প্রকাশ : ১১ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি জাতির স্বাধীনতা আন্দোলন নস্যাৎ করার জন্য গভীর রাতে হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে ওই রাতেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালির ওপর বর্বর হামলা চালায়।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হওয়ার আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তা ওয়্যারলেসযোগে চট্টগ্রামের জহুরুল আহমেদ চৌধুরীকে প্রেরণ করেন। চট্টগ্রাম বেতার থেকে আওয়ামী লীগ নেতা হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী স্বকণ্ঠে প্রচার করেন। ওই রাতেই ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার দাবি থেকে সরে আসতে বলা হয়, তা না হলে তাঁকে হত্যা করা হবে বলে হুমকি দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু সাফ জানিয়ে দেন, ‘বাঙালির অধিকার ছাড়া তিনি কোন কিছু মানবেন না’। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে করাচীতে নিয়ে যাওয়া হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের লায়ালপুর মিয়ানওয়ালী কারাগারে পাঠিয়ে দেন। এরপর হতে মুক্তির আগ পর্যন্ত পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুর উপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়।
১৯৭১ সালের ৩ আগস্ট পাকিস্তান টেলিভিশন থেকে বলা হয় ১১ আগস্ট থেকে সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর বিচার শুরু হবে। এই ঘোষণায় বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ এবং উদ্বেগের ঝড় বয়ে যায়। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রবাসী বাঙালিরা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী সন ম্যাকব্রাইডকে ইসলামাবাদে পাঠান। কিন্তু পাকিস্তানি জান্তা সরকার বিদেশি আইনজীবী নিয়োগে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। ১৯৭১ সালের ১০ আগস্ট পাকিস্তানি জান্তা সরকার বঙ্গবন্ধুর পক্ষ সমর্থনের জন্যে আইনজীবী একে ব্রোহীকে নিয়োগ দেয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে যখন ২৬ মার্চ ইয়াহিয়া খানের ভাষণের টেপ শোনানো হয়। তখন তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনে অস্বীকার করেন এবং আইনজীবী ব্রোহীকে অব্যাহতি দেন।
১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুকে ইয়াহিয়া খানের সামনে হাজির করা হয়। ইয়াহিয়ার সঙ্গে ছিলেন ভুট্টো এবং জেনারেল আকবর। ইয়াহিয়া করমর্দনের জন্যে হাত বাড়ালে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘দুঃখিত ও হাতে বাঙালির রক্ত লেগে আছে ও হাত আমি স্পর্শ করবো না’।
ওই সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের পক্ষে ব্যাপক জনমত তৈরি হয়। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবতা স্পর্শ করতে থাকে। এ সময় অনিবার্য বিজয়ের দিকে এগুতে থাকে আমাদের মহান মুক্তির সংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধ।
১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের মুক্তির সংগ্রাম যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, তখন লায়ালপুর কারাগারে ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমঝোতার প্রস্তাব দেন। কিন্তু ওই সমঝোতার প্রস্তাব বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ত্রিশ লাখ শহিদ এবং তিন লাখ মা-বোনের ইজ্জ্বতের বিনিময়ে আসে আমাদের বিজয়। বাঙালি জাতি মুক্ত হয় পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে। কিন্তু মুক্তির অপূর্ণতা রয়ে যায়, কারণ স্বাধীনতার মহান স্থপতি বাঙালির নয়নমণি জাতির পিতা তখনও পাকিস্তানের নির্জন কারাগারে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের নির্জন-অন্ধকার কারাগারে শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর বিচার। এতে তাঁর ফাঁসির আদেশ হয়। কারাগারের যে সেলে বঙ্গবন্ধুকে রাখা হয়েছিলো, সেই সেলের পাশে কবরও খোঁড়া হয়েছিলো। তিনিই সেই বঙ্গবন্ধু যিনি, নির্জন সেলের সামনে কবর খুঁড়তে দেখেও ভয় পাননি; বরং পাক জেলারকে বলেছিলেন, ‘আমি বাঙালি, আমি মুসলমান, আমি মানুষ। মানুষ একবারই মরে, বারবার মরে না। আমি কখনোই আত্মসমর্পণ করব না। যদি তোমরা আমাকে মেরে ফেলো, মৃত্যুর পর আমার লাশটা আমার দেশে আমার মানুষদের কাছে পৌঁছাইয়া দিও’।
বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবি ও প্রহসনের বিচার বন্ধ করতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় বিশ্ব জনমতের চাপের মুখে স্বৈরাচার পাকিস্তানি সরকার ফাঁসির আদেশ কার্যকর করতে সাহস পায়নি। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহিদ, বহু ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হয়। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক চাপে পাকিস্তান হানাদার সরকার সদ্য ভূমিষ্ঠ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রাণপ্রিয় নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচীতে ঘোষণা করেন ‘শেখ মুজিবকে বিনা শর্তে মুক্তি দেয়া হবে’। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পান। পিআইয়ের একটি বিশেষ বিমানে বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনে পাঠানো হয়। ৯ জানুয়ারি ভোরে বঙ্গবন্ধু লন্ডনে পৌঁছেন। তাঁর হোটেলের সামনে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি ঘোষণা করেন, আমি আমার বাংলার জনগণ এর কাছে ফিরে যেতে চাই। পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন হয়ে দিল্লি যান ।
তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথের আগ্রহে ব্রিটেনের রাজকীয় বিমান বাহিনীর এক বিশেষ বিমানে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সকালে বঙ্গবন্ধু নয়া দিল্লী পৌঁছালে ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি ভি.ভি. গিরি ও মাতৃসমা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরাগান্ধী এবং সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাগত জানান। বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু বলেন ‘অশুভর বিরুদ্ধে শুভর বিজয় হয়েছে’।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দীর্ঘ ১০ মাস পাকিস্তানে কারাবাস শেষে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বিকেলে ব্রিটেনের রাজকীয় বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে বিজয়ী বীরের বেশে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিমানবন্দরে দুপুর ১টা ৫১ মিনিটে জননী-জন্মভূমি বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন। এ সময় অস্থায়ী সরকার, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, মুক্তিযোদ্ধা, বাংলার সাধারণ ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিক-কৃষক মেহনতি জনতাসহ লাখো বাঙালি উৎসবের আনন্দে এদিন প্রাণপ্রিয় নেতাকে বরণ করেন। লাখো মানুষ বিমানবন্দরে পুষ্পবৃষ্টিতে বরণ করে নেয় প্রাণপ্রিয় এই নেতাকে। বঙ্গবন্ধুও তাঁর প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন।
ওইদিন তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু কান্নাজড়িত কণ্ঠে ‘ভাইয়েরা ও বোনেরা আমার’ সম্বোধন করে হৃদয়কাড়া এক ভাষণ দেন। তিনি বক্তৃতার শেষে বাঙালির হাজার বছরের আরেক শ্রেষ্ঠ সন্তান বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি বিখ্যাত কবিতার চরণ উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি’। কবিগুরুকেই উদ্যেশ্য করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘কবিগুরু তুমি এসে দেখে যাও, তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছ। লাখো মানুষের জন¯্রােত, বাঁধভাঙ্গা আবেগে অশ্রুসিক্ত জাতির পিতা আরো বলেন, আজ আমার জীবনের স্বাদপূর্ণ হয়েছে। তিনি নিজেই তাঁর এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করেছিলেন অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা হিসেবে। ওইদিন থেকে ঐতিহাসিক ১০ জানুয়ারি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
মোঃ নূর ইসলাম খান অসি : পরিচালক (অপারেশন), ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং সভাপতি, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি কেন্দ্রীয় কমিটি, ঢাকা।