প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০
সেঁজুতি সাহা চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাইন্ডেশন, বাংলাদেশের অণুজীববিজ্ঞানী। এ দেশে টাইফয়েড, মেনিনজাইটিস ও অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স নিয়ে করেছেন মৌলিক গবেষণা। বাবা বিখ্যাত অণুজীববিজ্ঞানী সমীর সাহাকে নিয়ে এ দেশে করোনাভাইরাসের প্রথম জিনোম সিকোয়েন্স করেছেন। পেয়েছেন বিল ও মেলিন্ডা গেটসের ফাউন্ডেশনের স্বীকৃতি। নিজের কাজ, গবেষণা, ছেলেবেলা ও ব্যক্তিজীবন নিয়ে কথা বলেছেন বিজ্ঞানচিন্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সৌমিত্র চক্রবর্তী ও বিজ্ঞানচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসার।
-মেনিনজাইটিসের কারণ উদ্ঘাটন করতে গিয়ে কী কী গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানতে পেরেছেন?
সেঁজুতি সাহা : আমরা প্রথম ঢাকার ২৫টি নমুনা পরীক্ষা করেছিলাম, যেগুলোতে সাধারণ টেস্টগুলো, পিসিআর, আরটিপিসিআর, সাধারণ সিকোয়েন্সিং দিয়ে কিছুই পাওয়া যায়নি। আমরা এই অজানা নমুনার ১০টিতে জীবাণু খুঁজে পেয়েছি, অজানা জীবাণুর মেটাজিনোমিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে। এর মধ্যে তিনটিতে ছিল চিকুনগুনিয়া। এরপর আমরা আরও প্রায় ৫০০ টেস্ট করেছি। অনেক চিকুনগুনিয়া পেয়েছি। চিকুনগুনিয়া ভাইরাস যে মেনিনজাইটিস সৃষ্টি করে তা সারা পৃথিবীতে আমরাই প্রথম আবিষ্কার করি। বাকিগুলোতে ব্যাকটেরিয়া পেয়েছি, সঙ্গে অন্য কিছু ভাইরাসও পেয়েছি। আবার মেনিনজাইটিস সিএসএফ নমুনায় আমরা মাম্পস ভাইরাস পেয়েছি। তখন অনেকে জানত না যে মাম্পসের কারণে মেনিনজাইটিস হয়। মাম্পস কিন্তু ব্রেনে চলে যেতে পারে এবং রোগী স্বল্পমেয়াদে প্যারালাইজড হয়ে যেতে পারে। দেশে অনেক শিশুর মাম্পস মেনিনজাইটিস হয়, কিন্তু আমরা জানতেই পারি না। এর কোনো টিকাও বাংলাদেশে ইপিআই কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত নেই। আশাকরি শিগগিরই এটা বাংলাদেশে এসে যাবে।
-মেটাজিনোমিকস সম্পর্কে একটু জানতে চাই। সাধারণ পিসিআর বা ডিএনএ সিকোয়েন্সিং পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঙ্গে মেটাজিনোমিকসের পরীক্ষার পার্থক্য কেমন?
সেঁজুতি সাহা : পিসিআর করার সময় আমরা সুনিদিষ্টভাবে জানি যে কোন জীবাণুটা খুঁজছি। যেমন আমরা জানি, আমরা সার্স-কোভি-২ খুঁজছি। সেই অনুযায়ী আমার রিএজেন্টস এবং প্রাইমার তৈরি করি। কিন্তু অজানা মেনিনজাইটিসের ক্ষেত্রে আমরা জানিই না ঠিক কী খুঁজব! এটা মেটাজিনোমিকস সিকোয়েন্সিংয়ের চেয়ে অনেক আলাদা। এই টেকনিক কাজ করে সিএফএস স্পেসিমেন থেকে আরএনএ নিয়ে, যাতে করে আমরা সব জীবাণু ধরতে পারি। এরপর আমরা বের করি, কোনটা মানুষের দেহকোষ থেকে এসেছে আর কোনটা সত্যিকারের জীবাণু। কিছু গাণিতিক মডেলও এখানে ব্যবহার করতে হয়।
-ডেঙ্গু ও কোভিড- দুই ধরনের ভাইরাস নিয়েই আপনার আর্টিকেল আছে। এগুলোর মধ্যে স্ট্রাকচারাল জেনেটিক ও মেকানিজমের মধ্যে পার্থক্য আছে জানি। ফাইলোজেনেটিক নিয়ে বেশ কিছু কাজ করেছেন আপনি। তো এ দুই ভাইরাসের মধ্যে কোনো ফান্ডামেন্টাল পার্থক্য বা প্যাটার্ন আছে কি? যদি থাকে, তাহলে সেই নলেজ আমাদের কী কাজে লাগবে?
সেঁজুতি সাহা : একটা হলো বেটা করোনাভাইরাস আর ডেঙ্গু হলো ফ্লাভি ভাইরাস। সুতরাং দুটি ভাইরাস সম্পূর্ণ আলাদা। ডেঙ্গু ভাইরাসে প্রায় ১১ হাজার নিউক্লিওটাইড থাকে, সেখানে সার্স-কোভি-২-তে থাকে প্রায় ৩০ হাজার নিউক্লিওটাইড। সংখ্যাটা অনেক বড়। আমরা যখন সার্স-কোভি-২ নিয়ে কাজ করেছি, এটা নতুন ভাইরাস। অন্যদিকে ডেঙ্গু বহুদিন ধরে মানুষের মধ্যে বাস করছে। খুব কম সময়ে কোভিড নিয়ে বিশ্বজুড়ে অনেক কাজ হয়েছে। অথচ ডেঙ্গু নিয়ে সে রকম কাজ হয়নি। কারণ উন্নত বিশ্বে এ রোগ নেই। ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপ আছে, কারণ লম্বা সময় ধরে বিবর্তিত হতে পেরেছে।
-গেটস ফাউন্ডশনের সঙ্গে কাজ করার সময় বিল গেটস বা মেলিন্ডা গেটসের দেখা পেয়েছেন কি না? সেই অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
সেঁজুতি সাহা : হুম্ম, হয়েছে। তাঁদের ফাউন্ডেশনের সঙ্গে কাজ করেছি অনেক দিন। কিন্তু সেখানে তাঁদের সঙ্গে দেখা হয়নি। একদিন বাবার কাছে একটা মেইল এল যে বিল গেটসের কিছু জনবল বাংলাদেশে আসতে চায়। তারা জানাল, বাবা ও মেয়েকে নিয়ে বিল গেটস ছোট একটা ডকুমেন্টারি বানাতে চান। বিল গেটস মনে করেছেন যে আমাদের কাজ পৃথিবীতে বেশ ইমপ্যাক্ট ফেলেছে। এরপর তাঁরা কয়েক দিনের মধ্যে বাংলাদেশে এসে আমাদের শুট করে গেলেন। ওই ডকুমেন্টারি দেখে আবার মুগ্ধ হল বিল গেটস ফাউন্ডেশন। এরপর তাঁরা বললেন, গোলকিপারস নামে একটা বড় মিটিং হয়। আমি যেন বিল গেটসের সেশনে গিয়ে কিছু বলি। এর আগেই বিল গেটসের অফিস থেকে আমাকে জানানো হল যে, বিল গেটস সরাসরি আমার সঙ্গে একবার দেখা করতে চান।
সম্ভবত ৩০ বা ৪৫ মিনিটের একটা মিটিং ছিল। সাধারণত বিল গেটস ফাউন্ডেশনের কর্মীদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয় না। আমি যখন ফাউন্ডেশনে গেলাম, দেখলাম, গেটস ফাউন্ডশনের লোকজনই ভীষণ নার্ভাস। আমি কী নার্ভাস হব! তাদের অবস্থা দেখে আমার নার্ভাসনেস শেষ। এরপর বিল গেটস এলেন। তিনি খুব সিরিয়াস ও কিউরিয়াস একজন মানুষ। মনে হলো, আমার ব্যাপারে তিনি সব জানেন। তাঁর সঙ্গে নোট বই আর কলম ছিল। ট্যাব বা মুঠোফোন ব্যবহার করছিলেন না তখন। আমাকে একজন পরিচয় করিয়ে দিলেন গেটসের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমি তো সিকোয়েন্সিং করো। আমাকে একটু প্রসেসটা বলো তো।’ আমি বললাম। তখন বললেন, ‘কী বলো? তিন দিন লাগে সিকোয়েন্সিং করতে? অনেকেই বলে কয়েক ঘণ্টা লাগে। আমাকে বলো, কীভাবে এই সময় আমরা কমাতে পারি?’ বললাম, এটা কমানো সম্ভব নয়। তারপর আমি তাঁকে বোঝলাম। তিনি বুঝলেন। বললেন, ‘তোমাদের দেশে ডেঙ্গু আছে। জিকা নেই?’ আমি বললাম, না, নেই। তিনি বললেন, ‘কেন নেই?’ আমি অবাক! তাঁর তো খুশি হওয়ার কথা। বললাম, ‘আপনি কি চান আমাদের জিকা হোক?’ তখন তিনি একটু হাসলেন।
এ রকম ছিল তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ। সেদিন রাতেই চলে এলাম দেশে। দুই সপ্তাহ পরে গোলকিপারসে আমার উপস্থাপনা ছিল, নিউইয়র্কে। সেটাও আমার জন্য অনেক বড় একটা অভিজ্ঞতা। সেখানে একটা মজার ঘটনা ঘটল। একজন এসে বললেন, ‘তোমার স্পিচ আমি রেডি করে দেব।’ আমি গেলাম খেপে। স্পিচ দেব আমি, সেটা তুমি লিখবে কেন? এটাই নাকি ওখানকার নিয়ম। কিন্তু আমি অনড় রইলাম। বললাম, আমার স্পিচ আমি ঠিক করব। তুমি চাইলে এডিট করতে পার।
-টাইফয়েড নিয়ে আপনি কাজ করেছেন। সে ব্যাপারে সংক্ষেপে যদি কিছু বলেন।
সেঁজুতি সাহা : টাইফয়েডের জন্য দায়ী জীবাণুটির নাম সালমোনেলা টাইফি। এটাকে খুব ইন্টারেস্টিং জীবাণু মনে হয় আমার কাছে। কারণ, একসময় এমন কোনো দেশ ছিল না, যেখানে টাইফয়েড হয়নি। কিন্তু এখন অনেক দেশের মানুষ টাইফয়েড কী, জানে না। কারণ, সেসব দেশে এখন টাইফয়েড নেই। তবে বাংলাদেশে এখনো রয়ে গেছে। আমার ধারণা, ঢাকায় ৫০ শতাংশ মানুষের টাইফয়েড হয় জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে। এটা পানির কারণে হয়। বিভিন্ন জায়গার, বিশেষ করে স্যুয়ারেজের পানিতে জীবাণু পাওয়া যাচ্ছে বেশি। আমাদের দেশে স্যুয়ারেজ লাইনগুলো প্ল্যান করে বানানো হয়নি। এই কারণে টাইফয়েড নির্মূল করা যাচ্ছে না। আমরা চেষ্টা করছি, টাইফয়েড সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে। এর মধ্যে রয়েছে এই জীবাণুর ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট সম্পর্কে জানা এবং এর মেকানিজম আবিষ্কার করা, খুব সহজেই এদের উপস্থিতি নির্ধারণ করা এবং পৃথিবীকে সেসব জানানো ইত্যাদি।
-সঠিক মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করলেও জীবাণুর প্রতিরোধী হয়ে ওঠার কথা? সে ক্ষেত্রে করণীয় কী?
সেঁজুতি সাহা : আমাদের দেশে বাচ্চাদের ইনফেকশনের মাত্রা এত বেশি কেন? বাইরের দেশে বাচ্চাদের এত ইনফেকশন হয় না। মানুষের ঘর যদি দূরে দূরে হয়, তাহলে ইনফেকশন কমে যায়। এডুকেশন ও নিউট্রিশন লেভেল যত বাড়বে, ইনফেকশন তত কমে যাবে। যদি মা ও শিশুদের পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের ব্যাপারটা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে এটি কমানো সম্ভব। আমাদের দেশে অনেক সময় পুষ্টির দিকে নজর না দিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক খাইয়ে দেওয়া হয়।
-গণহারে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগসংক্রান্ত আপনার একটি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাই।
সেঁজুতি সাহা : এটা অনেক সাহস করে আমরা প্রকাশ করেছি। বাবাও অনেক সাহায্য করেছেন। এই আর্টিকেলে আমরা প্রচলিত চিন্তার বিপরীতে গিয়েছি। পাকিস্তানে ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টাইফয়েডের একটি আউটব্রেক চলছে, যার একমাত্র ওরাল চিকিৎসা অ্যাজিথ্রোমাইসিন অ্যান্টিবায়োটিক। ওরাল অ্যান্টিবায়োটিক ভালো কাজ করে বলে সাধারণত কেউ হাসপাতালে ভর্তি হয় না। একদিন আমার স্বামীর সঙ্গে রেজিস্ট্যান্স নিয়ে কথা বলেছিলাম মন খারাপ করে। আলোচনা করছিলাম, টাইফয়েড যদি অ্যাজিথ্রোমাইসিন রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যায়, তাহলে কী হবে? তখন সে আমাকে পরামর্শ দিল, ‘তোমার বাবা অনেক স্যাম্পল সংগ্রহ করেছেন, সেখানে খুঁজে দেখো না, কোনো স্যাম্পলে টাইফয়েডের জীবাণু অ্যাজিথ্রোমাইসিনের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্যান্ট হয়েছে কি না। কোনোটা রেজিস্ট্যান্ট হলে আমরা বুঝতে পারব, কী কারণে রেজিস্ট্যান্ট হয়েছিল।’ প্রায় এক হাজারটি স্যাম্পল খুঁজে বের করেছি। তার মধ্যে ১৩টি স্যাম্পল পেলাম অ্যাজিথ্রোমাইসিন রেজিস্ট্যান্ট। এইগুলোকে সিকোয়েন্সিং করে অ্যানালাইসিস শুরু করলাম। তখন জিনোমের মধ্যে একটামাত্র পয়েন্ট মিউটেশন পেলাম। সেটা দেখে মনে হলো, এটা অ্যাজিথ্রোমাইসিন রেজিস্ট্যান্স করতে পারে। পরে আমরা বিভিন্ন রকম এক্সপেরিমেন্ট করে দেখলাম, এই মিউটেশন যদি আমি টাইফয়েড থেকে সেনসেটিভ ইকোলাই ব্যাকটেরিয়াতে প্রতিস্থাপন করি, তাহলে ওটাও রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যায়। এই তথ্যগুলো বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে এরকম মৌলিক গবেষণার কথা কেউ চিন্তাই করতে পারে না। আমরা বলতে চাই, সুযোগ পেলে, বাংলাদেশ সব করতে পারবো। কে বলে, বাংলাদেশে মৌলিক গবেষণা হয় না!
অনেকে মনে করে, বাচ্চাদের একটা অ্যান্টিবায়োটিক খাইয়ে দিলেই হলো। তাহলেই তাদের মৃত্যুর হার কমে যাবে। ব্যাপারটার সত্যতা কতটুকু, তা যাচাইয়ের কথা কেউ ভাবেই না। জন্ম হলেই অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দিতে হবে। এই ট্রায়াল পাকিস্তানেও চলছে। বাংলাদেশেও শুনলাম এটা চলছে। সে সময় আমরা একটা প্রবন্ধ লিখলাম। কেন আমরা সব সময় না বুঝেই বাচ্চাদের এই ওষুধ খাইয়ে দিই? এটা নিয়ে স্রোতের বিরুদ্ধে আমাদের অনেক কাজ করতে হয়েছে।
-আপনি গেটস ফাউন্ডেশনের মতো বিদেশি ফাউন্ডেশনে ও দেশের অনেক ফাউন্ডেশনে কাজ করেছেন। এগুলোর তুলনামূলক সুবিধা ও অসুবিধা কী কী?
সেঁজুতি সাহা : আমাদের সব ফান্ডিং আন্তর্জাতিক। গেটস ফাউন্ডেশন এগুলোর অন্যতম। ডব্লিউএইচও আমাদের ফান্ডিং করে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কোম্পানি থেকেও সাহায্য পাই। বিভিন্ন দেশের সরকারও আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, যেমন জার্মানি, যুক্তরাজ্য। আমার জন্য সুবিধা-অসুবিধাটা বলা একটু কঠিন। তবে দেশে যদি সুষ্ঠুভাবে উপযুক্ত দলের কাছে অর্থ দেওয়া হয় এবং সঠিকভাবে অডিট করা হয়, তাহলে বাংলাদেশে অনেক মৌলিক গবেষণা হবে বলে আশা করি। সর্বোপরি কানাডায় আমার ১১ বছর পড়াশোনার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, গবেষণার ক্ষেত্রে আমাদের প্রজন্ম কোন অংশেই কম নয়।
-গবেষণার ক্ষেত্রে কী কী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন? বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের একজন নারীর ক্ষেত্রে এটা বোধ হয় আরও কঠিন।
সেঁজুতি সাহা : একটা কোম্পানি যে ট্যাক্স দেবে, একজন রিসার্চার কোনো গবেষণার উপকরণ আনার জন্য সেই ট্যাক্স কেন দেবে? আমার বেতনের চেয়ে ট্যাক্স বেশি দিতে হয়। এটা আমি কেন এবং কোথা থেকে দেব? এরপরও কাস্টমসে গবেষণার উপকরণ যদি মাসের পর মাস আটকে থাকে, তাহলে গবেষণা হবে কেমন করে! একজন গবেষকের জন্য সময় খুবই মূল্যবান। আমরা হয়তো মিটিং করে ঠিক করলাম এই এক্সপেরিমেন্টটা করব। সবাই এটা নিয়ে উত্তেজিত, হ্যাঁ, এটা করতে হবে। তার জন্য যন্ত্রপাতি বা প্রয়োজনীয় জিনিস অর্ডার দিলাম। কিন্তু তা ল্যাবে পৌঁছানোর আগে কাস্টমসে আটকে ছিল তিন মাস।
এ রকম দেরিতে এলে ল্যাবের কর্মীদের মধ্যে আগের মতো উদ্দীপনা থাকে না। কিন্তু বিদেশে আজ রাতে অর্ডার দিলে আগামীকাল সকালে ল্যাবের সামনে দিয়ে যায়। তারা গবেষকদের খুব মূল্যায়ন করে।
আরেকটা ব্যাপার হল, আমরা এখানে বসে বিদেশের জার্নালগুলো পড়তে পারি না। জার্নালের একটা নিবন্ধ পড়তে ৩০ মার্কিন ডলার খরচ হয়। এটা তো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এভাবে কয়টি নিবন্ধ পড়ব।
এরপর অনেক কষ্ট করে গোটা দল মিলে একটা নিবন্ধ লিখলে, সেটা প্রকাশ করতে ৩ থেকে ১০ হাজার ডলার পর্যন্ত খরচ করতে হয়। এটা কি সম্ভব? দেখা গেল, আমি কাজটা করেছি তিন হাজার ডলার খরচ করে। কিন্তু প্রকাশক এটার জন্য চায় ৪ হাজার ডলার। তৃতীয় বিশ্বের সমস্যা হলো, আমি পড়ার জন্যও টাকা দিচ্ছি আবার আমার কাজের ফলাফল প্রকাশ করার জন্যও টাকা দিচ্ছি।
তারপর ভাষা নিয়েও একটা সমস্যা আছে। আমরা চেষ্টা করছি, কীভাবে বাংলা ভাষায় লেখা প্রকাশ করা যায়। বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিও থাকতে পারে। ল্যানসেট জার্নালে আমাদের এরকম একটা দ্বিভাষিক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। (নিবন্ধটার লিংক : cutt.ly/TTamZ4n)
-নারী হিসেবে আপনার কী চ্যালেঞ্জ ছিল?
সেঁজুতি সাহা : আমার পিএইচডির সুপারভাইজর ছিলেন দুজন। তাঁরা আবার স্বামী-স্ত্রী। আমাকে খুব স্নেহ করতেন। যখন তাঁদের বললাম যে আমি বাংলাদেশে ফিরে যাচ্ছি, নিজের দেশের হয়ে কাজ করব। তাঁদের প্রথম প্রশ্ন ছিল, ‘তোমার স্বামীকে রেখে চলে যাচ্ছ?’ তাঁরা আমাকে জিজ্ঞাসা করেননি, কী কাজ পেয়েছ? কোথায় কাজ করবে? কীভাবে কাজ করবে? কিন্তু আমার স্বামী যখন কোথাও যায়, তখন প্রশ্নটা পাল্টে যায়। বলে, ‘তোমার বউ যাচ্ছে সঙ্গে?’ ওটা আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে। বাড়িতে ফেরার পর মা-বাবা আমাকে অনেক সাপোর্ট করেছেন। কিন্তু দেশে আসার পর সবাই বলছেন, স্বামীকে ওখানে রেখে এসেছো? এভাবে সংসার চলে? মানে মনে হচ্ছে, আমি ইচ্ছা করে সংসার ভাঙছি। এটা সমাজের অনেক মানুষকে বোঝানো যায় না। আমি কিন্তু তাঁদের জন্যই এসেছি। আবার কোনো কারণে যদি সংসারে কোনো সমস্যা হয়, দেখা যাবে, তাঁরাই এসে বলবেন, ‘বলেছিলাম না। সংসারটা তো এ রকম করেই ভাঙল।’
আমি বিদেশে যাওয়ার আগে বলেছেন, ‘মেয়েকে দেশের বাইরে পাঠাবে?’ আবার যখন আমি ফিরে এসেছি, তখন বলেন, ‘স্বামীকে রেখে চলে এসেছে?’ সুতরাং আমাদের জায়গাটা আসলে কোথায়? প্রথম কয়েক দিন এটা খুব কষ্ট দিয়েছে আমাকে। একবার আমার স্বামীকে ফোন দিয়ে অনেক কান্নাকাটি করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তুমি কি আমাকে ছাড়া সত্যিই অসুখী? তুমি চাও না আমি দেশে থাকি?’ সে এখন যুক্তরাজ্যে থাকে। অসাধারণ একজন বিজ্ঞানী সে। সম্পূর্ণ মৌলিক গবেষণা করে। আমার প্রশ্নের জবাবে সে বলে, ‘আমি যে বাংলাদেশে না গিয়ে যুক্তরাজ্যে এসেছি, এটা কি তোমার খারাপ লেগেছে?’ আমি বললাম, না, তোমার তো ওখানে অনেক ভালো সুযোগ আছে। সে বলল, ‘আমি যুক্তরাজ্যে আছি। কারণ, এখানে ভালো সুযোগ আছে। তোমার ক্ষেত্রেও তা-ই। দেশে তোমার ভালো লাগে। তুমি দেশে কাজ করো। এতে আমি অসুখী কেন হব?’ আমার পরিবার আমাকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছে। আমার স্বামী ও আমার ভাইও অনেক সাপোর্ট করেন।
-বই পড়ার সময় পান?
সেঁজুতি সাহা : খুব চেষ্টা করি বই পড়তে। কিন্তু ইদানিং শেষ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তবে ছোট ছোট প্রবন্ধ পড়ি বা অডিও বুক শুনি।
-একটা বইয়ের নাম বলবেন, যেটা সবার পড়া উচিত?
সেঁজুতি সাহা : জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী। আরেকটি দ্য এমপেরর অব অল ম্যালাডিজ : আ বায়োগ্রাফি অব ক্যানসার বইটি আমার অসম্ভব ভালো লেগেছে। এটা বাংলায় অনুবাদ হয়েছে। আরেকটা প্রিয় বই হলো টুয়েসডেজ উইথ মোরি।
-আমাদের অনেক তরুণ পাঠক আছেন। তাঁদের উদ্দেশে যদি কিছু বলেন। আর তাঁরা কেউ যদি আপনাদের ফাউন্ডেশনে কাজ করতে চান, তাহলে কী করতে হবে? বা কেউ যদি গবেষক হতে চান, তাহলে কী করতে হবে?
সেঁজুতি সাহা : বিজ্ঞান প্রজেক্ট নিয়ে উৎসব হতে পারে। সেখানে আমরাও থাকতে পারি। তবে আমাদের এখানে যাঁরা কাজ করতে আসেন, অধিকাংশই অনার্সের শিক্ষার্থী। আমার কাছে যাঁরা কাজ করেছেন, তাদের অধিকাংশই মেয়ে। খুব ভালো কাজ করেন তাঁরা। ঢাকার বাইরের অনেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে আমি কথা বলেছি। তাঁরা মনে করেন, বিজ্ঞানী নাকি হওয়া যায় না, এটা জন্মগত প্রতিভার ব্যাপার। তাঁদের এই ভুল ধারণা ভাঙাটা জরুরি। আমি চাই একটা প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করতে, যেখানে নবমণ্ডদশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নিয়ে কিছু করব। তারা আমাদের সঙ্গে ১০ দিন থাকবে এবং আমাদের কাজ দেখবে। শুধু দেখাই তাদের কাজ। এটা আমরা বিজ্ঞানচিন্তার সঙ্গে যৌথভাবেও করতে পারি। এটা চাইলে আমরা স্কুলের সিলেবাসেও যোগ করে দিতে পারি। তাহলে বড় একটা পরিবর্তন হবে।
সূত্র : বিজ্ঞানচিন্তা।