প্রকাশ : ২১ জুন ২০২৩, ০০:০০
মানুষ মরণশীল। জন্ম নিলেই মরতে হবে এই কথাটার চেয়ে নিছক সত্য দুনিয়াতে আর কিছুই হতে পারে না। সবাইকে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে যেতেই হবে। কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু সমাজের জন্য অভিশাপ ও কলঙ্কজনক। বলার অপেক্ষা রাখে না, নিশ্চয়ই সেটা আত্মহত্যা। ‘আত্মহত্যা’ বা ‘Suicide’ শব্দটি এসেছে দুটি ল্যাটিন শব্দ থেকে। ‘sui’ অর্থাৎ নিজেকে এবং ‘Caedere‘ অর্থাৎ কিলিং বা হত্যা করা। এককথায়, ইচ্ছাকৃতভাবে নিজে নিজেকে হত্যা করা বা মেরে ফেলার প্রতিক্রিয়াকে আত্মহত্যা বলে।
জীবন একটি অমূল্য সম্পদ। জীবন নিয়ে খেলা নয়। একবার মৃত্যু হলে এই প্রাণ আর ফিরে আসে না। হাজার চেষ্টা করলেও না। সমাজের মধ্যে দিন দিন আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। এর জন্যে সমাজ যে রকম দায়ী তেমনিভাবে আত্মহত্যাকারী ব্যক্তিও দায়ী। সামান্য রাগ-অভিমানের কারণে কত তরুণ-তরুণী নিজের জীবনকে শেষ করে দিচ্ছে অযথা। প্রতিদিন সারা দেশে অন্তত ২৮-৩৫ জন মানুষ আত্মহত্যা করছে। জীবনের করুণ খেলায় তারা হার মেনে যাচ্ছে নির্দ্বিধায়। হতাশা বা বিষণ্নতাই আত্মহত্যার প্রধান কারণ। যা মানসিক রোগ হিসেবেও বিবেচিত। অধিক রাগ-জিদ, শোষণ-বঞ্চনা, পারিবারিক-কলহ, মাদক সেবন, কর্মসংস্থানের অভাব, পরীক্ষায় অকৃতকার্যতা, যৌন নির্যাতন, বেকারত্ব ও প্রেমণ্ডভালোবাসায় ব্যর্থতার কারণেও অনেকে আত্মাহত্যার শিকার হয়।
এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ২০১০ সালে ৯ হাজার ৯৬৫ জন, ২০১১ সালে ৯ হাজার ৬৪২জন, ২০১২ সালে ১০হাজার ১০৮ জন, ২০১৩ সালে ১০ হাজার ১২৯ জন, ২০১৪ সালে ১০ হাজার ২০০ জন, ২০১৫ সালে ১০ হাজার ৫০০ জন, ২০১৬ সালে ১০ হাজার ৬০০ জন আত্মহত্যা করেছে। এর মধ্যে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যাই বেশি। ইভটিজিং, ধর্ষণ, শারীরিক, মানসিক ও প্রেমসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে নিজেকে সামলাতে না পেরে নারীরা আত্মহত্যাকে বেছে নেয়। আত্মহত্যাকারী ব্যক্তিদের মধ্যে ১৬ থেকে ২৯ বয়সের সংখ্যাই বেশি।
এই আত্মহত্যার প্রথা থেকে আমাদের সমাজের তরুণ-তরুণীকে রক্ষা করতে হবে। রক্ষা করতে হবে তাদের সুন্দর ও শিশুসুলভ জীবনকে। নাহলে সমাজের তরুণ-তরুণীরা দিন দিন আত্মহত্যার কবলে পড়ে যাবে। এই আত্মহত্যা শুধু ব্যক্তি-বিশেষেরই ক্ষতি ডেকে আনে না, ক্ষতি ডেকে আনে পরিবার, সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রের।
আত্মহননকারী ব্যক্তি জীবনের নানামুখী হতাশা, বিষণ্নতা, সঙ্কট থেকে নিজেদেরকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আত্মহত্যা করে থাকে। তাতে বীরত্ব, কৃতিত্ব ও মহত্ত্ব বলতে কিছুই থাকে না। বরং মৃত্যুর পরও তারা সমাজের কাছে বঞ্চনা ও লাঞ্ছনার শিকার হয়। ইসলাম ধর্মে আত্মহত্যা করাকে মহাপাপ বলা হয়েছে। পৃথিবীর সকল ধর্মই আত্মহত্যাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। কারণ, আত্মহত্যা সকল সমস্যার সমাধান নয়।
আজ পৃথিবীর হাজার হাজার তরুণ-তরুণী ডিপ্রেশন নামক মহামারীতে ভুগছে। যার ফলে তাদের মস্তিষ্কের মধ্যে এক ধরনের বিষক্রিয়া তৈরি হয়। যার প্রভাবে তারা জীবনের সমস্যার সমাধান হিসেবে আত্মহত্যাকে গ্রহণ করে থাকে। এটি একটি ভুল ও সাংঘাতিক সিদ্ধান্ত। আত্মহত্যায় কি সকল সমস্যার সমাধান হতে পারে? মোটেই নয়। এটি নিতান্তই মিথ্যা। এই অনীতিবাক্যকে আমাদের জীবন ও সমাজ থেকে পরিহার করতে হবে ।
বিষণ্নতা ও হতাশা একজন ব্যক্তিকে আত্মহত্যার মুখে ঠেলে দেয়। এসব কারণে মানুষ কখন কোন্ সিদ্ধান্ত নেয় তারা নিজেরাও বলতে পারে না। তখন তারা তাদের জীবনকে জীবন মনে করে না, তুচ্ছ মনে করে। এই বিষণ্নতা ও হতাশা থেকে তরুণ সমাজকে বাঁচাতে হলে সমাজের সচেতন মানুষদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। নাহলে সমাজকে রক্ষা করা দুষ্কর হয়ে যাবে। আত্মহত্যা নামক অভিশপ্ত প্রথা দিন দিন তরুণ সমাজকে খাবলে খাবলে খাচ্ছে। শেষ করে দিচ্ছে তাদের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষাকে। একটি তরুণ চলে যাওয়া মানেই পৃথিবী এক ধাপ পিছিয়ে যাওয়া। তরুণ সমাজ বাঁচলে পৃথিবী বাঁচবে। কারণ, তাদের মাঝে সুন্দর স্বপ্ন লুকিয়ে আছে। একটি পৃথিবী একটি তরুণকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। পৃথিবী তাদেরকে নিয়েই এগিয়ে যেতে চায়।
যে দেশ ও মানুষকে ভালোবাসে, পরিবার-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধবকে ভালোবাসে তার পক্ষে আত্মহত্যা করা খুবই কঠিন। কোনো কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, গবেষক, মনীষী, পণ্ডিত, দার্শনিক কেউই জীবনের সঠিক সংজ্ঞা দিতে পারেনি। জীবনকে সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না বলেই জীবন এতো তাৎপর্যপূর্ণ বৈচিত্র্যময়। মহান দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন, ‘ নিজেকে চেন ‘। কোনো মানুষই নিজেকে চিনতে পারে না । চেনার চেষ্টাও করে না। যখন কেউ নিজেকে চিনে এবং নিজেকে জানতে পারে তখনই তারা নিজের জীবনকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। তারা বুঝতে পারে আত্মহত্যা শুধু জীবনকেই পরিসমাপ্তি করে, তার বিনিময়ে কোনো প্রাপ্তিই অর্জন করা যায় না। তাই নিজেকে নিজে জানতে হবে এবং নিজের জীবনের প্রতি যত্নশীল হতে হবে।
আত্মহত্যা মহাপাপ। আত্মহত্যার মাধ্যমে কোনো শিক্ষাই পাওয়া যায় না। আত্মহত্যা ছাড়াও জীবনের অনেক সমস্যার সমাধান করা যায়। জীবনের পার্থিব সুখ অর্জন করতে হবে। আমাদের পরিবার, সমাজ ও দেশ আমাদের কাছ থেকে অনেক কিছুই আশা করে। তাই জীবনের কঠিন পদক্ষেপেও নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হবে। জীবনের সমস্যা ও সংকট মোকাবিলা করার মতো শক্তি ও আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে। মোটকথা, আত্মহত্যা থেকে জীবনকে রেহাই দিতে হবে। জীবনে যতই কঠিন সঙ্কট আসুক না কেন, তাতে নিজেকে পিছু পা করলে হবে না। সকল সঙ্কট ও দুর্বিষহ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে নিজেকে নিজের আত্মসুখে বলীয়ান করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আত্মহত্যা শুধুই অভিশাপ, আর অন্য কিছু নয়। আত্মহত্যা করে নিজের জীবনের সিদ্ধি অথবা প্রাচুর্য কিছুই অর্জন করা যায় না। উল্টো সমাজের মানুষের কাছে বঞ্চনা ও লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়।
জীবেনের প্রতিটি পরতে পরতে আবেগবান হওয়া যাবে না, অবশ্যই বিবেকবান হতে হবে। অতিরিক্ত আবেগী মানুষগুলাই জীবনের কঠিন সঙ্কটে আত্মহত্যাকে বেছে নেয়। আর বিবেকবান মানুষগুলোই আবেগের সাথে লড়াই করে, সবকিছুকে উপেক্ষা করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। তাই চারপাশের সমাজ ও পরিবেশ থেকে শিক্ষা নিন। বিবেকবান হোন। এটাই জীবন। তাই আত্মহত্যা নয়, জীবনকে ভালোবাসুন।
লেখক : শিক্ষার্থী, হাজীগঞ্জ সরকারি মডেল কলেজ।