রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২১, ০০:০০

উপেক্ষা থেকে কবিতার বাঁক বদল
অনলাইন ডেস্ক

শামসুর রাহমান দীর্ঘ পাঁচ দশক সাহিত্যচর্চা করেছেন, সমকালকে আত্মস্থ করে লিখেছেন অসংখ্য কবিতা। মুক্তিযুদ্ধ, নাগরিকতা, রাজনীতি ও প্রেম তাঁর কবিতায় দীর্ঘপথ হাতে হাত ধরে হেঁটেছে। আপনসত্তায় উদ্ভাসিত হয়ে দেশ ও কালকে তিনি নিজের করে নিয়েছেন। বিশেষত, তাঁর কাব্যে সমকালীন সমাজ ও রাজনীতি যেভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে-তা প্রশংসনীয়।

শামসুর রাহমান প্রথমদিকে ত্রিশের কবিদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসুর চিন্তা তাঁকেও পেয়ে বসেছিলো। ঠিক করেছিলেন রাজনৈতিক কবিতা লিখবেন না। তাঁরও ধারণা ছিলো রাজনৈতিক কবিতা কখনো শুদ্ধ কবিতা হয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু সময়ের উত্তাপ কিংবা রাজনৈতিক ঘটনাবলি কি সত্যিই উপেক্ষা করা যায়? রাহমান উপেক্ষা করতে পারেননি। কেন পারেননি সে সম্পর্কে নিজেই লিখেছেন : ‘আমার কবিজীবনের গোড়ার দিকে রাজনীতি-প্রতিরোধকারী যে দুর্গটি গড়ে তুলেছিলাম তাতে প্রথম চিড় ধরে ১৯৫২ সালে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কালে। তখন থেকেই আমার পদ্যে রাজনীতি উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করে। ...আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে আমার কাব্যপ্রয়াস একটা নতুন বাঁক নেয় ব’লে মনে করি। যে-আমি ছিলাম পুরোপুরি বিবরবাসী, অন্তর্জীবনে সমর্পিত, সে-আমি ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠল বহির্জীবনের প্রতি মনোযোগী এবং রাজনীতি মনস্ক। কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের অনুগত না হয়েই আমি রাজনীতি থেকে, গণসংগ্রাম থেকে শোষণ ক’রে নিলাম আমার কবিতার নানা উপাদান।’ কবিতায় সময়-স্মারক স্থাপনের যে কাজ তা সফলভাবে সম্পন্ন করা দুরূহ কাজ। সেই কাজটি শামসুর রাহমান যথার্থরূপে করেছেন।

রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে কবি ছিলেন সর্বদা মুখর। ’৬৯-এর আইয়ুববিরোধী মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন আসাদ। এ ঘটনায় তীব্র আলোড়িত হন কবি। প্রতিকূল সময়ের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে লিখেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি। আসাদের রক্তমাখা শার্ট হয়ে উঠে আমাদের সাহসের প্রতীক :

‘আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা

সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখ- বস্ত্র মানবিক;

আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।’

এ প্রসঙ্গে নূর হোসেনকে নিয়ে লেখা ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ কবিতাটিও সমানভাবে স্মরণযোগ্য। এর বাইরে ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’ কবিতার কথাও উল্লেখ করতে চাই। কবিতায় কবি দেখিয়েছেন, রাজপথে কৃষক-শ্রমিক-মাঝিসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ গণআন্দোলনে সমবেত। কবির কাছে মনে হয়েছে-১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি যেন ’৫২ সালের ফেব্রুয়ারি। রাজপথে অস্তিত্বের প্রশ্নে আবার এসেছেন সালাম, রফিক, বরকত...। মৃত্যু সেখানে তুচ্ছ। কেননা বীরের রক্তে ‘দুখিনী মায়ের অশ্রুজলে ফোটে ফুল’। আর সেই ফুলই বাঙালির প্রাণ। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের দৃশ্যপটকে এভাবেই ভাষা আন্দোলনের সমান্তরালে অনুভব করেছেন কবি।

শামসুর রাহমান বাঙালির জাতীয় আন্দোলন-সংগ্রামে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিয়েছেন। রক্তকে পরিণত করেছেন কলমের কালিতে, লিখেছেন এক-একটি কবিতা। রাজনৈতিক ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামের পথ ধরে সংগঠিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। শামসুর রাহমান স্বশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি সত্য, কিন্তু তাঁর কলম থেমে থাকেনি। মুক্তিযুদ্ধকালে লিখেছেন অবিস্মরণীয় ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থটি। দীর্ঘ ৯ মাসের করুণ, বিভর্ৎস, হৃদয়বিদারক বর্ণনা উঠে এসেছে এ কাব্যের কবিতাসমূহে। বইটির ভূমিকায় কবি লিখেছেন : ‘তখন ঢাকা এক কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। সুদীর্ঘ ন’মাস আমরা যে পরিবেশে বাস করেছি তাকে কাফকার জগৎ বললে কিছুই বলা হয় না। উৎপীড়ন, হত্যা এবং সন্ত্রাস আমাদের চারপাশে রচনা করেছিল এক ভয়ংকর তমসাচ্ছন্ন ও বিভীষিকাময় পটভূমি।... আমরা প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতাম।...বধ্যভূমির ধারে বেঁধে রাখা জীবজন্তুর অনুরূপ আমরা আতঙ্ককে জেনেছি নিত্যসঙ্গী বলে।’ এমন আতঙ্কের মধ্যে থাকলেও অসংখ্য বাঙালির মতো স্বাধীনতার জন্যে কবির আকাক্সক্ষা দমে যায়নি। তাই তিনি স্বাধীনতাকে দেখেন নানা রঙে, রূপকে ও উপমায়। স্বাধীনতা কখনো তাঁর কাছে বোনের হাতের নম্র মেহেদী, কখনো ‘বন্ধুর হাতে তারার মতন জ্বলজ্বলে এক রাঙা পোস্টার’ হয়ে ধরা দেয়। স্বাধীনতার জন্যে বাঙালির যে বিসর্জন, আত্মত্যাগ ও সমবেত কণ্ঠস্বর-শামসুর রাহমানের কবিতায় তা উজ্জ্বল হয়ে আছে। ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’, ‘গেরিলা’, ‘মধুস্মৃতি’, ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’, ‘তুমি বলেছিলে’ কবির মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উল্লেখযোগ্য কবিতা।

পূর্বেই উল্লেখ করেছি শামসুর রাহমান রাজনীতি-সচেতন কবি। তৎকালীন রাজনৈতিক দুরবস্থা নিয়ে তাঁর অন্যতম বিখ্যাত কবিতা ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’। এ কবিতায় তৎকালীন নষ্টসময়কে নানা নামে, উপকরণে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। একাত্তরে যারা দেশের মাটি ও মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, সেই রাজাকাররাই পঁচাত্তর পরবর্তীকালে বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পেলো। কবি শামসুর রাহমান এই অবস্থার প্রেক্ষিতে লিখলেন ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’ কবিতাটি। এর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ এতই শক্তিশালী যে, কবিতাটি সচেতন যে কাউকেই তীব্রভাবে স্পর্শ করবে। কবিতায় কবির মোনাজাত :

‘হে সর্বশক্তিমান, আপনি আমাকে

এমন তৌফিক দিন যাতে আমি

আপাদমস্তক মনেপ্রাণে একজন খাস রাজাকার

হয়ে যেতে পারি রাতারাতি।

তাহলেই আমি সাত তাড়াতাড়ি

মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছে যাবো, এই চর্মচক্ষে

দেখে নেবো হাতিশালে হাতি আর

ঘোড়াশালে ঘোড়া আর আমার হাতে আমলকির মতো

এসে যাবে সব পেয়েছির দেশের সওগাত।’

অন্যদিকে ‘বাইবেলের কালো অক্ষরগুলো’ কবিতায় কবি জানিয়েছেন একজন তরুণের কথা, যে স্বপ্ন দেখে তার কবিতা থেকে একদিন ম্লান শব্দাবলি ঝরে পড়বে। এর পরিবর্তে ‘তার কবিতা হবে মৌলানা ভাসানী/এবং শেখ মুজিবের সূর্যমুখী ভাষণের মতো।’ অর্থাৎ কবিতা হবে তেজস্বী, যা দীপ্তস্বরে গণমানুষের কথা বলবে। কবি নিজে এমন বিশ^াসই লালন করতেন।

রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কবিতায়ও শামসুর রাহমান দৈনন্দিন ব্যবহৃত শব্দকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁর অনেক কবিতা বাঙালির সংগ্রাম ও অকুতোভয় অস্তিত্বের কথা উচ্চকণ্ঠে জানান দেয়। রাজনৈতিক অনুষঙ্গে লেখা কবিতাগুলোয় উপমার ব্যবহারও হৃদয়গ্রাহী। তাই প্রতিদিনের পরিচিতি দৃশ্যকে ধারণ করে কবিতাগুলো হয়ে উঠেছে কালের স্মারক। প্রতিবাদী স্বভাবের জন্যে শামসুর রাহমানকে বারবার ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। ছাড়তে হয়েছে দৈনিক বাংলার সম্পাদকের পদও। যে শামসুর রাহমান কবিজীবনের প্রথমদিকে সচেতনভাবে রাজনৈতিক অনুষঙ্গে কবিতা লিখতে চাননি, উপেক্ষা করেছেন, শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক অনুষঙ্গের ভেতর দিয়েই তাঁর কবিতায় বাঁকবদল এসেছে। তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন রাজনৈতিক চেতনাঋদ্ধ অবিস্মরণীয় কিছু কবিতা। তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনাসম্ভারের মধ্যেও কবিতাগুলো উল্লেখযোগ্য।

কবির জন্ম ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর, ঢাকার মাহুতটুলিতে। পঞ্চাশের দশকে লেখা শুরু করেছিলেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর কলম থামেনি। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ ব্যতীত এত কবিতা বাংলা সাহিত্যে আর কেউ লেখেননি। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট কবি প্রয়াত হন। অন্য সব মহান কবির মতো মৃত্যুর মধ্য দিয়েই শামসুর রহমান অমৃত ও অমরত্বের পথে হাঁটলেন।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়