প্রকাশ : ২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
পুরানবাজারের ঠিক পশ্চিমে মেঘনা আর উত্তরে ডাকাতিয়া নদী। দু নদীর পাড় ঘেঁষেই বাজারটা। মূলত ডাকাতিয়া এসে মিশেছে মেঘনায়। আরেকদিক থেকে পদ্মার মিলনস্থলও এ জায়গাটি। এজন্য তিন নদীর মোহনা হিসেবেই এর পরিচিতি। এ মোহনাতেই চাঁদপুরের পুরান বাজার দাঁড়িয়ে শত বছরেরও বেশি সময় ধরে।
হেমন্তের এক দুপরে বন্ধু ফরিদকে নিয়ে ঢুকে পড়ি চাঁদপুরের অনেক পট্টির এ বাজারে। ছেলেবেলায় এ বাজারে অনেক এসেছি। তারপর দীর্ঘ বিরতি। ঘুরে ঘুরে পট্টির আড়ৎ বা দোকানগুলোতে বেচাকেনা দেখি। পাইকারি বা খুচরা সবরকম বেচাকেনাই চলে। পাইকারি দোকানই বেশি।
চালপট্টি, ডালপট্টি, যোগীপট্টি, মনোহারীপট্টি, আমপট্টি, বাতাসাপট্টি, ট্রাঙ্কপট্টি, তেলপট্টি, ফলপট্টি, তামাকপট্টি, আড়ৎপট্টি, সুতাপট্টি, খলিফাপট্টি, টিনপট্টি, ঘোষপট্টি, বানিয়াপট্টি কিংবা মসলাপট্টি এমন অনেক পট্টি আছে চাঁদপুরের এ পুরান বাজারে।
আর এ পট্টি মানে গলি বা সড়ক। যে পণ্যের নামে যে পট্টি, সেই পণ্য পাওয়া যাবে সেই পট্টিতে। তাই নির্দিষ্ট কোনো পণ্যের প্রয়োজন হলে পুরো বাজার না ঘুরে নির্দিষ্ট পট্টিতে গেলেই পণ্য মেলে।
চাল-ডাল কিংবা তেল-লবণ থেকে শুরু করে পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ কিংবা মাছ-মাংস, পোশাক-প্রসাধনী সবই মেলে এখানে। তবে সুতা, জাল কিংবা মাছ ধরার সরঞ্জামের দোকানের সংখ্যাই এখানে তুলনামূলক বেশি। এ অঞ্চলের অসংখ্য মানুষ মেঘনায় ইলিশ মাছ ধরার কাজে সম্পৃক্ত।
মাছ ধরার সরঞ্জাম বেশি আছে বাজারের যোগীপট্টিতে। এ পট্টির অনেক দোকানের সামনে দেখি মাছ ধরার জাল সেলাই করছেন সেলাইয়ের কারিগর। সেখানকার স্থানীয়রা সেলাইয়ের কারিগরকে খলিফা বলেন।
বাজারের পট্টিগুলোতে ক্রেতাণ্ডবিক্রেতার সমাগম আছে। তবে ছেলেবেলায় দেখা পুরান বাজারের সঙ্গে এখনকার পুরান বাজারের কিছুটা অমিল। ছেলেবেলায় নানা মমতাজ উদ্দিন ভূঁইয়া বা মামা আবদুর রব ভূঁইয়ার সঙ্গেই এ বাজারে প্রথম আসি।
খুলনা থেকে চাঁদপুর বেড়াতে আসলে নানা বা মামা আমাদের বাজারে নিয়ে আসতেন। বাজারের যোগী পট্টিতে নানার দোকান ছিলো। তাদের সঙ্গে বাজারের নানা পট্টিতে ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করেছি অনেক। নানা গত হয়েছেন অনেক আগে। তবে এখনো মামার দোকান আছে এ বাজারে।
এ বাজার চাঁদপুরের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। চাঁদপুরের শিল্প-কারখানাও এ বাজারকেন্দ্রিক। তিন-চার দশক আগেও এ বাজার ছিলো আরো জমজমাট। সে তুলনায় এখন কিছুটা কমতি। এর কারণ নদীর ভাঙনে বাজার ছোট হয়ে আসা।
অন্যদিকে ডাকাতিয়া নদীতে সেতু হওয়ায় চাঁদপুর শহরের নতুন বাজার আরো জমজমাট হওয়ার ফলে কিছুটা রমরমা ভাব হারিয়েছে চাঁদপুরের পুরান বাজার। তবে এখনো সকাল-সন্ধ্যা হাঁক-ডাক বা শোরগোল বজারে প্রাণের সঞ্চার সৃষ্টি করে। বাজারে আছে প্রায় দু'হাজার দোকান।
এক সময় লবণ বাণিজ্যের জন্য এ বাজার বেশ পরিচিত ছিলো। এখনো আছে, তবে আগের মতো নয়। এখনো এ বাজার এ অঞ্চলের চাল, ডাল, তেল, লবন বা বিভিন্ন শস্যজাতীয় পণ্যের বৃহৎ পাইকারি বাজার বলেই গণ্য।
বাজারটিতে যেসব স্থাপনা ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে দাঁড়িয়ে তার মধ্যে অন্যতম পুরান বাজার জামে মসজিদ। দোতলা ভবনের এ মসজিদের গায়ে রঙিন কাচ ও পাথর দিয়ে কারুকাজ আছে। শতবর্ষের এ মসজিদের মিনারটিও বেশ উঁচু। এছাড়া দেড়শত বছরের বাজারের মন্দিরটিও আছে এখানকার ঐতিহ্যের তালিকায়।
ছেলেবেলায় দেখা বাজারের দোকানগুলো অধিকাংশই ছিলো টিনের। এখন কিছু ইটের ভবনও তৈরি হয়েছে। তবে বাজারের আগের রূপ পুরোটা বদলায়নি। অবশ্য যে রূপটি এখন দেখি না সেটি হলো বাজারের বানর। বাজারের দোকানদাররা জানান আধুনিক স্থাপনা, খাবারসহ নানা কারণে বানর এখন কম দেখা যায়।
আমরা বাজারের নানা পট্টি ঘুরে এসে বসি ঘোষপট্টির সুনন্দা কেবিনে। প্রাচীন এ মিষ্টির দোকানটির প্রতিষ্ঠাতা সুরেশ চন্দ্র ঘোষ। এখন তার ছেলেরা এটি পরিচালনা করছেন। আমরা সেখানকার বিখ্যাত দই আর মিষ্টি খাই। বেশ সুস্বাদু সে সব মিষ্টি। তারপর চা খেয়ে বিদায় নিই বাজার থেকে।
যেভাবে যাবেন ঢাকার সদরঘাট থেকে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত বিভিন্ন লঞ্চ ছেড়ে যায় চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে। সময় লাগে প্রায় চার ঘণ্টা। লঞ্চ থেকে নামলে খেয়া পার হয়ে পুরান বাজার আসা যাবে। আবার সায়েদাবাদ থেকে গাড়িতেও চাঁদপুর আসতে পারবেন।
লঞ্চ ঘাটের হোটেলগুলোতে সুস্বাদু ইলিশের স্বাদ নিতে পারেন। লঞ্চঘাটে জেলেরা নৌকায় করে ইলিশ মাছ বিক্রি করেন। চাইলে তা কিনেও ফিরতে পারেন। থাকার জন্য চাঁদপুর শহরে হোটেল আছে একাধিক।