প্রকাশ : ১১ মে ২০২৩, ০০:০০
বেলা বয়ে যায় চাঁদপুর ডাকে আমায়
![বেলা বয়ে যায় চাঁদপুর ডাকে আমায়](/assets/news_photos/2023/05/11/image-32849.jpg)
বয়স যত বাড়ে, ততই তার মৃত্তিকার মোহ বৃদ্ধি পায়! যে মাটিতে ভূমিষ্ট হলো জীব, সে ভূমিতেই ফেরার তার দুর্নিবার আকাংখা ! মাঝখানে কিছুটা সময়। অর্থাৎ জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণ! যে মধ্যবর্ত্তী জায়গায় এখন আমি অবস্থান করছি ! আবার এও হতে পারে মরণের প্রান্তিক সীমানায় দাঁড়িয়ে আমি! অসময়ে জীবনের পরিসমাপ্তি!
|আরো খবর
জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় আমার শৈশব ও কৈশোর। মাত্র ১৫ বছর। অথচ কত তাৎপর্যময় আমার কাছে! যে ভূমিতে আমার জন্ম, তাকে ভূলে যেতে পারিনি আমি, পারিও না, আমার জন্মভূমির কাঁদামাটির ঘ্রাণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে! মৃত্তিকার টান আমার এতোটাই তীব্র যে, জন্মভূমি চাঁদপুরের কোনো প্রসঙ্গ এলে কেমন জানি হয়ে যাই আমি! প্রচণ্ড আবেগ সে সময় খেলা করে। ছেলেবেলার বিদ্যাপীঠ গণি আদর্শ বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০০ বছর উদযাপনের বছরে চলে গেছি চাঁদপুরে! চাঁদপুর মহাবিদ্যালয়ের ৭৫ বছরপূর্তি উৎসবে সময় কাটিয়েছে কৈশোরের সহপাঠীদের সঙ্গে।
গণি আদর্শ বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পাঠ শেষ করেছি। বেশ অল্প বয়সেই এ বিদ্যালয়ে পড়াশুনায় আমাদের ১০টি ভাইবোনের হাতেখড়ি। ৬ বোন এবং ৪ ভাইয়ের সবাই ছিলেন কুমিল্লা রোডে অবস্থিত চাঁদপুর গণি আদর্শ বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বড় পরিবারের প্রায় সবারই শিক্ষার মূল ভিত্তি তৈরি করেছে ১০৫ বছরের এ বিদ্যালয়। আমাদের লেখাপড়া বর্তমান কালের মতো বাণিজ্যিক ছিলো না। গণি স্কুলের শিক্ষকদের অনেকেই বাড়ীতে বাড়ীতে গিয়ে লেখাপড়ার খোঁজখবর নিতেন। এরমধ্যে প্রাথমিক শ্রেণীর শিক্ষক ছোট মজিদ স্যার অন্যতম।
স্কুল পেরিয়ে পিছনে নদীর সীমানা অবধি কোড়ালিয়া রোড। সে সড়কের মাঝখানে রমেশ দত্তবাড়ী। পালের বাজারের মুদী দোকানদার নিমাই দত্তের টিনের ভাড়া ঘরে আমাদের মজুমদার পরিবারের বসবাস। সাহাবাড়ীর পাশ ঘেষে পশ্চিম দিকটায় ভূঁইয়াবাড়ী। বিশাল আয়তনের এ বাড়ীর চারপাশে বেশ কিছু মজবুত কাঠের ঘর এবং পুরানো দালানঘর। ছোট মজিদ স্যারের শ্যালক রফিক স্যার ভূঁইয়াবাড়ীর লজিং মাষ্টার এবং মুয়াজ্জিন। ওনার সুমধুর আজানের ধ্বনিতে প্রতিদিন ভোরে আমাদেরও সে সময় ঘুম ভাঙ্গতো। প্রায় সন্ধ্যাবেলায় মজিদ স্যার ভূঁইয়াবাড়ীতে যেতেন। সে সময় তিনি আমাদের ঘরের সামনে এসে প্রায় সময়ই মাকে বলতেন - ‘বড় ঠাইন দুষ্টটায় পড়ছেতো’ ? চুপিসারে ঘরের পাশে এসে পড়ছি কিনা স্যার মাঝে মাঝে এসে টহল দিয়ে যেতেন! অনেক ভাইবোন একটি মাত্র ঘর। সন্ধ্যাবেলায় চৌকির ওপর পাটিতে গোল হয়ে বসছি আমরা ভাইবোনরা। মাঝখানে কেরোসিন তেলের হারিকেন। বাহির থেকে জানালার কাছে এসে দীর্ঘাকায় স্যার একদিন চুপি দিলেন। চোখ পড়তেই হারিকেনে আমার হাতের সজোড়ে আঘাত! সঙ্গে সঙ্গে তেল পড়ে হারিকেনের আলো নিভে গেলো। পরিবারে থাকার স্থান সংকুলান না হওয়ার কারণে বড়দা (প্রয়াত কৃষিবিদ, শিল্পী, গীতিকার ও কবি বাবুল কুমার মজুমদার) ও মেজদা (ডা. এস. কে. মজুমদার) রাতে থাকতেন ভূঁইয়াবাড়ীতে দুলাল ভাই এবং বাদল ভাইয়ের দালানঘরে। আমিও মাঝে মাঝে ভূঁইয়াবাড়ীতে মিলন ও কমলদের কাচারী ঘরে গিয়ে ঘুমাতাম। বাবা পালের বাজারের দন্ত চিকিৎসক। অতিশয় দয়ালু ছিলেন। রোগীদের কাছ থেকে ‘ভিজিট’ বা চিকিৎসা খরচ চেয়ে নিতেন না তিনি। যে যা দিতেন তাতেই বাবা সন্তুষ্ট! অনেকে অর্থ দিতে পারতেন না। কোন কোন রোগী চিকিৎসা নিয়ে বাবাকে তার উৎপাদিত জিনিষ বা সঙ্গে আনা দ্রব্য দিতেন। মানে খাদ্যের উপকরণ বিনিময়।
মা আমাদের সবকিছু দেখভাল করতেন। স্পষ্ট মনে আছে মেজ কাকুর ৪ ছেলেমেয়ে এবং আমাদের ১০ ভাইবোনের পড়াশুনার খরচ এবং আহার যোগাতে কয়লা, ছাই, পুরাতন কাপড়, বাসনকোসন, চালের কুড়া বিক্রি এমন কি কুটির শিল্পের শ্রমঘন কাজও করতে হয়েছিলো মাকে। আমি ক্লাশ ৪র্থ শ্রেণীতে পড়ি। বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে গেছে। ফিস দিতে পারিনি তাই আমার ফলাফল স্থগিত। নতুন ক্লাশে উঠবো। আমার কান্না দেখে মা গেলো স্কুলে। সঙ্গে কয়লা বিক্রির ১২ আনা। ছোট মজিদ স্যার মাকে দেখেই বললেন ‘বড় ঠাইন, আপনি এসেছেন কষ্ট করে ! দুষ্টটা বেশ ভালই করেছে। ওকে পাঠিয়ে দিয়েন। নতুন ক্লাশে উঠিয়ে দেবো। মা বারো আনা দিতে চাইলে স্যার নাকি মাকে বলেছিলেন, ‘আর কতো কষ্ট করবেন বড় ঠাইন’ ?
গণি স্কুল ঘিরে স্মৃতিময় কতো দৃশ্যপট! ১০ বছরে প্রধান শিক্ষক হিসেবে ৩ জন পরম শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষাগুরু পেয়েছি। এরা ছিলেন কাদির স্যার, বশির উল্লাহ স্যার এবং আলতাফ স্যার। বেশি সময় পেয়েছিলাম চাঁদপুর মহকুমার বর্তমান ফরিদগঞ্জ থানার চান্দ্রা ইমাম আলী হাই স্কুল থেকে আসা শিক্ষক আলতাফ হোসেন চৌধুরী স্যারকে। সবচেয়ে বেশি ভয় পেতাম বশির উল্লাহ, ছোট মজিদ, হেলাল, হেড মাওলানা আকরাম, আহমাদ উল্লাহ, হক, পন্ডিত রঞ্জিত চক্রবর্তী এবং খৃষ্টান পীযুষ স্যারকে। প্রায় স্যারই বেত নিয়ে শ্রেণীকক্ষে ঢুকতেন। এই বেতে সরিয়ার তৈল মেখে রোদে তাতিয়ে তা নিয়ে ক্লাশে আসতেন স্যারেরা। আর সে বেতের আঘাত কি যে অসহনীয়, গণি স্কুলে সে সময় যে পড়েছে সেই বুঝেছে! পড়ার জন্য তেমন একটা মার খাইনি তবে দুষ্টামির জন্য এ বিদ্যাপীঠে শুধু বেতের ‘পিটানি’ নয়, মাটির কলসের ভাঙ্গা ‘চারা’ (টুকরো) কপালে রেখে কান ধরে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকার মতো শাস্তিও পেয়েছিলাম!
যদ্দুর মনে পড়ে চতুর্থ শ্রেণীতে সমাজ পড়াতেন হেড মাওলানা আকরাম স্যার। বেশ ফর্সা এবং স্বাস্থ্যবান। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী আর পায়জামা ও মাথায় রঙ্গিন ডিজাইনের ভারী গোল টুপি পরতেন তিনি। ক্লাশে এসে প্রায় সময়ই স্যার চেয়ারে মাথা রেখে ঘুমাতেন। তন্দ্রাভাব দুর করার জন্য নাকে নরম কিছুর আঘাতের মাধ্যমে হাঁচি দিতেন স্যার অনার্গল। আমাদেরকে বলতেন স্কুল মাঠ থেকে কচু গাছের ডোগা নিয়ে আসতে। যে এনে দিতো তাকে স্যার পড়া জিজ্ঞাসা করতেন না! হেড মাওলানা স্যার স্কুলেই থাকতেন। জামা কাপড় ধুয়ে দেয়া, টিফিন ক্যারিয়ার বহন করা ইত্যাদি কাজ করে দেয়ার জন্য আমাদের শ্রেণীর কুদ্দুসসহ অনেকে এই স্যারের প্রিয় ছাত্র ছিলো!
সপ্তম শ্রেণীতে একদিন ইংরেজী ব্যাকরণ পড়াতে গিয়ে হক স্যার দোতলায় অবস্থিত শ্রেণীকক্ষে ঢুকেছেন। বললেন এফ ইউ টি ইউ আর ই (ঋঁঃঁৎব) ‘ফুটুর’ না ‘ফাটুর’। ক্লাশে উপস্থিত প্রায় সবারই ধারণা এর উচ্চারণ দুটোর একটি হবে! কেউ বলছে ‘ফাটুর’, কেউ ‘ফুটুর’! আর অমনিতেই বেতের প্রহার! আরেকদিন বিজ্ঞান ক্লাশে হক স্যার বললেন, ‘বউকে কে মা ডাকতে পারবি’ ? শ্রেণীবন্ধু কোড়ালিয়া সড়কের মজিব হক স্যারের প্রিয় ছাত্র। স্যারের প্রতি অগাধ বিশ্বাস রেখে মজিব দাঁড়িয়ে গেলো। বললো ‘আমি পারবো স্যার’! এ কথা শুনেই স্যার মজিবকে বেত্রাঘাত শুরু করলেন। কান্নভেজা কন্ঠে মজিব বললো, ‘স্যার আপনেইতো কইছেন কইতে’ ?
-‘আরে শয়তান! মারে তাইলে কি ডাকবি’ ?
আমার শৈশবের পরতে পরতে এই স্কুল। বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে আমার লেখক হওয়া, জ্ঞান সাধনার পথে সাংবাদিকতায় পরিভ্রমণ, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বন্ধুত্ব এবং এক পরিবার থেকে অন্য পরিবারে ভালবাসার বন্ধন তৈরি এবং মানবিক হওয়া কোনটা রেখে কোনটা বলি ? তাও আবার এই ক্ষুদ্র পরিসরে ! এ মুহূর্তে ৩টি পরিবারকে বিশেষভাবে মনে পড়ছে যারা শুধু আমার শিশুবেলা থেকে কৈশোর অবধিই নয়, এখনও আমার জীবনের অনেক কাজের প্রেরণা তারা। এরা হলেন কোড়ালিয়ার পরম শ্রদ্ধেয় ফজলুর রহমান ভূঁইয়া এবং হাশিম পাটওয়ারী। আর আমার বাবা ডা. কালী কৃষ্ণ মজুমদার। ৩ জনই আজ প্রয়াত। এদের ১৯(৯+১০+১০) জন ছেলেমেয়ের প্রায় সন্তানই এই গণি স্কুলে পড়েছে।
গণি আদর্শ বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয়ে আমার সহপাঠীদেরই বা ভুলি কেমনে ? শাহীন, কবির, মজিব, হুমা, খোকন, হারাধন, ভবতোষ, নূরুল আমিন, শাহ আলম, ইমরান, মোহাম্মদ আলী, স্বপন, কার্ত্তিক, সিরাজ, বাদল, সমীর, অমীর, নারু, বিশ্বজিৎ, নান্না, তপন, খোকন (কুট্টি), আনোয়ার, সেলিম আকবর, মিজান, রেজা, শাহ আলম, গফুর, মনি, আজিম, তোতা, কুদ্দুস, খাজা, নূরু, বাবলু, রাজা, উম্মে কুলসুম আরও কতো শ্রেণীবন্ধু যাদের সঙ্গে আমার ভালবাসা এবং আত্মার বন্ধন শৈশব থেকে আজ অবধি। (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ
টুইন টাওয়ার কনকর্ড
শান্তিনগর, ঢাকা
লেখক কবি, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক