বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০২৩, ০০:০০

জীবনের গল্প
মাহমুদ হাসান খান

সময়টা ১০ আগস্ট ১৯৫৯। সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিট। এই সুন্দর পৃথিবীতে আমার আগমন। তারপর পথ চলতে থাকা। একে একে একটি করে দিন ফুরাতে থাকল। শুরুটা স্বাভাবিক নিয়মেই রাজকীয়ভাবে শুরু। জমিদার সাহেব মার উষ্ণতা নিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকা ছাড়া আর কোন কাজ নেই। যা কিছু প্রয়োজন চিৎকার করে কান্না করলেই সব হাজির। এভাবে বছর গড়িয়ে দাঁড়াতে শিখা। আর নামধাম আরও কত কী সব কাজ শেষ। কিন্তু নিজের নাম জানতে সময় লেগে গেল ২ বছর। কিন্তু বুঝতে লাগল আরো ১ বছর যে মাহমুদ হাসান খান আমার নাম। তবে একটা ডাক নাম রাখা হলো ‘বিপ্লব’ বোনরা সবাই ডাকত ভাইয়া আজও তারা ভাইয়াই ডাকে। তবে বিপ্লব নামটি সময়ের কালক্রমে হয়ে গেল ‘বিপু’।

এবার বিপ্লব নামের কারণটা বলি। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানি সামরিক শাসক আইয়ুব খান পুরো পাকিস্তানে প্রথম মার্শাল ল চালু করেন। মার্শাল লর শুরুতে সামরিক সরকার নতুন নতুন বিপ্লব ঘটান। তাই জন্ম যেহেতু ১৯৫৯ সালে ডাক নাম হয়ে গেল ‘বিপ্লব’। তবে আইয়ুবের এই সামরিক বিপ্লবে বাবার ঔষধ ব্যবসার প্রচণ্ড ক্ষতি হলো। সামরিক শাসন হলে যা হয়। বিদেশ থেকে আমদানি করা সব ঔষধ চেক করতে গিয়ে ভেঙ্গেচুরে তছনস করে দিল।

তারপর বাবার আর্থিক অনটন। এরপর আমার বেড়ে উঠা তৃতীয় শ্রেণি থেকে একটু একটু বুঝতে শিখা। মাই আমার প্রথম শিক্ষক। সুন্দর করে স্কুলে যাওয়ার আগে কাপড়-চোপড় পরিয়ে দিতেন সাথে বড় ৪ বোন তো আছেই। তারা স্কুলে যাওয়ার সময় আমাকেও সাথে নিয়ে যেত তাদের সাথে। বড় বোনদের বান্ধবীদের আমাকে নিয়ে টানাটানি। কে আমাকে কার পাশে বসাবে, তাই নিয়ে কাড়াকাড়ির মধুর স্মৃতিটা বেশ ভালোই মনে আছে। আর চকলেট কিনে দেয়ার গল্প ত বলার অপেক্ষা রাখে না। কে কার আগে কোলে নিয়ে আদর করবে সে প্রতিযোগিতা ছিল বেশ মজার। কত আদর আর ভালবাসা। আজও কিছু কিছু মনে হলে বেশ ভালোই লাগে। এর মাঝে একটা মজার ঘটনা আছে। তা হলো স্কুল থেকে ফেরার পথে হঠাৎ বাসার সামনে বড় ড্রেনে পড়ে যাই। তখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। ৫ম শ্রেণির পর থেকে মোটামুটি সব স্মৃতিই মনে আছে পরিষ্কার। শিশু শ্রেণি থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত চাঁদপুর গণি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ি। ৫ম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষা দেয়ার একটা বিষয় ছিল। বৃত্তি দেয়ার শর্ত ছিল ক্লাসের প্রথম ৫ জন বৃত্তি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পাবে। তাই বার্ষিক পরীক্ষা দেয়ার পর বৃত্তি পরীক্ষা দেয়ার প্রস্ততি শুরু। চার বিষয় পরীক্ষা দিতে হবে (বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক আর বিজ্ঞান)। মোটামুটি বৃত্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ছিল সেইসময় অনেক কঠিন। তারপরও পরীক্ষা দিয়ে বেশ খুশি। কারণ সেই সময় বৃত্তি পরীক্ষা দেয়াটাই ছিল বেশ গর্বের একটা ব্যাপার। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে সবাই মিলে নানার বাড়ি বেড়ানোটা ছিল সেই সময়ে সারা বছরের একটা বড় আকর্ষণ। মামাতো খালাত ভাইবোন মিলে বয়স ভেদে বাগানে ঘুরা, পুকুরে মাছ ধরা, সবাই মিলে পুকুরে গোসল করা আর খাবার সময় বয়স ভেদে খাবার জন্য অপেক্ষা করা সব কিছুর মধ্যেই ছিল আনন্দ আর আনন্দ । এভাবেই ৮/১০ দিন মনের সুখে মহাআনন্দে কেটে যেত। এই সময়টাতে মা-খালা আর মামিরা ছিলেন ৪ জন মোট ৬ জনের রান্না তদারকি। খুব ভালো লাগত সবার মুখে ছিল হাসি। কোন ক্লান্তি ছিল না চেহারায়। বিরক্তি কী জিনিস তারা জানত না। আমরা সব মিলিয়ে ভাইবোন ছিলাম প্রায় ৫০ জন। কাঁচা রস খাওয়ার জন্য খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে যাওয়া আর রসে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকা। কখন রস পেরে নামিয়ে নামবে গাছ থেকে। প্রায় ৪০ কলস রস হতো। মামিরা সবগুলো হাঁড়ির রস এক পাত্রে নেয়ার পর আমাদের ছেঁকে গ্লাসে করে দিতেন। আমাদের খাওয়া শেষে বাকিটুকু গুড় তৈরি করতেন। আসার সময় আবার বোতল ভরে রসের গুড় দিয়ে দিতেন। নানার বাড়ির পিঠা আর মামিদের হাতের রান্না আজও মনে জিহ্বায় লেগে আছে। এত মজার রান্না আজও খুব কমই খেয়েছি। এছাড়া নানা বাড়ির সুখ স্মৃতির কথা শেষ করা যাবে না। নানার বাড়ি মানেই আজও একটা মিষ্টি অনুভূতি। নানার মসজিদের পয়সা গুণে দেয়া। হাটের দিন মামার সাথে বাজারে যাওয়া। নানুর সুপারি কেটে পান ছেছে দেয়া এরূপ খণ্ড খণ্ড অনেক স্মৃতি সবসময়ই মনে পড়ে। কত নির্মল আর সহজ সুন্দর ছিল সেই সময়ের জীবন। তারপর আবার যার যার বাসায় ফিরে যাওয়া। নানার বাড়ি ছিল মুদাফ্ফরগঞ্জ। এখানে বলতেই হয় আমার শ্রদ্ধাভাজন নানা ছিলে ব্রিটিশ সরকারের প্রেসিডেন্ট এবং সরকার কর্তৃক গোল্ড মেডেল পাওয়া একজন মানুষ। নানা প্রাপ্তি সেই সার্টিফিকেটটা আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। যা বর্তমানে আমার সংরক্ষণে আছে। কেউ ঢাকা আবার কেউ কুমিল্লায়। আমরা চলে আসতাম চাঁদপুর। এরপর ৫ম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ। এবার বাবা জানালেন ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য কুমিল্লা রেসিডেন্টসিয়াল স্কুল এন্ড কলেজে প্রথম ব্যাচ (১৯৭০), যা বর্তমানে কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ। কুমিল্লায় ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাব ব্যাপারটা বেশ শিহরণময় মনে হচ্ছিল। খুব ভোরে নাস্তা সেরে বাসে চড়ে বাবার হাত ধরে কোটবাড়ি, কুমিল্লা পৌঁছে যাই সকাল ৯টার মধ্যে। ১০ টায় পরীক্ষা শুরু। দুপুর ১ টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টার লম্বা ভর্তি পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষে বাবা নিয়ে গেলেন বার্ডে। দুপুরের খাবার খাব। নতুন অভিজ্ঞতা! নিজের খাবার লাইনে দাঁড়িয়ে নিজে গ্রহণ করা। যাই হোক, দুপুরের লাঞ্চ শেষে বাবা বার্ড ঘুরিয়ে দেখালেন। সেই সময় সবচেয়ে বেশি অবাক লেগেছে ছোট ছোট গাছে প্রচুর আম ধরে আছে দেখে। ছোট মানুষ ভাবছিলাম এত ছোট গাছে এত আম ধরে কী করে। ঘুরাঘুরি শেষে বিকাল ৩টায় ফলাফল প্রকাশ এর সময়। তখন কিছুটা নার্ভাস মনে হচ্ছিল নিজকে। না জানি আমার রোল নাম্বারটা ফলাফল প্রকাশ এর তালিকায় দেখতে পাব কি না। ভিতরে চাপা উত্তেজনা। যদি না টিকি বাবা কী বলবেন? যাক বাবা বলল, তুমি টিকেছ। সে কি আনন্দ বুঝাতে পারব না। এরপর এবার ডাক্তারি পরীক্ষা। ভাবলাম সে আবার কি! আনন্দ চুপসে গেল মুহূর্তে। যাক অবশেষে সেই পরীক্ষা ও উত্তীর্ণ হয়ে মহাখুশি। তারপর বাবা আবার বার্ডের ক্যাফেটেরিয়াতে বিকালের নাস্তা করালেন। এবার আর অবাক হইনি। নিজের নাস্তা আর চা নিজেই এনে বাবার সাথে বসে মনের আনন্দে নাস্তা শেষে কখন চাঁদপুর ফিরব সেই উত্তেজনা! কখন আসব কখন মা বেনদের আনন্দ সংবাদ শুনাব তাই মনটা বড় অস্থির।

কুমিল্লা রেসিডেন্সিয়াল স্কুল এন্ড কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ভর্তি হওয়ার ফরম আর প্রসপেক্টাস নিয়ে একটা খাম বাবার হাতে নিয়ে রওনা হলাম চাঁদপুর এর পথে। কোটবাড়ি থেকে কান্দিরপাড় রিকশায়। কারণ তখনও ঐ পথে কোন গাড়ি চলে না। আর বাস ছাড়ত কান্দিরপাড় থেকে। ঘন বন-জঙ্গলে ভরা দুপাশ। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। পথ ত শেষ হয় না। যাই হোক কান্দিরপাড় এসে অবশেষে চাঁদপুরের বাসে উঠা। সেই ১৯৭০ সালে বাসে কুমিল্লা থেকে চাঁদপুর আসতে সময় লাগত ৩/৪ ঘণ্টা। যাই হোক রাতে বাসায় এসে পৌঁছলাম। পরদিন আর বাবা তেমন কিছু বলল না। চুপচাপ! আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। এদিকে স্কুলের প্রসপেক্টাসটা পড়লাম খুব মনোযোগ দিয়ে। যা বুঝলাম, বছরে ৩ সেট স্কুল ড্রেস, ৩ জোড়া সাদা পিটি সু, ২ জোড়া কালো জুতা, ৪ খান সেন্ডু গেঞ্জিসহ বিরাট একটা লিস্ট। তার উপর প্রতি ৩ মাস পরপর ৪০০ টাকা (হোস্টেল+বেতন)। তখনও বুঝিনি কী হতে যাচ্ছে ! ২ দিন পর সকালে জানতে চাইলে বাবা বলেন, আমার পক্ষে এত টাকা দেয়া সম্ভব না। তখন আর কী বুক ফাটা চিৎকার করে আমার কান্না। মাঝে আছে আরো অনেক কষ্টের কথা। নাই বা লিখলাম। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। কী আর করব সবই নিয়তি। বাবাকে বললাম আমি আর গণি স্কুলে পড়ব না। বাবা আমার কথা রাখলেন। আমাকে হাসান আলী স্কুলে হেড স্যারের কাছে নিয়ে গেলেন। ওনি আমার গণি স্কুলে ৫ম শ্রেণির প্রোগ্রেস রিপোর্ট দেখে ভর্তি হওয়ার সুযোগ করে দিলেন। কিন্তু আমার এই স্কুলে পড়ালেখায় মন বসছে না। আমি সেই কুমিল্লা রেসিডেন্সিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের স্বপ্নই দেখছি। কী সুন্দর বিশাল ক্যাম্পাস। হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া। বিশাল খেলার মাঠ। চারিদিকে পাহাড়। যাই হোক দেখতে দেখতে হাসান আলী স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পাঠ শেষ। আর গণি স্কুলে থাকা অবস্থায় হাতেখড়ি বাস্কেটবল খেলাই ছিল আমার প্রচণ্ড নেশা। বিকালে চাঁদপুর সরকারি কলেজ মাঠের বাস্কেটবল গ্রাউন্ডটা ছিল সেই ছোট বেলা থেকেই জীবনের একটা অংশ। বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ। যথারীতি ভালো ফলাফল নিয়ে ৭ম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ। ১৯৭১ সাল তখন চাঁদপুরে একমাত্র সরকারি বিদ্যালয় ‘চাঁদপুর গভ. টেকনিক্যাল হাই স্কুলে’ ভর্তি পরীক্ষা দেই ৩ জন মাত্র নেয় ৭ম শ্রেণীতে। আমি সুযোগ পাই। বাবা ভর্তি করিয়ে দিলেন। বাসা থেকে ৬ কি.মি. দূরে। আসা-যাওয়া বাসে না হয় পা হেঁটে। তাও বেশ ভালো লাগছিল সরকারি স্কুলের ছাত্র হিসাবে। আর ওই সময় টেকনিক্যাল স্কুলের ফলাফল ছিল বোর্ডে বেশ ভালো। বাসা থেকে স্কুলে আসা যাওয়ার জন্য ২৫ পয়সা দিত। ১০ পয়সা যেতে আর ১০ পয়সা আসর বাস ভাড়া আর ৫ পয়সা টিফিন করার জন্য। এভাবেই চলতে থাকল। চাঁদপুর কলেজের সামনে বাসা হওয়ার সুবাদে ঐ সময় ৬৯-এর গণঅভুথ্যান, ৭০-এর ছাত্রদের মিছিল মিটিং দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। প্রচণ্ড স্লোগানে স্লোগানে মুখর থাকত আমার বাসার সামনটা। এমনি করেই মার্চ ৭১ চলে আসে। ৭ মার্চ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেডিওতে শুনি বাবার সাথে। তখনও তেমন কিছু বুঝিনি। কী স্বাধীনতা। কী বাংলাদেশ। শুধু চারিদিকে একটাই আওয়াজ শেখ মুজিব শেখ মুজিব।

(চলবে...পরের পর্ব আগামী সংখ্যায়)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়