প্রকাশ : ০৪ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
আমরা ভালো নেই, ভালো নেই দেশের শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ। প্রতিদিনের দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি যুদ্ধের বাজারকেও হার মানাচ্ছে। আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ। সেই যুদ্ধের সময়েও দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল ছিল। কারণে-অকারণে স্বাধীনতার তিপান্ন বছরে এসে এখন আমাদের দেশের সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা প্রায় প্রতিদিনই দ্রব্য মূল্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। উৎপাদনকারী কৃষক-শ্রমিকরা তার ফসল এবং শ্রমের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। তারা প্রতি পদে পদে বঞ্চিত। কোনো দায়বদ্ধতা নেই, নেই কোন জবাবদিহিতা। যে যার মতো ব্যবসায়ের নামে লুটপাট করে কেটে নিচ্ছে আমাদের সাধারণের পকেট। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া যেন আর কোন রাস্তাই আমাদের খোলা নেই। জীবন-জীবিকায় আমরা জিম্মি হয়ে পড়েছি সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী মালিক শ্রেণির হাতে। কোথাও কোন স্বস্তি নেই। জীবনের অধিকার নেই, শিক্ষার অধিকার নেই, খাদ্যের নিরাপত্তা নেই-নিরাপদ খাদ্য নেই। আছে শুধু ভেজালের সমারোহ, ঘুষ-দুর্নীতির নানা আয়োজন। স্বাস্থ্যের অধিকার নেই, স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা নেই।
বাসস্থানের অধিকার নেই। শিক্ষা আজ বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হয়েছে। যেখানে মানবিকতা, মূল্যবোধ, শিষ্টাচার, সহমর্মিতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বিলুপ্ত হওয়ার পথে। মানুষে-মানুষে শ্রেণিবৈষম্য, সামাজিক বৈষম্য, আয় বৈষম্য চরমভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। চিকিৎসার নামে চলছে গলাকাটা বাণিজ্য বিভিন্ন দপ্তরের নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির চিত্র এবং সংবাদগুলো যখন মিডিয়ার মাধ্যমে আমাদের সামনে আসে তখন খুব আহত হই, ব্যথিত হই। এই অনিয়ম আর দুর্নীতির জন্য কি মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে, ইজ্জত দিয়ে, সম্ভ্রম হারিয়ে দেশটাকে স্বাধীন করেছিল, নাকি শোষণহীন, বৈষম্যহীন একটি সোনার বাংলাদেশের জন্য দেশটি স্বাধীন হয়েছিল, যারা যুদ্ধ করেছে, জীবন দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে তাদের উত্তরসূরিরা আজও বঞ্চিত প্রতি পদে পদে। তাদের ন্যায্য অধিকার আজও প্রতিষ্ঠিত হয় নি।
তরুণ-যুবকরা আজ দিশেহারা। জীবনের মানে খুঁজে না পেয়ে আজ তারা দিশেহারা। অন্ধকার গলিতে পা বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাড়ছে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। মাদকের ব্যবহার হুহু করে বাড়ছে। বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কিশোর গ্যাং, নারী অপহরণ, শিশু নির্যাতন, শিশু বলাৎকার, কোথাও কোথাও মৌলবাদী শক্তির উত্থান। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবর্তে সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু পরিবারগুলো আতঙ্কিত জীবন-যাপন করে এই ভেবে কখন তারা নতুন ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে হামলা-মামলা, লুটপাট-অগ্নিসংযোগের বলি হবে। নিম্নবৃত্ত ও মধ্যবৃত্ত পরিবারগুলো জীবন থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। চারদিকে সামাজিক অবক্ষয়ের মিছিল আর সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা। দখলদার, ঘুসখোর, পাচারকারী, দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম্যে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে।
বিশ্বব্যাপী যখন করোনার মহামারি চলে আমাদের দেশে তখন নতুন করে কোটিপতির সংখ্যা ৩ হাজার ৪১২ জন বেড়েছে। যদিও করোনার কারণে দেশের অনেক পরিবারের আয় কমেছে। এ বিষয়ে জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের সহযোগিতায় প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ আয়োজিত এক ওয়েবিনারে জানানো হয়, করোনার কারণে দেশে শতকরা ৭২.৬ শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে। আর গত এক বছরে বেড়েছে ৭ হাজার ৯৭০টি। সোমবার (২০ মার্চ) প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২২ সালের ডিসেম্বরভিত্তিক হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। আমাদের জন্য এক অশনিসংকেত ।
২০১৬ থেকে ২০২০, ৫ বছরে পাচারকারীরা ৩ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। যরি মধ্যে শুধু ২০১৫ সালে ১ বছরেই দেশ থেকে পাচার হয়েছে যায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা। অর্থপাচার থামছে না। আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অঙ্কটি বড়ই হচ্ছে। গত ১৬ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে অন্তত ১১ লাখ কোটি টাকা।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা-প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যায়। এই অর্থপাচারের বড় গন্তব্যস্থল। দেশগুলো হলো সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, হংকং ও থাইল্যান্ড। আর পাচার চলছে মূলত বাণিজ্য কারসাজি ও হুন্ডির মাধ্যমে। আমাদের বার্ষিক বাজেটের চেয়েও বিদেশে পাচারকৃত টাকার পরিমাণ অনেক বেশি। সেবা খাতে দুর্নীতির শিকার হচ্ছে প্রায় ৭১ শতাংশ খানা (পরিবার)। বিভিন্ন সেবা পেতে প্রতিটি পরিবারকে গড়ে ৬ হাজার ৬৩৬ টাকা ঘুষ দিতে হয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে দেশে ঘুষ দেওয়া টাকার পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৮৩০ কোটি। মোট ১৭টি সেবা খাতে এই ঘুষের টাকা দিয়েছেন সাধারণ মানুষজন। রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়ন থেকে বাঁচাতে না পারলে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিকতা, দায়বদ্ধতায় কালো অন্ধকার নেমে আসবে। মানুষ প্রচণ্ড লোভী হয়ে সামাজিক সর্ম্পকে ধ্বংস করে দিবে। মানুষ পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবর্তে হিংস্র হয়ে উঠবে।
স্বাধীনতার সুখ, স্বাদ সকলের মাঝে পৌঁছে দিতে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমৃদ্ধ করতে, দেশের উন্নয়ন–উন্নতি ও অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে এবং উন্নয়ন- উন্নতি ও অর্থনীতির একটি শক্ত ভীত তৈরি করতে রাষ্ট্রকে জনস্বার্থে কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া জরুরি। শিক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মধ্য দিয়ে মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ, মানবিকতা, দেশপ্রেম,মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তুলতে হবে। সরকারের পাশাপাশি একটি জোড়ালো সমাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে আমরা ভালো থাকার রাস্তাটাকে প্রশস্ত করে তুলতে পারি। প্রতিটি দপ্তরের কাজের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে এবং পাচারকৃত টাকা ফেরত এনে রাষ্ট্রের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। বস্তুনিষ্ঠ শিক্ষাকে প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি শিক্ষাকে মানবিক করে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষাখাতে জাতীয় বাজেটের ২৫% বরাদ্দ করতে হবে। আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানি বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে এবং সেই সাথে দেশে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের আয়োজন করতে হবে। বন্ধ কলকারখানাগুলোকে পুনরায় চালু করতে হবে। যদি কেউ তার সম্পদের হিসাব দিতে না পারে তবে তার সম্পদকে বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় কোষাগাড়ে জমা দিয়ে তা প্রান্তিক গণউন্নয়ন কাজে ব্যয় করা যেতে পারে।
দেশের সাধারণ মানুষকে ভালো রাখতে হলে, দেশের উন্নয়নকে স্থিতিশীল রাখতে যে কোন মূল্যে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবিকে শক্তিশালী এবং সক্রিয় করতে হবে। দেশটাকে সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে একটি নিখুঁত পরিকল্পনা করে তার বাস্তবায়নের সর্বোচ্চ ত্যাগের মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে ঘুষ ও দুর্নীতি প্রতিরোধকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। কালো টাকা, ঋণ খেলাপির টাকা এবং বিদেশে পাচারকৃত টাকা উদ্ধার করতে পারলে আমরা ঋণমুক্ত স্বনির্ভর অর্থনীতির সমৃদ্ধ একটি দেশ গঠন করতে পারতাম, ভালো থাকতে পারতাম। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় আমরা অধিকার বঞ্চিত হয়ে থাকতে চাই না, আমরা ভালো থাকতে চাই, আমরা আমাদের অধিকারের নিশ্চয়তা চাই। দেশের কল্যাণে আমরাও ভূমিকা রাখতে চাই। একটা সম্প্রীতির উন্নত বাংলাদেশ চাই।