প্রকাশ : ০৫ মার্চ ২০২৩, ০০:০০
সন্ধ্যায় নৌকা ভিড়ে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের ট্যাকেরঘাট। সকালে নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ থেকে নৌকায় উঠি। তারপর সারাদিন হাওরের পানি ভেঙে অসি এ ঘাটে। রাত যখন বাড়ল তখন দেখি ভরা পূর্ণিমা। আর সে পূর্ণিমায় নৌকার ছইয়ের উপর চলে আড্ডা। আর সারাদিনের হাওরের ফিরিস্তিও অপূর্ব।
মূলত বর্ষা মৌসুমে হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সত্যিই অনন্য। আর এ সৌন্দর্য দেখার জন্য নৌকা হলো অন্যতম বাহন। সেজন্য আমরাও এ বাহনে ভর করি। শুরুটা করি মোহনগঞ্জ বাজার থেকে। এখানকার শাহজালাল হোটেলে সকালের নাশতা সেরে উঠি নৌকায়। বাজারের ঘাটেই নৌকা ছিল। ইঞ্জিন চালিত ছইওয়ালা নৌকা। হাওরের মানুষ বর্ষা মৌসুমে এ নৌকায় যাতায়াত করেন। নৌকাগুলো কিছুটা লম্বাটে। হাওরের নৌকা নামেই পরিচিত।
কংশ নদী হয়ে নৌকা চলতে শুরু করে। ভ্রমণসঙ্গী ৩৮ জন। ইকো ট্রাভেলার্স এ ভ্রমণের ব্যবস্থাপনা করে। নৌকা চলার সঙ্গে বৃষ্টিও শুরু হয়। বৃষ্টির মধ্যে কেউ কেউ ছইয়ের উপর ছাতা মাথায় বসি। বাকিরা ছইয়ের তলে।
খুব বেশি চওড়া না কংশ নদী। নদীর দুইপাশে কোথায়ও বাড়ি, কোথায়ও মাঠ। আছে গাছগাছালি। টানা জালে মাছ ধরাও দেখি। এসব দেখি আর টিপটিপ বৃষ্টির ছন্দে চলছি। কিছুদূর আসার পর দেখি নদীর পাড়ে রঙিন কাগজে সাজানো একটি নৌকা। আমাদের মাঝি জানালেন এটা বরযাত্রীর নৌকা। হাওরে বর্ষা মৌসুমে বিয়ে হলে নৌকায় বরযাত্রী আসেন।
ঘণ্টা দুই চলার পর নৌকা ভিড়ে বাদশাগঞ্জ বাজার। বাজারের পাশের মাঠে আমাদের কেউ কেউ ফুটবল খেলেন। এ বল তারা সঙ্গে করেই এনেছেন। আরেক দল পানিতে ভাসিয়েছে প্লাস্টিকের হাওয়াই নৌকা। এটাও তারা সঙ্গে করে এনেছেন। কিছুক্ষণ এখানে তাদের খেলাধুলার পর নৌকা আবার ছুটে। নদী ছেড়ে নৌকা এবার প্রবেশ করে মূল হাওরে।
বৃষ্টি আর বাসাত হওয়ায় হাওরে বেশ ঢেউ আছে। সেই ঢেউয়ের তালেই নৌকা চলছে। বিশাল হাওরের কোথাও কোথাও বাড়িঘর আছে। আর বহুদূরে দেখি ভারতের মেঘালয় রাজ্যোর পাহাড়। এসব দেখি আর পানি কেটে চলি।
নৌকা চলছে। সেই চলার মধ্যেই হাতে এসে পৌঁছে গরম ভাতের প্লেট, সঙ্গে হাওরের মাছভাজা, সবজি আর ডাল। আহা কি স্বাদ! বাড়ির খাবারের সঙ্গে এর তুলনা সত্যি হয় না। খাবার শেষ করতেই নৌকা ভিড়ে তাহিরপুরের জয়পুর গ্রামে। হাওর পাড়ের এ গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাদের জীবনযাপন সম্পর্কে জানি। এখানকার কেউ অসুস্থ হলে তাকে নৌকায় নিয়ে যেতে হয় তাহিরপুর উপজেলা সদরে। গ্রামটিতে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে।
কিছুক্ষণ জয়পুর থেকে নৌকা আবার চলতে শুরু করে। এবার নৌকা চলে টাঙুয়ার হাওর হয়ে। শীত মৌসুমে এ হাওরজুড়ে থাকে নানা প্রজাতির পরিযায়ী পাখির বসবাস। আর এখন শুধুই পানি।
বিকেল হয়ে এসেছে। নৌকার ছইয়ের উপর সবাই বসেছি। শীতল একটা বাতাস বইছে, যেনো একেবারে বুকের ভেতর গিয়ে ঠেকছে তার পরশ। এরমধ্যে সবার সামনে হাজির ঝামমুড়ির বোল। শীতল পরশে একটু ঝালের আবির্ভাব আরকি। ঠিক সন্ধ্যার দিকে নৌকা ভিড়ে ট্যাকেরঘাট। অনেকেই ঘাটে নামেন।
রাত যাপনের জন্য কারও ঠিকানা হয়েছে তাহিরপুরের গেস্ট হাউসে। বাকিরা নৌকাতেই। রাতে খাবার খেয়ে গেস্ট হাউসের যারা তারা চলে গেছেন। আর নৌকার যারা তাদের কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়েছেন। শুধু আমরা কয়েকজন ছইয়ের উপর বসে আড্ডায় মাতি। ভরা পূর্ণিমায় এমন আড্ডা পায় আরও পূর্ণতা। আর এ পূর্ণতা জীবনের অনেক অপূর্ণতাকেও ভুলিয়ে রাখে।
খুব সকালে ঘাটে নেমে আশপাশটা ঘুরে দেখি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে এখানে একটি ভাস্কর্য আছে। এছাড়া ট্যাকেরঘাটে বি.সি.আই.সি-এর চুনা পাথর খনি প্রকল্প আছে। অবশ্য এখন এর কার্যক্রম নেই। অনেকটা পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। তবে সব মিলিয়ে ট্যাকেরঘাটের আশপাশের সৌন্দর্য দারুণ।