প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
অজন্তা অভিযান
বিকেলে মুম্বাই থেকে ট্রেন ছাড়ে। রাত ৪টায় ট্রেন থেকে আওরঙ্গবাদ স্টেশনে নামি। উদ্দেশ অজন্তা। সঙ্গে আছেন বন্ধুবর মানিক। আওরঙ্গবাদ মাহারাষ্ট্র রাজ্যের অন্যতম বাণিজ্যিক শহর। এ শহর থেকে অজন্তার দূরত্ব প্রায় ১০১ কিলোমিটার। স্টেশনে মানুষের ভিড় একটু কম। অবশ্য এ শেষ রাতে ভিড় কম হওয়ারই কথা। স্টেশনের তথ্য কেন্দ্রে একজন লোক বসে আছেন। তার কাছে খোঁজ নিই অজন্তা যাওয়ার বিস্তারিত। এরই মধ্যে কয়েকজন ট্যাক্সিচালক ঘিরে ধরলেন আমাদের। আমরা তাদের এড়িয়ে চলি। শেষরাত হলেও স্টেশনে কয়েকটি চায়ের দোকান খোলা আছে। এরই একটি দোকানে এসে দুধ চা খাই। এরপর ভোরের জন্য অপেক্ষা করি স্টেশনের বেঞ্চে বসে। ভোরের আলো ফুঁটতেই বেড়িয়ে পড়ি। অটো রিকশায় প্রথমে আসি আওরঙ্গবাদ বাস টার্মিনাল। খোঁজ নিয়ে দেখি লোকাল বাস ও জিপ দুটোই আছে অজন্তার উদ্দেশে। বাসে দেরি হবে, তাই চেপে বসি জিপে। যাত্রী আমরা ছয়-সাতজন।
কিছুক্ষণ চলার পর শহর ছেড়ে ধরি গ্রামের পথ। প্রায় ঘণ্টা খানেক পর বিরতি দিই পথের পাশের একটা বাজারে। বাজারটি পথের দুই পাশেই বিস্তৃত। খাবারের দোকান, চায়ের দোকান অনেকগুলো। এসব দোকানের সামনে পুরি, লাড্ডু, চানাচুর জাতীয় খাবার সাজানো। আমরা পথের পাশেই একটা দোকানের সামনে পাতানো টেবিলে বসি ভেতরে না গিয়ে। সকালের নাশতা হিসেবে পুরি জাতীয় খাবার খাই, সঙ্গে চা। গরুর দুধ আর নানা পদের মশলা মিশিয়ে তৈরি-মশলা চা। স্বাদটা ভালোই। আওরঙ্গবাদ মুসলিম জনবসতি এলাকা। তাই বাজারে বা চায়ের দোকানগুলোর সামনে যারা বসে আছেন, তাদের অধিকাংশ মুসলিম।
পথের দুই পাশের বিস্তৃর্ণ জমিনে চলছে তুলাচাষ। সেই সঙ্গে দেখি ভুট্টার চাষ। মাঝেমধ্যে দেখি গরুর গাড়ির চলাচল ও তাতে মাল বোঝাই। মূলত স্থানীয়রা তাদের প্রয়োজনীয় মালামাল বা কৃষিপণ্য বহন করেন এ গরুর গাড়িতে। পথে অন্য যানবাহনের চলাচল একটু কম। মাঝেমধ্যে কিছু মটর বাইকের চলাচল দেখি। অধিকাংশ মটরবাইকে চালকসহ দুই/একজন আরহী আছেন।
সমতল পথ শেষে গাড়ি ধীরে ধীরে ধরে পাহাড়ি পথ। পথের পাশে দূরে দেখি পাহাড়ের উপর কোনো এক প্রচীন দুর্গের প্রাচীর। আসলে মুগল আমলে আওরঙ্গবাদ আওরঙ্গজেবের শাসন এলাকা ছিল। হয়তো তারই কোনো নিদর্শন এ দুর্গ। তবে আওরঙ্গবাদ শহরের কাছেই আওরঙ্গজেবের দুর্গ আছে। সে দুর্গের গল্প করেছি আরেকটি লেখায়।
পাহাড়ি আঁকাবাঁকা, উঁচু-নিচু পথ পাড়ি দিয়ে প্রায় ঘণ্টা তিন পর আসি অজন্তা। চোখ বুলিয়ে দেখি চার পাশেই পাহাড়। টিকিট কেটে প্রবেশ করি অজন্তা সংরক্ষিত এলাকায়। প্রথমেই আছে শপিংপ্লাজা ও রেস্টুরেন্ট। এরপর ছোট্ট এক সাঁকো পার হয়ে নির্দিষ্ট এক জায়গায় দাঁড়াই গুহায় যাওয়ার শাটল বাসে ওঠার জন্য। এ বাসেরও টিকিট কাটতে হয়েছে। পাহাড়ি বনের ভেতর দিয়ে প্রায় ৪ কিলোমিটার চলার পর গাড়ি থামে অজন্তা গুহার গেটের কাছে। গেটের সামনে বামপাশে অজন্তাসহ ভারতের বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া বিভিন্ন নিদর্শনের ছবিসহ বর্ণনা সংবলিত বিলবোর্ড সাঁটানো।
গেট দিয়ে প্রবেশ করে প্রথমে ব্যাগ রাখি লকারে। এরপর টিকিট কাটি গুহার। টিকিট ঘরের পাশে অজন্তা নামক রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টের পাশে একজন ঝালমুড়ি বিক্রি করছেন। তার সামনে বেশ কায়দা করে সাজানো কয়েক পদের চানাচুর, মুড়ি ও বিভিন্ন মশলা।
টিকিটঘর থেকে একটু সামনে এগোলেই গুহায় যাওয়ার সিঁড়ি-পথ। মোটামুটি উচুঁ এ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলে একটু দূরে দেখি অজন্তা গুহা। গল্পে-ছবিতে যে অজন্তা জেনে এসেছি, সে অজন্তা এখন আমার চোখের সামনে। সত্যিই, অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে। আরও একটু সিঁড়ি বেয়ে ওঠার পর আরও কিছুটা হেঁটে আসি একেবারে গুহামুখে। এখানেও আরেকটি ছোট্ট গেট আছে। গেটে টিকিট দেখিয়ে প্রবেশ করে আসি অজন্তার প্রথম গুহার সামনে।
ইতিহাস ঘেঁটে জানি, খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সাল থেকে সপ্তম খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে গুহাগুলো নির্মিত। বৌদ্ধ ভিক্ষু বা সন্ন্যাসীরা ধর্মচর্চা বা উপাসনার জন্যই নির্জন অরণ্যঘেরা এ অজন্তার পাহাড় খোদাই করে গুহাগুলো তৈরি করেছেন। কেবল গুহা নয়, এসব গুহার ভেতর বৌদ্ধ ভিক্ষুরা পাথরের পাহাড় কেটে কেটে তৈরি করেছেন বুদ্ধের মুর্তিসহ নানা শিল্পকর্ম; শিল্পকলার ভাষায় যাকে ‘রিলিফওয়ার্ক’ বলে। এছাড়া গুহার ছাদে বা সিলিংয়ে অনেক শিল্পকর্ম আছে; যাকে শিল্পের ভাষায় ফ্রেসকো বলে। অবশ্য এসব ‘রিলিফওয়ার্ক’ বা ‘ফ্রেসকো’ অনেকটা ভাস্কর্য রীতিতে বা ভাস্কর্যের আদলে তৈরি করা হয়েছে। তাই সজহ ভাষায় আমরা এসব শিল্পকর্মকে ভাস্কর্য রীতির শিল্পকর্ম বলতে পারি। আর এসব ভাস্কর্য রীতির শিল্পকর্মের পাশাপাশি গুহাগুলোর দেয়ালে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা নানা রঙে তৈরি করেছেন বুদ্ধের জীবনী বা বুদ্ধের জাতক কাহিনিসহ নানা চিত্রকর্ম। সব মিলিয়ে গুহাগুলো রহস্যঘেরা।
একে একে দেখি শিল্প-সমৃদ্ধ গুহাগুলো। সত্যিই বিষ্মিত হই পাথুরে পাহাড় কেটে তৈরি করা এসব গুহা ও তার ভেতর পাহাড় কেটে কেটে তৈরি করা শিল্পকর্ম দেখে। আরও বিষ্মিত হই গুহার দেয়াল ও ছাদে আঁকা রঙিন চিত্রকর্ম দেখে। প্রায় ২২০০ বছর আগের আঁকা এসব চিত্রকর্ম এখনো জ্বলজ্বল করছে। মনে হচ্ছে আধুনিক কোনো গ্যালারিতে শিল্পকর্মের প্রদর্শনী দেখছি।
আর্কেওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া তাদের প্রকাশনায় গুহার সংখ্যা ২৯টি দিয়েছে। অবশ্য এর মধ্যে ১৫ ও ১৫এ- দুটি মিলে একটি ধরা হয়েছে। সে হিসেবে ধরা যেতে পারে ৩০টি গুহা।
গুহাগুলোর শিল্পকর্ম দেখে বিষ্ময়ের ঘোরই কাটে না। একেকটি গুহার শিল্পকর্ম একেক রকম বৈচিত্র্যের। সে বৈচিত্র্যের বর্ণনা করেছি অজন্তাবিষয়ক অন্য গল্পগুলোতে।
গুহাগুলোর সামনে ও এখানকার গাছগাছালিতে কালোমুখ হনুমান দেখি অনেক। সেইসঙ্গে দেখি নানা প্রজাতির পাখি। সব গুহা দেখে বেলা শেষে আবার শাটলবাসে ফিরি আগের জায়গায়, অর্থাৎ অজন্তা সংরক্ষিত এলাকার মূল গেটের কাছে। এখানে আছে শপিংপ্লাজা ও রেস্টুরেন্ট। এ শপিংপ্লাজার ছোট ছোট দোকানগুলোতে নানা পণ্য সাজানো। এর মধ্যে আছে বুদ্ধসহ বিভিন্ন মুর্তি, নকশাদার শ্যাডোলাইট, পাথর ও পুথির মালা, পাথরের বিভিন্ন পণ্যসহ পর্যটন স্মারক। শপিংপ্লাজার পাশেই খাবারের একাধিক দোকান। সব দোকানের সামনেই খোলা জায়গায় চেয়ার-টেবিল পাতানো। আমরা একটায় বসি দুপুরের খাবারের জন্য। যদিও বেলাশেষ। থালি প্যাকেজ নিই। এ থালিতে আছে দুইটা আটার রুটি, একমুঠ ভাত, সবজি ভাজি, ঝোলসবজি, বুটের ডাল ও পাতলা ডাল, একটু টকদই ও মরিচের আচার। সব বড় একটা স্টিলের থালাতে দেওয়া হয়েছে। স্বাদ ভালোই।
খাবার শেষে একটা মাইক্রোবাসে উঠি আওরঙ্গবাদের উদ্দেশে। যাবার সময় যেখানে বিরতি দিয়েছিলাম, ফেরার সময়ও সেখানে বিরতি দিই। হালকা কিছু খেয়ে চা খাই। ভালো লাগল বলে চা খাই দুইকাপ। রাত ৯টার দিকে আসি আওরঙ্গবাদ। রেল স্টেশনের পাশেই একটা হোটেলে উঠি।