প্রকাশ : ১৯ মার্চ ২০২৩, ০০:০০
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টঙ্গীপাড়ায় যে অগ্নিকুণ্ডের মুকুলটি প্রস্ফুটিত হয়েছিল সেটিই পরবর্তীতে ১৯৫২, ১৯৬৯ ও ১৯৭১ সালে বিস্ফোরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলার অলিতে-গলিতে, মাঠে-ঘাটে সর্বস্তরে। আজ সেই মুকুলটি ফুলে ও ফলে পরিপূর্ণ হয়ে সুগন্ধ বিলিয়ে যাচ্ছে স্বপ্নের সোনার বাংলার মেহনতি মানুষের মনে ও প্রাণে, বিশ্ব পরিমণ্ডলে। বলছিলাম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা, শিক্ষা, তথ্য প্রযুক্তি ও ডিজিটাল ভাবনা সবই ছিল এক সূত্রে গাঁথা।
হাজারো অত্যাচার-নির্যাতন, শোষণ, জেল-জুলুমের মধ্যেও দেশের শিক্ষা ও তথ্য প্রযুক্তি অবকাঠামো রচনা করতে ভুল করেননি তিনি। ১৯৭১ সালে যখন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ভিত্তি রচিত হয় তখনই তথ্য ও প্রযুক্তিভিত্তিক বাংলাদেশ তৈরির পটভূমি রচিত হয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদি মৌলিক চাহিদার মতো তথ্যপ্রযুক্তির সম্প্রসারণকেও স্থান দেন তিনি। দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের বিকাশে তিনি উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন বিশ্বে তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের যুগ চলছিল। বঙ্গবন্ধু দেখলেন তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা ও সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইউরোপ এবং এশিয়ার অনেক দেশ উন্নতির শিখরে পৌঁছে যাচ্ছে। পাশাপাশি ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেট আবিষ্কার এ বিপ্লবের গতি, প্রভাব ও ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করে দেয়। জাপান, চীন, কোরিয়াসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশ তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের আবির্ভাব থেকে সৃষ্ট সুযোগকে কাজে লাগাতে শুরু করে।
দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু এটা গভীরভাবে উপলব্ধি করেন এবং প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) সদস্যপদ লাভ করে।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বঙ্গবন্ধু বেতবুনিয়ায় স্যাটেলাইট আর্থ-স্টেশন স্থাপন করেন। ফলে বাংলাদেশ সহজেই বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়। একটি দেশের উন্নতিতে বহির্বিশ্বের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ রাখা অত্যাবশ্যক যা বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টির কারণে এর সুফল আজ আমরা ভোগ করছি। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির বহুবিধ ব্যবহার এবং গুরুত্ব নতুন করে বলার কিছুই নেই। ইন্টারনেটের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে তথ্য আদান-প্রদান হচ্ছে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।
অফিসের কাজ, ব্যবসা, লেনদেন, কৃষি, চিকিৎসা, শিক্ষাক্ষেত্রসহ প্রাত্যহিক জীবনের বহু কাজ কত দ্রুত আর সহজেই হয়ে যাচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে। আমরা এখন এতটাই তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর হয়ে গেছি যে, একটা দিনও আমরা তথ্যপ্রযুক্তি ছাড়া চলতে পারি না। আমরা এখন যা বুঝতে পারছি বঙ্গবন্ধু তা অনুধাবন করেছিলেন বহু বছর আগেই। শিক্ষাকে কোনো শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে একে সর্বজনীন করে দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টা ছিল লক্ষণীয়। তিনি মনে করতেন শিক্ষা হবে অভিন্ন, গণমুখী ও সর্বজনীন অর্থাৎ সবার জন্য শিক্ষা। কেউ নিরক্ষর থাকবে না, সবাই হবে সাক্ষর।
বর্তমানে শিক্ষাবান্ধব প্রধানমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রী সেই লক্ষ্যেই অবিরাম কাজ করে চলেছেন। প্রতিবছর ১ জানুয়ারি বই বিতরণ, দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা, শতভাগ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি প্রদান ইত্যাদি চলছে সাফল্যের সঙ্গে। নতুন নতুন স্কুল-কলেজ-মাদরাসা প্রতিনিয়ত প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলেও অত্যন্ত মনোরম পরিবেশে দৃষ্টিনন্দন সুউচ্চ শিক্ষা ভবন দৃশ্যমান হচ্ছে। সেখানে লেখাপড়া করছে লাখ লাখ গ্রামের শিক্ষার্থী। দেশে বর্তমানে ৯৯% শিশু বিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে।
শিক্ষাকে বিশ্বমানে উন্নতি করার লক্ষ্যে আরও যেসব যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেগুলো হলো- শিক্ষাক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন করে নতুন প্রজন্মকে আধুনিক মানসম্মত যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা, যথাসময়ে ক্লাস শুরু, নির্দিষ্ট দিনে পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণ, ৬০ দিনে ফল প্রকাশ, সৃজনশীল পদ্ধতি, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম প্রতিষ্ঠা, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক প্রয়োগ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, স্বচ্ছ গতিশীল শিক্ষা প্রশাসন গড়ে তোলা, প্রাথমিকে শিক্ষকতায় ৬০ ভাগ নারী শিক্ষক নিয়োগ ইত্যাদি।
সম্প্রতি সরকার ২ হাজার ৭১৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করেছে। ২০১৩ সালেও এই সরকার ২৬ হাজার ১৯৩টি বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে। প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষালাভের জন্য পর্যায়ক্রমে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থাপন করা হচ্ছে একের পর এক দৃষ্টিনন্দন একাডেমিক ভবন, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবরেটরি, হাইটেক পার্ক ইত্যাদি। শিক্ষা উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি প্রণীত হয়েছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব উপযোগী, কর্মমুখী, উদ্ভাবনী ও জ্ঞানভিত্তিক বিশ্বমানের শিক্ষা কারিকুলাম, যা এ বছর থেকেই চালু হয়েছে। এছাড়াও শিক্ষা বিস্তারে বিপ্লবী যেসব অগ্রগতি বিশ্ব দরবারে প্রশংসিত হচ্ছে তা হলো- সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬-এ উন্নীত, নারী শিক্ষায় ও সক্ষমতায় অসামান্য অগ্রগতি ইত্যাদি।
বর্তমান বিশ্ব প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়েই অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করে চলেছে। এই বিষয়টি বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করতে পেরেছিলেন অনেক আগেই। তিনি চেয়েছিলেন এমন শিক্ষাব্যবস্থা যার মাধ্যমে শুরু থেকেই দেশের ছোট্ট শিশু-কিশোররা সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে এবং প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের বিষয়ে দক্ষ হয়ে ওঠে। তাই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে একটি যুগোপযোগী শিক্ষা কমিশন গঠন করেন।
বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছায় ওই কমিশনে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক সময়োপযোগী শিক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। একইভাবে তিনি ১৯৭২ সালের সংবিধানে শিক্ষাকে সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেন। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর)’ প্রতিষ্ঠা করেন। এসবই তিনি করেছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার তিন বছরের মধ্যে।
বঙ্গবন্ধুর এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিরলসভাবে ভূমিকা পালন করে চলেছেন তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। নিদর্শনস্বরূপ আমরা দেখতে পাই যখন বাংলাদেশ বিশ্বের ৫৭তম যোগাযোগ উপগ্রহের মালিকানা লাভ করে। এই স্যাটেলাইটের নাম দেওয়া হয় ‘বঙ্গবন্ধু-১’। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু-২ স্যাটেলাইটের কার্যক্রম সফলভাবে চলছে, যা এ বছরেই উৎক্ষেপণ করার কথা রয়েছে।
এই কার্যক্রমের সময়কাল ১৮ বছরের মতো এবং এটি হবে পৃথিবী অবজারভেটরি স্যাটেলাইট, যা ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ওপরে ৩০০ থেকে ৪০০ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থান করবে। ফলে দ্বিতীয় এই স্যাটেলাইটের জন্য অরবিটাল স্পট প্রয়োজন হবে না। এটি আবহাওয়া, নজরদারি বা নিরাপত্তা সংক্রান্ত কাজে ব্যবহার হবে। এসবই সম্ভব হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে এগিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বগুণে।
বর্তমানে বিশ্ব চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগ, যেখানে প্রকৃতি, প্রযুক্তি এবং মানুষ- এই তিনের সমন্বয় ঘটিয়েই বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে। মানুষের বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট এবং উন্নত প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে রিয়েল এবং ভার্চুয়াল জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষের জীবনমানকে আরও সহজ করে দেওয়া। মানুষ এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক্স, আইওটি, থ্রি-ডি, ন্যানোটেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি এবং আরও অনেক প্রযুক্তির ব্যবহার করছে নানা ক্ষেত্রে। এসব বিষয়ে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনের সুবিধার্থে কয়েকটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, যা দক্ষিণ এশিয়ার তৃতীয় এবং বিশ্বে ১২তম মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি। এছাড়াও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি ২০১৬ সালে যাত্রা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করা হয় ২০১৯ সালে। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি জেলায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হচ্ছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, গবেষণা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নবযুগের সূচনা ঘটাবে। একটি সুখী-সমৃদ্ধ ও আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পথ দেখাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ।
ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার : অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।