প্রকাশ : ০১ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০
২৮ অক্টোবর ২০২৩, বাংলাদেশ স্পর্শ করল উন্নয়নের আরও একটি মাইলফলক। এ দিন টানেল যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে প্রথম বহুলেন সড়ক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দক্ষিণ এশিয়ার নদীর তলদেশ দিয়ে যান চলাচলকারী প্রথম টানেল এটি। ঠিক একই দিনে বিরোধী রাজনৈতিক দল ঢাকায় মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছিল। সরকারও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ধারবাহিকতায় যথাসময়ে মহাসমাবেশ করার অনুমতি দেয়; কিন্তু ২৮ তারিখ আমরা কী দেখলাম! দুই দলের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনায় রণক্ষেত্রে পরিণত হলো ঢাকা শহরের একাংশ। ভাঙচুর করা হলো প্রধান বিচারপতির বাসভবনের ফটকসহ রাস্তায় চলাচলকারী যানবাহন। পুড়িয়ে দেয়া হলো রাজারবাগ পুলিশ লাইনের অভ্যন্তরে রক্ষিত অ্যাম্বুলেন্স। হত্যা করা হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ কনস্টেবলকে। গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২৮ অক্টোবর দিনটিতে একদিকে চট্টগ্রামে চলছে কল্যাণ ও সমৃদ্ধির উদ্বোধন, অন্যদিকে ঢাকায় চলেছে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও অগ্নিসংযোগের মতো ধ্বংযজ্ঞ। এমনটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। মানুষ রাজনীতির ক্ষেত্রে চায় স্থিতিশীলতা।
স্বাধীনতার পর ৫০ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে আসা বাংলাদেশ সামরিক শাসনসহ অনেক শাসনব্যবস্থা দেখেছে। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশ পরিচালনার ভার ছিল বিএনপির হাতে। ২০০৭ ও ২০০৮ সালের ‘চেপে বসা দুঃশাসন’ পেরিয়ে আজকের বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের বিস্ময়। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের মোট বাজেট ছিল ৬১ হাজার ৬ কোটি টাকা, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। বিগত ১৫ বছরে আর্থসামাজিক খাতে এক অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ২০০৬ সালে জিডিপির আকার ৪ লাখ ৮২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা ছিল, তা ২০২১ সালে বেড়ে ২৮ লাখ কোটি টাকার অধিক হয়েছে। ২০০৬ সালে জিডিপির বৃদ্ধি ছিল ৫.০৪। আর সময় ২০২১ সালে ৬.১ জিডিপি অর্জিত হয়েছে। ২০০৬ সালে জনগণের মাথাপিছু আয় ছিল ৫৪৩ মার্কিন ডলার, যা ২০২১ সালে ২ হাজার ৫৫৩ ডলারে উন্নীত হয়, বৈদেশিক রিজার্ভ ছিল ৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২১ সালে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। বিএনপির শাসনামলে খাদ্য ঘাটতি থাকলেও ২০২১ সালে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ২০০৬ সালের রপ্তানি আয় ১০.৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থাকলেও ২০২১ সালে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। সেবা খাতসহ রেমিট্যান্স আয় ৪.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হলেও ২০২১ সালে তা ২৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। ২০০৬ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১.৫ শতাংশ, যা ২০২১ সালে ২১ শতাংশের নিচে নেমে আসে।
সমুদসীমা জয়, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, পায়রা বন্দর, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, দরিদ্রদের জন্য ঘর উপহার, গড় আয়ু বৃদ্ধি, স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ, ডিজিটাল বাংলাদেশ, কমিউনিটি ক্লিনিক, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি (৩২০০ মেগাওয়াট থেকে ২৪৪২১ মেগাওয়াট), বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, মডেল মসজিদ কাম ইসলামিক সংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, মেট্রোরেল চালু ইত্যাদি বর্তমান সরকারের প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও ঐকান্তিকতার ফসল। এ ছাড়াও ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ এবং ডেলটা প্ল্যান ২১০০ সালের রূপরেখা ঘোষণার কৃতিত্বের দাবিদার বর্তমান সরকার।
বঙ্গবন্ধুর শুরু করা প্রযুক্তিগত উন্নয়ন পরিপূর্ণতা পায় আওয়ামী লীগ সরকারের হাত ধরে। ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের ঘোষণা আসে। বর্তমানে দেশব্যাপী সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সার কাজ করেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসেও ইন্টারনেটের মাধ্যমে আউটসোর্সিং করে তারা কয়েকশ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছেন। বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষামতে, অনলাইন শ্রমশক্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে দ্বিতীয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কৃষি খাতে বাংলাদেশের অর্জন ঈর্ষণীয়। বাংলাদেশ বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনে প্রথম, চাল উৎপাদনে তৃতীয়, ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ, আম উৎপাদনে সপ্তম, আউটসোর্সিংয়ে অষ্টম, আলু উৎপাদনে সপ্তম, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, মৌসুমি ফল উৎপাদনে ১০ম, পাট রপ্তানিতে প্রথম, মাছ উৎপাদনে তৃতীয়, কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম। পরিসংখ্যান বলে, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন আমাদের চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট।
মহামারী করোনাভাইরাসের প্রকোপে পৃথিবীর প্রায় সব দেশই বিপর্যস্ত হয়েছিল। এই ভাইরাসে বাংলাদেশের অবস্থাও ছিল নাজুক। সেই পরিস্থিতি থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সফলতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। তিনি করোনা মহামারি থেকে মানুষের জীবন বাঁচাতে ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে দ্রুত নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করা, টিকাদানে জোর দেয়া, অর্থনীতি গতিশীল রাখতে সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপ এ ক্ষেত্রে গুরুতপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। করোনা মহামারি পৃথিবীকে করেছিল স্তব্ধ। মন্থর হয়েছিল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। করোনার রেশ কাটতে না কাটতেই শুরু হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ। যুদ্ধে পক্ষ-বিপক্ষের শক্তি একে অন্যকে ধরাশায়ী করার বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অবরোধে পৃথিবীব্যাপী সৃষ্টি হয়েছে জ্বালানি সংকট এবং ভেঙে পড়েছে খাদ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা। জ্বালানি সংকটে ইউরোপজুড়ে বিদ্যুতের ঘাটতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মোমবাতির আলোয় চলছে ইউরোপের কোনো কোনো দেশে রেস্টুরেন্টের কার্যক্রম। এমন পরিস্থতিতে বাংলাদেশও অথনৈতিকভাবে স্বস্তিতে নেই। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। হুমকির মুখে পড়েছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই মন্দা মোকাবিলায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। এই লক্ষ্যে সবাইকে সাশ্রয়ী হতে বলেছেন। তিনি কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়েই ক্ষান্ত হননি, গণভবনের অভ্যন্তরে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, যা দেশের জনগণকে যারপরনাই অনুপ্রাণিত করেছে।
দেশের মানুষ চায় রাজনীতিটা প্রতিযোগিতামূলক হোক। রাজনীতিতে জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও সুচিন্তার সমন্বয় ঘটুক। সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ইতিবাচক প্রতিযোগিতা হলে রাজনীতিটা আরও বেশি সুন্দর ও স্বচ্ছ হয়ে উঠবে। রাজনীতি প্রকৃতপক্ষে জনগণ ও দেশের কল্যাণে একটি সংঘবদ্ধ প্রয়াস। দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি এর লক্ষ্য। রাজনীতিতে তাই বলা হয় ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়। এই মূলমন্ত্র যদি আমরা অনুসরণ করি, তাহলে দেশ ও জনগণের ক্ষতিসাধন করে রাজনীতি করার কোনো সুযোগ নেই। রাজনীতির নামে মানুষ হত্যা, অগ্নিসন্ত্রাসের মতো ঘটনা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এমন রাজনীতি যেকোনো দলকে জনবিচ্ছিন্ন করবে। রাজনীতিতে যদি ব্যক্তিগত স্বার্থ ও ক্ষমতার লিপ্সা মুখ্য হয়ে দেখা দেয়, তবে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যে নিপতিত হয় দেশ। নিপীড়িত মানুষের আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে চারপাশের বাতাস। রাজনীতিবিদের সবসময় হতে হবে প্রজ্ঞাবান, ইতিবাচক চিন্তার অধিকারী। দেশের স্বার্থে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে।
রাজপথে অস্থিরতা সৃষ্টি করে শিক্ষা, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ রাষ্ট্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কার্যক্রমগুলো ক্ষতিগ্রস্থ করার কৌশলে সাধারণ মানুষ বিশ্বাসী নয়। আমরা প্রায়ই যেকোনো বিষয়ে উন্নত রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে উদাহরণ হিসেবে টেনে আনি। তাদের রাজনীতিবিদদের জনসম্পৃক্ত কাজগুলো দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচনা করি। তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম কখনোই আমাদের দেশের মতো সাধারণ মানুষকে অবরোধ করে হয় না, সেটাও আমরা উল্লেক করি। কিন্তু তার কতটুকু প্রতিফলন আমাদের রাজনীতিবিদরা দেখাতে পারেন? উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে সরকারের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করার জন্য বিরোধী দলগুলো ছায়া সরকার গঠন করে। সরকারের উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের প্রশংসা করে তারা, সরকার কোনো কাজে ভুল করলে সেটি কিভাবে করা গেলে ভালো হতো তার পথ বাতলে দেয়। অথচ আমাদের দেশে ঠিক এর উল্টোটি ঘটে। সরকার যতই ভালো কাজ করুক না কেন, সেগুলোকে কতটা ছোট করে দেখানো যায় তার প্রতিযোগিতা চলে। এর সঙ্গে গুজব, মিথ্যাচার, অপপ্রচারের মতো নেতিবাচক বিষয়গুলোও থাকে।
সরকারের ভালো কাজে সমর্থন এবং যে কাজগুলো সঠিকভাবে হচ্ছে না তার গঠনমূলক সমালোচনা করার মতো মানসিকতা রাজনীতিবিদদের মধ্যে থাকতে হবে। রাজপথ বন্ধ করে নয়, বরং রাজপথ উম্মুক্ত রেখেই রাজনীতিবিদদের গঠনমূলক রাজনীতি করতে হবে। রাজনীতির মূল লক্ষ্যই হওয়া উচিত দেশ ও দশের কল্যাণ ও সমৃদ্ধির জয়গান।
লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।