প্রকাশ : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০
অন্যের চরকায় তেল দেয়ার বাতিক
মাহফুজুর রহমান মানিক
অন্যের বিষয়ে নাক গলাতে আমরা অনেকেই সিদ্ধহস্ত। একনজর দেখেই মন্তব্য করার মতো বিশেষজ্ঞ সমাজে কম নেই। সহপাঠীকে ভালোভাবে ডাকার মতো বন্ধুর সংখ্যা যেন বিরল। অনেক শিক্ষকও শিক্ষার্থীকে সম্বোধন করে যে ‘বডি শেমিং’ করে ফেলছেন, সে হুঁশও নেই। খোশগল্পে সুযোগ পেলেই অনেক সময় কাউকে আকাশে উঠাচ্ছি, আবার কাউকে জমিনে আছড়ে ফেলছি। পরচর্চায় বাঙালির মুনশিয়ানা বলে কথা।
কারও থেকেই যেন নিস্তার নেই। কোনোভাবেই যেন রেহাই নেই। শারীরিকভাবে লম্বা হলে তো কথাই নেই। খাটো হলেও কথা শুনতে হবে। মোটা হলেও উপদেশের বান আপনার দিকে ধেয়ে আসবে। চিকন হলেও সমস্যা। কালো হওয়ার বিপদ ভুক্তভোগীরাই জানেন। আর সুন্দরী হলেও মাপ নেই। আমরা চিন্তাও করতে পারি না, অপরের দিকে মুখনিঃসৃত যে শব্দ বেরিয়ে যাচ্ছে তার প্রতিক্রিয়া কতটা ভয়াবহ হতে পারে।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ১৬ বছরের কিশোর আজওয়াদ আহনাফ করিমের মৃত্যুর খবর আমরা দেখেছি। এমন অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু আমাদের হতবাক করেছে। ‘বডি শেমিং’ কার জন্যে কতটা যন্ত্রণার, আজওয়াদের দুঃখজনক মৃত্যুই তার প্রমাণ। আজওয়াদের মৃত্যুর খবর মূলধারার সংবাদমাধ্যমেও এসেছে। বয়সের তুলনায় তার ওজন বেশি ছিল বলে সহপাঠী এবং স্কুলের শিক্ষকদেরও কেউ কেউ তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করতেন। হয়তো আরও অনেকেই তাকে নিয়ে ঠাট্টা করতেন। কিশোর আজওয়াদ তা মেনে নিতে পারেনি। তাই কাউকে না বলে মনোকষ্টে নিজেই অনলাইন ঘেঁটে ওজন কমানোর ফর্মুলা বের করেছে। খাবার নিয়ন্ত্রণ এবং একইসঙ্গে অতিরিক্ত ব্যায়ামে তার ওজন কমেছে বটে কিন্তু ততদিনে অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা নামক অসুখে পড়ে জাওয়াদ। অবশেষে জুনের শেষ সপ্তাহে রাজধানীর একটি হাসপাতালে ছেলেটি মারা যায়।
‘বডি শেমিং’-এর শিকার আমরা কমবেশি সবাই। অধিকাংশই এর মধ্য দিয়েই বড় হই। কেউ তা গায়েই মাখে না, কেউ হয়তো তৎক্ষণাৎ মন খারাপ করে পরে আবার ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু অনেকেই যে বিষয়টি নিয়ে মানসিকভাবে কষ্টে থাকেন তা বলাই বাহুল্য। বিশেষ করে আমরা এতটাই নাছোড়বান্দা যে, অনেকের বয়সের কথাও মাথায় থাকে না। একটি শিশু সারাক্ষণ যদি একই অভিযোগ একাধিকজনের কাছে বারবার শোনে, স্বাভাবিকভাবেই তার খারাপ লাগবে। খুব ছোট হলে হয়তো মা-বাবাকে বলবে। কিন্তু আজওয়াদের মতো টিনএজ বয়স যাদের, নাজুক এ সময়টিতে কিশোর-কিশোরীদের সেভাবেই দেখা উচিত। তাদের আত্মসম্মানবোধে লাগলে কাউকে কিছু না বলে হুট করে খারাপ কিছু করে ফেলতে পারে।
মানুষের আকার, রং, গঠন প্রকৃতিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার হাত নেই। প্রকৃতিগতভাবে কেউ সুন্দর, কেউ কালো, লম্বা কিংবা বেঁটে। চিকন বা মোটা হওয়াও অনেকাংশেই ব্যক্তির আয়ত্তের বাইরে। হয়তো তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় কিন্তু সবসময় চাইলেও সম্ভব হয় না। কারও ভেতরকার অসুস্থতার কথা আমরা জানি না। তারপরও কাউকে মন্তব্য করতে ছাড়ি না। নিজের চরকায় তেল না দিয়ে কেন আমরা অন্যেরটা নিয়ে নাচানাচি করি? খুব মোটা, খুব চিকন কিংবা কালো কেউ আমার কাছে থাকলে আমরা তো সমস্যা নেই। সে যদি আমার মাথাব্যথার কারণ না হয়, আমি কেন তাকে উপহাস করব? খুব কাছের কেউ না হলে, গায়ে পড়ে অন্যকে উপদেশ দেওয়াও মানায় না।
আমরা যারা অন্যকে দেখলেই মন্তব্য করার জন্য উঠেপড়ে লাগি, তারা কি কখনও নিজেদের দিকে তাকিয়েছি? হিসাব করে দেখুন, আপনাকে নিয়েও মন্তব্য করার বিষয়ের হয়তো অভাব নেই। সে বিষয় নিয়ে কেউ অযাচিত মন্তব্য করলে আপনার কেমন লাগবে? আমরা কেউই শতভাগ পরিপূর্ণ নই। আমাদের কোনো না কোনো দিকে অপূর্ণতা থাকবে, এটাই প্রকৃতির নিয়ম। এটাই মানুষের বৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্যকে সম্মান করা মানে নিজেকেই সম্মান করা।
কারও সম্মুখে ‘বডি শেমিং’ করলে যেমন ব্যক্তি কষ্ট পেতে পারে, তেমনি কারও পেছনে সমালোচনা কিংবা দোষত্রুটি বলে বেড়ানোও ব্যক্তির জন্য কম পীড়াদায়ক নয়। সামাজিক মানুষ হিসেবে প্রত্যেকেরই ভালো-মন্দ দিক রয়েছে। প্রত্যেকেরই পছন্দ-অপছন্দ রয়েছে। কাউকে পছন্দ না হলে পেছনে ধুয়ে দেওয়া শোভনীয় নয়। আপনার ভালো মানসিকতা থাকলে তাকে ব্যক্তিগতভাবে সংশোধনের উদ্দেশ্যে বলতে পারেন। কিন্তু আপনি তার দোষ আরেকজনকে বললেন আবার আরেকজন আপনার দোষ বলল, এভাবে পরচর্চা সামাজিক বিশৃঙ্খলার কারণ হতে পারে।
মানুষ চেহারা কিংবা শারীরিক গঠনের দিক থেকে যেমন আলাদা, তেমনি প্রত্যেকেরই ভিন্ন ব্যক্তিত্ব রয়েছে। অনেক বিষয়ে অনেকের দুর্বলতা রয়েছে। কেউ যখন দুর্বলতায় আঘাত করে তখনই মানুষ বেশি কষ্ট পায়। শারীরিক, মানসিক কিংবা ত্রুটিগত দুর্বলতা না খুঁজে আমরা যদি বিপরীতে ভালো দিকগুলো দেখি, তাতে ব্যক্তি উৎসাহিত হবে। ভালো বিষয়ের চর্চা সমাজেও ভালো ফল দেয়। বিষয়টি আমাদের মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের অনুধাবন করা উচিত। ভালো কাজের জন্য শিক্ষকের প্রশংসা ও অনুপ্রেরণা শিক্ষার্থীকে অনেক দূর এগিয়ে দেয়। একটু ভুলের জন্য শিক্ষার্থীকে তিরস্কার করা, অন্যদের মতো শিক্ষার্থীকে বডি শেমিং করার ক্ষতি আমরা আজওয়াদের মাধ্যমে দেখেছি। সহপাঠীকে যে সুন্দরভাবে ডাকতে হবে এটা শিশুদেরও শেখাতে হবে। শিক্ষকদের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও বিষয়টাতে ভাবা উচিত। শিক্ষার্থী-সন্তানের কথা শুনুন। তাদের বন্ধু হতে চেষ্টা করুন। অন্যদের সঙ্গে তুলনা না করে নিজের সন্তানের ঝোঁক-প্রয়োজন অনুধাবনের চেষ্টা করুন।
আবার অন্যের কথায় ভেঙে পড়লেও চলবে না। আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে সামাজিক বুলিং কিংবা বডি শেমিংয়ের শিকার। তাই বলে অন্যের মন্তব্য কারও গন্তব্য ঠেকিয়ে রাখে না। যারা এগিয়ে যায় তারা এসব ফিরেও তাকায় না। ‘পাছে লোকে কিছু বলে’-এটাই বাস্তবতা। তবে তাদের জন্যে যথার্থ উত্তর ‘নিজের চরকায় তেল দাও।’