প্রকাশ : ০৫ মার্চ ২০২৩, ০০:০০
প্রতি বছর পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর সংবাদমাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নিয়ে দুধরনের খবর প্রকাশ হয়। যাঁরা সংগ্রাম করে পড়াশোনা করে ভালো ফল বয়ে এনেছেন তাঁদের খবর আসে। দারিদ্র্য জয় করে কিংবা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন হয়েও সব বাধা দূর করে যাঁরা ভালো ফল করেন তাঁদের খবর ইতিবাচক। একইভাবে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া কিংবা কাঙ্ক্ষিত ফল না পাওয়ার কারণে শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার নেতিবাচক খবরও আমরা দেখি। বিপরীতমুখী এই খবরগুলোতে স্বাভাবিকভাবেই অনুভূতি ভিন্ন হয়। অদম্য মেধাবীদের সংগ্রাম যেমন আমাদের আশান্বিত করে, তেমনি আত্মহননের খবরগুলোতে হতাশায় মুষড়ে পড়ি।
গত বুধবার উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে। প্রায় ৮৬ শতাংশ পাসের হারের এ ফল সার্বিকভাবে নিঃসন্দেহে ভালো। জিপিএ ৫ ও এর সংখ্যাও কম নয়; পৌনে দুই লাখ। উত্তীর্ণ ১০ লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে যে বিচিত্র শিক্ষার্থী রয়েছেন, তা যেমন বলা বাহুল্য; তেমনি অকৃতকার্যদের মধ্যেও প্রতিভাবান থাকা স্বাভাবিক। সে জন্য আমার বিবেচনায় সংবাদমাধ্যমে তিন ধরনের খবর আসা উচিত। যাঁরা উত্তীর্ণ হতে পারেননি, তাঁদের ভাগ্য বিপর্যয় কেন হলো; কোন কারণে তাঁরা অকৃতকার্য হলেন- এ রকম কয়েকজনের গল্প প্রকাশ হলে হয়তো অনেকের জন্য শিক্ষণীয় হতো।
শুক্রবারের সমকালে ‘ওদের মনের আলোয় হার মেনেছে চোখের অন্ধকার’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ হয়। যেখানে চট্টগ্রামে এইচএসসিতে ভালো ফল করা দৃষ্টিজয়ী আট অদম্য পরীক্ষার্থীর গল্প উঠে আসে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন হওয়ার পাশাপাশি পরিবারের অসচ্ছলতা, নানা সংকট কাটিয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল করেছেন তাঁরা। তাঁরা চট্টগ্রাম নগরের সরকারি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয় পার হয়ে বিভিন্ন কলেজে পড়াশোনা করেছেন। তাঁদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে পরিবারের সমর্থন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উৎসাহ নিঃসন্দেহে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। এর সঙ্গে প্রত্যেকের আগ্রহের বিষয়টিও উল্লেখ করার মতো। নানামুখী সংকটের মধ্যে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথমত ব্যক্তির নিজের প্রচেষ্টা মুখ্য। নিজের পরিশ্রম ও এগিয়ে যাওয়ার মানসিকতার সঙ্গে অন্যদের সহায়তার মাধ্যমেই ভালো ফল তৈরি হয়।
পরীক্ষার ফলে শিক্ষার্থীর সফলতার পেছনে নিজের কৃতিত্বই প্রধান। এ ক্ষেত্রে কেউ অভিনন্দন জানালে ব্যক্তিকেই জানাবে। এর পর শিক্ষার্থীর মা-বাবা কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিষয়টি আসবে। কিন্তু শিক্ষার্থীর ব্যর্থতায় অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর নিজের ভূমিকার চাইতে পরিবার, প্রতিষ্ঠান কিংবা সমাজের আলোচনা আগে চলে আসে। অনেক সময় শিক্ষার্থীর অকৃতকার্য হওয়া দুর্ঘটনাবশতও হতে পারে। বাস্তবতা যা-ই হোক, এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর ভূমিকা মুখ্য হলেও বলা হয়- তাঁর পরিবার কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কী করেছে? তারা হয়তো ছেলেটি বা মেয়েটির প্রতি তেমন যত্নবান ছিল না বলেই পরীক্ষায় খারাপ করেছে। কিংবা বলা হয়, বখাটের পাল্লায় পড়েই এ অবস্থা।
শিক্ষার্থীর অকৃতকার্যতায় বাস্তবতা যা-ই হোক, পরীক্ষার ফলসংক্রান্ত বিষয়ে হতাশ হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিকতার ভূমিকাই যে প্রধান, তা বলাই বাহুল্য। দিনাজপুরের এক ছাত্রী এ বছর এইচএসসিতে জিপিএ ৪ পেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। চিরকুটে লিখে গেছেন, 'আমার জন্য তোমাদের অনেক সম্মান গেছে।' প্রশ্ন হলো- এ কেমন 'সম্মান'! জিপিএ ৫ পেলে সম্মান, না হলে অপমান- এ বোধ আমাদের সমাজই তৈরি করেছে। জিপিএ ৫ পেলে ভালো, না পেলেও অসুবিধা নেই- এমন মনোভাব শিক্ষক-অভিভাবকসহ সবারই থাকা উচিত। জোর করে পেতেই হবে, এমনটা চাপিয়ে দেওয়ার করুণ পরিণতি আমরা দেখছি। সামান্য পরীক্ষার ফলের জন্য মূল্যবান জীবনকে কোনোভাবেই তুচ্ছ করা যাবে না।
অদম্যরা আমাদের প্রেরণা। অকৃতকার্যদের জন্যও জীবনে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ রয়েছে। কিন্তু হতাশ হয়ে চলে যাওয়ার মধ্যে সমাধান নেই; বিপজ্জনক সেই পথ থেকে শিক্ষার্থীদের বাঁচানোর কাজটি আমাদের সবার।