয়ে আছে। ছোটবেলা থেকেই শিশুদের ওপর বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়া কোনো বুদ্ধিমান জাতির কাজ নয়। তাই আমাদের সমস্যার শেকড় বের করে তার সমাধানের দিকে নজর দিতে হবে। জ্ঞানের যে সুবিশাল সাম্রাজ্য, তাতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে যে কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে, তারমধ্যে বইপড়া সবচেয়ে কার্যকরী। বইয়ের পাতায় দুনিয়ার সমস্ত জ্ঞানের কথা লিপিবদ্ধ করা আছে। একজন অনুসন্ধানী পাঠক সহজেই তার জ্ঞানের তৃষ্ণা বইয়ের কাছে এসে মেটাতে পারে।
ঘ.
বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি নানান ধরনের সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে কাজ করেছি। বই নিয়ে কাজ করে, এ রকম সংগঠনের সঙ্গেও আমার ওঠাবসা রয়েছে। আমি দেখেছি, যারা বই পড়ে এবং যারা পড়ে না, তাদের মধ্যে বেশ বড়সড় একটি ফারাক রয়েছে। একজন বইপড়ুয়ার আচরণ ও চলাফেরাই এই বাস্তবতাকে প্রমাণ করার জন্যে যথেষ্ট। আরেকটি বিষয় আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি, যারা নিজেদের সময়, অর্থ ও শ্রম ব্যয় করে মানুষের জন্যে সামান্য হলেও কিছু করার চেষ্টা করেন, সাধারণ মানুষ তাদের প্রচ- ভালোবাসে। এই ভালোবাসার গভীরতা এতোটাই বেশি যে কেউ তা অনুমান করতেও পারবে না।
খুলনার মুনতাসীর মামুনও ঠিক এই কাজটিই করে চলেছেন। অফিস থেকে ফিরেই তিনি চলে আসেন তার বইপত্র নিয়ে। শিশুরা এসে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে বই নেয়ার জন্যে। বড়োরাও তাদের পছন্দমতো বই এখান থেকে নিতে পারেন। বেশ কিছুক্ষণ আমি সেখানে অবস্থান করেছি। আমি দেখেছি, বাচ্চারা তাকে কী পরিমাণ সম্মান করে! সত্যিই অভিভূত হওয়ার মতো। কোনো শিশু যদি আপনাকে সত্যিকারে ভালো না বাসে, তাহলে যে কোনো অযুহাতে এড়িয়ে চলবে। কিন্তু এখানে ব্যতিক্রম দেখলাম। কারণ, এই বই লেনদেনের সম্পর্ক। শিশুরা জানে, এখানে গেলে ভালোবাসা পাওয়া যাবে। তাই তারা সবকিছু ফেলে ছুটে আসে। বিকেলের এই সময়টুকু তাদের আনাগোনায় মুখরিত থাকে চারপাশ। মুনতাসীর মামুনের এই পথচলায় অনেকেই তাকে সহায়তা করেন। কেউ বই পাঠিয়ে, কেউ অর্থ পাঠিয়ে তার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এটাও সম্ভব হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তথা ফেসবুকের কল্যাণে।
ঙ.
সমাজকে এগিয়ে নিতে হলে নানা দিক দিয়ে কাজ করে যেতে হয়। আমি নিজে একজন বইপাগল মানুষ। তাই বই নিয়ে কেউ যখন ভালো কোনো কাজ করে, তাকে অন্তর থেকে ধন্যবাদ দিই এবং সম্ভব হলে সশরীরে গিয়ে উৎসাহ প্রদান করি। সাম্প্রতিক সময়ে এ রকম আরও কয়েকটি জায়গায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও কিছু তরুণ নিজেদের উদ্যোগে এগিয়ে এসেছেন। এই তরুণেরা আমাদের সম্পদ। তারা কোনোপ্রকার লাভের হিসাব না করেই এই কাজে এগিয়ে এসেছেন। লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যারা সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন, আমি তাদের মন থেকে অভিবাদন জানাই।