প্রকাশ : ০৭ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
বাংলাদেশী মেধাবীদের পদচারণা
ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ৪ জন বাংলাদেশিকে অন্তর্ভুক্ত করায় দেশে-বিদেশে সব বাংলাদেশি হয়েছেন উচ্ছ্বসিত, গর্বিত হয়েছে বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আগামীদিনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশি-আমেরিকান প্রজন্মের এক নতুন অধ্যায় রচিত হলো। বাইডেন প্রশাসনে যে ৪ জন নিয়োগ পেয়েছেন তারা হলেন কাজী সাবিল আহমদ, রোমানা আহমেদ, ফারাহ আহমেদ এবং জাইন সিদ্দিকী। কাজী সাবিল আহমদ (৩৮) হোয়াইট হাউজের এক্সিকিউটিভ অফিসের ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড বাজেট বিভাগে ইনফরমেশন অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্সের সিনিয়র কাউন্সিলর পদে যোগ দিয়েছেন। তিনি ব্রুকলিন ল’ স্কুলের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ছাড়াও ‘ডেমজ’ নামক একটি থিংক ট্যাংকের প্রেসিডেন্ট। রোমানা আহমেদ বাইডেনের ইউএস এজেন্সি ফর গ্লোবাল ইনফরমেশনের রিভিউ প্যানেলের সদস্য পদে যোগদান করেন। ইতিপূর্বে তিনি বাইডেনের ট্রানজিশন টিমের আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দলে এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময়ে হোয়াইট হাউজে কাজ করেছেন। রোমানা জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। নরসিংদীর মেয়ে ফারাহ আহমেদ কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে আন্ডার সেক্রেটারির চিফ অব স্টাফ পদে নিয়োগ পান। তিনি কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যাচেলর এবং নিউজার্সির প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেন এবং ইউএসডিএতেও কাজ করেছেন। তার বাবা-মা দুজনই যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইলের জেইন সিদ্দিক হোয়াইট হাউজের ডেপুটি চিফ অব স্টাফের সিনিয়র অ্যাডভাইজার হয়েছেন। তিনি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি ও ইয়েল ল’ স্কুল থেকে উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত। বাইডেন-কমালা ট্র্যানজিশন টিমে ডমেস্টিক অ্যান্ড ইকোনমিক বিভাগের চিফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায়ই এ নিয়োগ পেলেন জেইন। তার বাবা-মা দুজনই নিউ ইয়র্কের চিকিৎসক।
শিক্ষা, শিক্ষকতা ও গবেষণায়ও বাংলাদেশিদের সুনাম আকাশচুম্বী। ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার ১৯তম ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে বর্তমানে কর্মরত আছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় প্রকৌশলী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. অমিত চাকমা। তিনি কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিও’র প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের এক চাকমা পরিবারে এই অধ্যাপকের জন্ম। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় র্কর্তৃক বিশ্বের সেরা ২% বিজ্ঞানীদের একটি তালিকা প্রকাশিত হয়, যেখানে ১,৫৯,৬৮৩ জন বিজ্ঞানীদের মধ্যে ২৬ জন বাংলাদেশি আছেন। এছাড়া উচ্চ শিক্ষার্থে (মাস্টার্স বা পিএইচডি) করতে আসা ৯০% পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করে, কেউ কেউ ইউনিভার্সিটির টিচার হন। আইটি ফিল্ডে বাংলাদেশিদের অবস্থান আরও ঈর্ষণীয়। ভারতীয় এবং চীনাদেও পরেই বাংলাদেশিদের অবস্থান। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং হসপিটালে এখনো বাংলাদেশি অনেক প্রফেসর এবং ডাক্তার অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন।
প্রশাসনিক ও অন্যান্য কাজেও বাংলাদেশিরা অত্যন্ত দক্ষ এবং অভিজ্ঞ। নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার হিসেবে এনওয়াইপিডিতে গোয়েন্দা স্কোয়াডে যুক্ত হয়ে ইতিহাস গড়েছেন সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জের শামসুল হক। তিনি ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে এনওয়াইপিডিতে যোগদান করেন এবং ২০১০ সালে সার্জেন্ট পদে পদোন্নতি পান। ২০১৪ সালে লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি পাওয়ার পর তিনি এনওয়াইপিডির অভ্যন্তরীণ বিষয়ক তদন্ত দলের দায়িত্ব নেন। এদিকে চট্টগ্রামের ছেলে মহম্মদ আরমান কায়সার (৩২) প্রথম বাংলাদেশি-আমেরিকান হিসেবে আটলান্টিক সিটির পুলিশ বিভাগে সার্জেন্ট পদে আছেন । এর আগে ২০১২ সালে তিনি আটলান্টা সিটির পুলিশ বিভাগে অফিসার পদে যোগ দেন। জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পেশাগত দক্ষতা, আন্তরিকতা, নিরপেক্ষতা, সততা, মানবিক আচরণ ও কর্তব্যপরায়ণতা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। বর্তমানে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশ অন্যতম বৃহৎ শান্তিরক্ষী জোগানদাতা দেশ। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের শ্রমিকরা বেশি পরিশ্রম করেও অন্যান্য দেশের তুলনায় কম বেতন পেয়ে থাকেন। তবুও সেসব দেশে বাংলাদেশি শ্রমিকদের পরিশ্রম ও নিষ্ঠার কারণে কদর বেশি। আমেরিকা ও কানাডায় বাঙালি ট্যাক্সি ড্রাইভারদের সততার কথা কে না জানে? ভুলে ফেলে যাওয়া ব্যাগ ভর্তি টাকা মালিকের কাছে ফেরত দেয়ার নজির আছে বাঙালিদের।
রাজনীতি এবং গণতান্ত্রিকভাবেও বাংলাদেশিদের অবস্থান ঈর্ষণীয়। ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনে লেবার পার্টি থেকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিকী, রূপা আশা হক ও রুশনারা আলীর এমপি নির্বাচিত হওয়ার খবর সবারই জানা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি ও শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক (৩২) লেবার পার্টি থেকে লন্ডনের হ্যামস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসনের এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি রিজেন্ট পার্কের সাবেক কাউন্সিল এবং ২০১০ সালে ক্যামডেন কাউন্সিলের প্রথম বাঙালি নারী কাউন্সিলর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। রূপা আশা হক (৪৩) ব্রিটিশ পার্লামেন্টে লন্ডনের ইলিং সেন্ট্রাল অ্যান্ড অ্যাকটন আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। কিংস্টন ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞান বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক রূপা হক ইংরেজি লেখক ও কলামিস্ট হিসেবেও পরিচিত। তিনি ইলিংয়ের লন্ডন বরোর ডেপুটি মেয়র পদেও দায়িত্ব পালন করেন। এদিকে লেবার পার্টি থেকে দ্বিতীয়বারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়েছেন আরেক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রুশনারা আলী (৪৬)। এর আগে ২০১০ সালেও বেথনাল-গ্রিন-অ্যান্ড-বো আসন থেকে তিনি এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
গাজীপুরের কাপাসিয়ার কৌশিক রাব্বানী খান ফ্রান্সে দ্বিতীয়বারের মতো কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। প্যারিস সীমান্ত এলাকার স্ট্যাইন পৌর নির্বাচনে তিনি জয়ী হয়ে প্রবাসী বাংলাদেশির মধ্যে এক ধরনের উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করেন। এর আগে শারমিন আবদুল্লাহ নামের এক প্রবাসী প্রথমবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন বলে জানা গেছে। সিলেটের মৌলভীবাজার জেলায় ডলি বেগম কানাডার ইতিহাসে প্রথম বাংলাদেশি যিনি প্রাদেশিক নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। এদিকে সুইজারল্যান্ডের পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ব্যাসেল সিটি থেকে সিভিপি পার্টির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন কুমিল্লার লাকসামের আনোয়ার হোসেন।
বাঙালির মেধা, মনন ও সংস্কৃতির ইতিহাস বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এবং প্রশংসিত। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে অভূতপূর্ব অগ্রগতি, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, মাথাপিছু আয় ২০০০ ডলারের বেশি, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু তৈরি এবং মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট পৃথিবীর মানচিত্রে আজ দৃশ্যমান। বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত ধান, পাট, ইক্ষু, চা, রেশম, তুলা, বনজ এবং মৎস্যসম্পদের পেটেন্টও বিশ্বে তালিকাভুক্ত। সর্বশেষ করোনা ভ্যাকসিন তৈরিতেও দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের অংশগ্রহণ এবং অবদান। এই সুনাম, সুখ্যাতি, মর্যাদা এবং সাফল্যের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে আমাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকতে হবে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি ও কূটনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বাঙালি জাতি আন্তর্জাতিক পরিম-লে আরও গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হবে, বাংলাদেশের অর্জন, দক্ষতা, সক্ষমতা এবং গৌরবগাথা ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিশ্ববাসী জানবে এবং শিখবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, অধ্যাপক ও পরিচালক আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।