প্রকাশ : ২৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
পাখি পর্যটন
শীত মৌসুম মানেই বাংলাদেশে নতুন পাখির আনাগোনা। দেশের নানা এলাকায় নানা পাখির দেখা মেলে। কোন এলাকায় কোন ধরনের পাখি দেখা যাবে, সেটাই জানাচ্ছেন বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্য গাজী মুনছুর আজিজ।
উপকূলীয় অঞ্চলের কাদাচর, সিলেটের টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর, বাইক্কা বিল, হাইল হাওর বা হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন বিল, কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়া সৈকত এলাকা, সেন্টমার্টিন, সুন্দরবন কিংবা রাজশাহী অঞ্চলের পদ্মার চর এলাকায় নানা ধরনের নতুন পাখি দেখা যায়। এ পাখিগুলো মোটেই অতিথি নয়, এরা আমাদের দেশেরই পাখি। যেহেতু পাখিগুলো পর্যটকের মতো এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে বেড়ায়, তাই এদের পরিযায়ী বলা হয়।
সাধারণত, চারপাশের গাছগাছালি, বনে-বাদাড়ে, নদী-খালে, হাওর-বিলে অনেক পাখি দেখা গেলেও নির্দিষ্ট কিছু পাখির বসত ও খাবার নির্দিষ্ট স্থানেই হয়ে থাকে। তাই নির্দিষ্ট স্থানে গিয়েই নির্দিষ্ট পাখি দেখতে হয়। বাংলাদেশেও একেক প্রজাতির পাখির বসত একেক স্থানে।
বাংলাদেশে আবাসিক ও পরিযায়ী মিলে পাখির সংখ্যা প্রায় ৬৯০ প্রজাতির। এর মধ্যে আবাসিক ৩৩০ প্রজাতির। পরিযায়ী ৩৬০ প্রজাতির। এ ছাড়া অপ্রতুল তথ্যের ভিত্তিতে আরও ৩০ প্রজাতির পাখি রয়েছে।
বাংলাদেশে অধিকাংশ পরিযায়ী জলচর পাখিদের বিচরণ উপকূলের ভোলা, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, বরগুনা, রাজশাহী, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, মহেশখালী, সুন্দরবন ও হাওরাঞ্চলের চর, বিল বা জলাভূমিতে।
সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী শীত মৌসুমে বাংলাদেশের উপকূলের চর বা বিলে যেসব জলচর পরিযায়ী পাখি বেশি দেখা যায় তার মধ্যে আছে- দেশি কানিবক, গো বগা, মাঝলা বগা, ধুপনি বক, কালামাথা কাস্তেচরা, পাতি চকাচকি, খয়রা চকাচকি, ইউরেশিও সিঁথিহাঁস, পাতি তিলিহাঁস, পাতি শরালি, উত্তুরে লেঞ্জাহাঁস, উত্তুরে খুন্তেহাঁস, পাকড়া উল্টোঠুটি, ছোট নথজিরিয়া, কালালেজ জৌরালি, নাটা গুলিন্দা, ইউরেশিও গুলিন্দা, ছোট পানচিল, ছোট পানকৌড়ি, জুলফি পানচিল, ছোট বগা, বড় বগা, পিয়ং হাঁস, গিরিয়া হাঁস, প্রশান্ত সোনাজিরিয়া, মেটে জিরিয়া, পাতি লালপা, পাতি সবুজপা, পাতি বাটান, টেরেক বাটান, জুলফি পানচিল, খয়রামাথা গাঙচিল, কাসপিয়ান পানচিল, চামচঠুঁটো বাটান, খুন্তেবকসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি।
উপকূলের চরের মধ্যে আছে হাতিয়ার দমার চর, নিঝুম দ্বীপ, জাহাজমারার চর, মোক্তারিয়ার চর, গাজীপুরা চর, মদনপুরা চর, মধুপুরা চর, দাশের হাটের চর, মনপুরার চর, তুলাতুলী চর, মাঝের চর, বালুর চর, বগার চর, হাজীপুর চর, রগকাটার চর, লতার চর, যাদবপুর চর, উড়ির চর, শাহজালাল চর, আমানত চর, ঢালচর, ঠেংগার চর, কালাকাইচ্ছা চর, পিয়াল চর, পাতাইলা চর, ছোট বাংলার চর, চর মোন্তাজ, কালাম চর, খাজুর গাইচ্ছা চর, সামছু মোল্লার চর, বোয়ালখালীর চর, বড় রানীর চর, ছোট রানীর চর, টেগরার চরসহ আরও অনেক নতুন নতুন জেগে ওঠা নাম না জানা ছোট-বড় চর।
অবশ্য সব চরে সব জলচর পরিযায়ী পাখি বিচরণ করে না। মূলত দেশে শীত মৌসুমে উপকূলের কাদাচর, হাওরের বিল বা জলাভূমি, পদ্মার চর বা সুন্দরবনের চরগুলোয় অল্প পানি থাকে। এ অল্প পানিতেই থাকে পরিযায়ী পাখিদের খাবার। আর খাওয়া শেষ হলে চর বা বিলের আশপাশের ঘাসের মাঠ, বালুর মাঠ, বনভূমি বা বন-বাদাড়ের নিরাপদ স্থানে এসব পাখিরা থাকে। এরপর গ্রীষ্ম মৌসুমে বর্ষার পানি বাড়তে থাকলে এসব চর ও বিল পানিতে তলিয়ে যায়। ফলে পরিযায়ী পাখিরা তাদের খাবার আর খুঁজে পায় না, থাকার জায়গাও হারায়, তাই তারা খাবারের খোঁজে, নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে চলে যায় অন্য দেশে।
কিছু পাখি অতি কাদাচরে থাকে। আবার কিছু পাখি একটু শক্ত কাদাচরে থাকতে চায়। জলচর হলেও এর মধ্যে আবার কিছু পাখিকে সৈকত পাখি বলা হয়। কারণ তারা সৈকতের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। উপকূলের চরগুলোয় বিচরণ করা পাখির মধ্যে রয়েছে- নোয়াখালীর হাতিয়ার দমার চরে বিশ্বের মহাবিপন্ন চামচঠুঁটো বাটান পাখি দেখা যায় মাঝে মধ্যে দুয়েকটি। দুর্লভ কালামাথা কাস্তেচরা পাখির অন্যতম বিচরণ ভূমিও এ চর। বিরল ইউরেশীয় চামচঠুঁটো পাখিও দেখা যায় এখানে।
এ ছাড়া এ চরে একই সঙ্গে অনেক প্রজাতির হাজারও পাখি দেখা যায়। যার মধ্যে অনেক দুর্লভ, বিরল, বিপন্ন প্রজাতির পাখিও আছে। হাতিয়ার জাহাজমারা মোক্তারিয়া চ্যানেলে এবং এর আশপাশে ঝাঁকে ঝাঁকে দেখা যায় বিপন্ন দেশি গাঙচষা পাখি।
উপকূলে জলচর পাখিদের বড় একটি বিচরণভূমি হলো ভোলার চর ফ্যাশন থানার মেঘনা নদীর মোহনায় জেগে ওঠা চর শাহজালাল। এ চরের বয়স ২০-২২ বছরের বেশি। শীত মৌসুমে এ চরে একসঙ্গে প্রায় ৫০ প্রজাতির হাজারও পাখি দেখা যায়।
পরিযায়ী জলচর সৈকত পাখির আরেকটি বড় অংশ দেখা যায় কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়াদ্বীপসহ আশপাশের ছোট ছোট দ্বীপে। এ দ্বীপেও প্রায় ৪০ থেকে ৫০ প্রজাতির পাখি দেখা যায়। এর মধ্যে মহাবিপন্ন চামচঠুঁটো বাটান পাখিও আছে। এ পাখির জন্য দ্বীপটি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত। পাখি গবেষকদের মতে পৃথিবীতে চামচঠুঁটো বাটান পাখি আছে প্রায় ২০০। এর মধ্যে সোনাদিয়ার সৈকত এলাকায় পৃথিবীর প্রায় ১০ শতাংশ চামচঠুঁটো বাটান পাখি বসবাস করে। সোনাদিয়াদ্বীপসহ উপকূলের অনেক চরেই এমন অনেক বিপন্ন বা মহাবিপন্ন পাখির বসবাস রয়েছে। এ পাখির তালিকায় আছে- নর্ডম্যান সবুজপা, কালামাথা কাস্তেচরা, এশীয় ডাউইচার, কালালেজ জৌরালি, ইউরেশিয় গুলিন্দা, বড় নট, দেশি গাঙচষা ইত্যাদি।
উপকূল ছাড়া জলচর পরিযায়ী পাখিদের আরেকটি বৃহৎ বিচরণভূমি সিলেটের হাওরাঞ্চল। বিশেষ করে মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জের হাকালুকি হাওর, হাইল হাওর, বাইক্কাবিল, টাঙ্গুয়ার হাওরসহ এর আশপাশের বিভিন্ন হাওর শীতের সময় পরিযায়ী পাখিদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়।
শীতের সময় এসব হাওরে যেসব পরিযায়ী পাখির দেখা মিলেছে, এর মধ্যে আছে- ছোট ডুবুরি, বড় খোঁপাডুবুরি, বড় পানকৌড়ি, ছোট পানকৌড়ি, উদয়ী গয়ার, দেশি কানিবক, ধুপনি বক, লালচে বক, বড় বগা, ছোট বগা, মাঝলা বগা, গো বগা, এশীয় শামখোল, কালামাথা কাস্তেচরা, পাতি শরালি, মেটে রাজহাঁস, খয়রা চকাচকি, পাতি চকাচকি, তিলিহাঁস, পিয়াং হাঁস, সিঁথিহাঁস, ফুলুরি হাঁস, পাতি তিলিহাঁস, উত্তুরে খুন্তেহাঁস, উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস, গিরিয়া হাঁস, পাতি ভুতিহাঁস, বেয়ারের ভুতিহাঁস, টিকি হাঁস, মরচেরঙ ভুতিহাঁস, কোড়া, ধলাবুক ডাহুক, পাতি মানমুরগি, বেগুনি কালেম, পাতি কুট, নেউ পিপি, দল পিপি, কালাপাখ ঠেঙ্গি, মেটেমাথা টিটি, হট টিটি, উত্তুরে টিটি, প্রশান্ত সোনাজিরিয়া, ছোট নথজিরিয়া, কেন্টিশ জিরিয়া, ছোট ধুলজিরিয়া, ছোট বাবুবাটান, পাতি চ্যাগা, ল্যাঞ্জা চ্যাগা, কালালেজ জৌরালি, তিলা লালপা, পাতি লালপা, পাতি সবুজ পা, বিল বাটান, বন বাটান, পাতি বাটান, লাল নুড়িবাটান, গুলিন্দা বাটান, ছোট চাপাখি, টেমিকেংর চাপাখি, খয়রামাথা গাঙচিল, কালামাথা গাঙচিলসহ বিভিন্ন পাখি।
হাকালুকি হাওর, হাইল হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, বাইক্কাবিলসহ এর আশপাশে যে হাওর রয়েছে তার মধ্যে ছোট-বড় অনেক বিল আছে। হাকালুকি হাওরের বিলগুলোর মধ্যে আছে- জলা বিল, বালুজুড়ি, মাইসলা, কুকুরডুবি, ফুয়ালা, পোলাভাঙ্গা, হাওরখাল, কোয়ার কোণা, মালাম বিল, গোয়ালজুড়, চাড়ুয়া, তেকোনা, ভাইয়া, গজুয়া, রঞ্চি, হারাম, বিড়াল খালসহ বিভিন্ন বিল। উপকূল ও হাওর অঞ্চল ছাড়াও সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে প্রায় ৩১৫ প্রজাতির পাখির বসবাস রয়েছে। রাজশাহীর পদ্মার চরাঞ্চলেও অনেক প্রজাতির পরিযায়ী পাখির বসত রয়েছে।
পাখির জন্য আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় টাঙ্গুয়ার হাওর ও সুন্দরবনকে ‘রামসার সাইট’ ঘোষণা করা হয়েছে। নোয়াখালীর হাতিয়ার দমারচর, ভোলার চর শাহজালাল, কক্সবাজারের সোনাদিয়া, মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর, বাইক্কা বিলসহ বেশ কিছু স্থানও পাখির জন্য আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।