প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
চন্দনীমহল স্টার গেটের ঈদ স্মৃতি নিয়ে আগেও দুটি লেখা লিখেছি। তবে সে লেখার অধিকাংশ ছিল রোজার ঈদকেন্দ্রিক। তাই এবার কোরবানির ঈদ নিয়ে একটু বলি। অবশ্য ছেলেবেলার সব ঈদেই ঘুরেফিরে চন্দনীমহল, স্টার জুট মিলের এক নম্বর গেট বা কলোনির প্রসঙ্গ আসবে।
কোরবানি উপলক্ষে দিঘলিয়া থানার বড় হাঁট বসে পথের বাজার স্কুল মাঠে। ঈদের ১ মাস আগে থেকে এ হাঁটের প্রচারণা চলে। পোস্টার সাঁটানো হয়, মাইকিং করা হয়, যদ্দুর মনে পড়ে, হাঁট বসত সপ্তাহে ৩ বা ২ দিন। তবে শুক্রবার হাঁট বেশি জমে, আর বসত সোম বা মঙ্গলবার। বিশাল এ মাঠের পুরোটাজুড়ে গরুর বেঁচাকেনা। আর মাঠের এককোণে ছাগলের বেচাকেনা।
পথের বাজারের এ মাঠে কোরবানি ছাড়াও বর্ষাকালে আসতাম ফুটবল খেলা দেখতে। আগে প্রতি বছর এ মাঠে নিয়মিত ফুটবল টুর্নামেন্ট হতো। এ টুর্নামেন্টে চন্দনীমহলের দল খেলত। তাদের খেলা দেখতে আমি যাই। খুব সম্ভবত তার নাম আকতার। চন্দনীমহলের এ লোকটি খুব ভালো ফুটবল খেলেন। আরও অনেকে খেলেন, সবার নাম মনে নেই। সবার সঙ্গে আমার পরিচয়ও ছিল না। অবশ্য বরাবরই আমি একটু নিভৃতে থাকি। সেজন্য চন্দনীমহলের ফুটবল খেলোয়াড়রা হয়তো কোনোদিন জানেননি, আমি তাদের খেলার নিয়মিত দর্শক। চন্দনীমহল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠেও বর্ষায় নিয়মিত ফুটবল টুর্নামেন্ট বসত। এ টুর্নামেন্টে খালিশপুরের হার্ডবোর্ড, প্লাটিনাম, পিপলস, ক্রিসেন্টসহ বিভিন্ন দল, দিঘলিয়া বা আরও অনেক স্থান থেকেও দল থাকে। আর মল্লিকপাড়ায় আছে খালেক স্মৃতি সংঘ। এ সংঘেরও ছিল ফুটবল দল। গাজীপাড়ায় একতা যুবসংঘও ফুটবল টুর্নামেন্ট নামায়।
আমরা কয়েকজন মিলে গরু কোরবানি দিই। এর মধ্যে থাকেন মোমিন সওদাগর, রুহুল আমিন হাজী, রাজা মিয়া প্রমুখ। তবে গরু কেনায় বাবার ভূমিকা লক্ষণীয়। অন্যদের ধারণা বাবা গরু কেনায় ভালো।
স্টার জুট মিলের সপ্তাহিক বন্ধ ছিল শুক্রবার। আর বাবা ছিলেন এ মিলের তাঁতের শ্রমিক। তাই শুক্রবারই গরু কেনার দিন ঠিক হয়। দুপরে খাওয়াণ্ডদাওয়া সেরে মোমিন কাকাসহ আমরা বের হই গরু কিনতে। গরু কেনার ক্ষেত্রে বাবা দেখেন ছোট বা মাঝারি সাইজ। মনে আছে, সাড়ে ৩ হাজার টাকা দিয়েও আমরা গরু কিনেছি। মাঠে অনেক বড় বড় গরু দেখে বাবাকে বলি বড় গরু কিনতে। বাবা বলেন, আগামীবার।
গরু কিনে ফিরি সন্ধ্যার আগে। একবার বাবা, মোমিন কাকা, মোমিন কাকার ছেলে ফারুক ভাই আর আমি গরু কিনে ফিরছি সন্ধ্যার সময়। বেশ কিছুটা আসার পর হঠাৎ গরু দৌড় দেয়। ফারুক ভাইও গরুর পেছন পেছন দৌড়। শেষে অনেক কষ্টে ধরা গেল।
পথের বাজার ছাড়া স্টার গেটের ক্লাবের সামনে বৃহস্পতিবার কিছু গরু ওঠে। কারণ বৃহস্পতিবার মিলের শ্রমিকদের বেতন দেওয়া হয়। আর ঈদের আগের শেষ বৃহস্পতিবার বোনাস দেওয়া হয়। তবে এখান থেকে খুব কমই গরু কেনা হয়েছে।
গরু কিনে অনেক সময় আমাদের বাড়িতেই রাখি। আবার স্টার কলোনির মাঠে বা মিলের ভেতরও রাখি ঘাস খাওয়াতে। একবার মোকামপুর নদীর পাড়ে গরুকে কচুরিপনা খাওয়াতে নিয়ে যাই। ভাটার সময় বলে বুঝতে পারিনি। যখন জোয়ার এলো, দেখি গরু নদীর পানিতে। ছোট ছিলাম বলে গরু আর আনতে পারিনি। পরে কেউ একজন এনে দিয়েছিল।
আমাদের বাড়িতে গরু রাখলে বাবা বাজার থেকে খৈলণ্ডভুসি এনে খাওয়ান, যত্ন করেন। সঙ্গে আমরাও থাকি। আর ঈদের দিন সকালে গরুকে গোসল করায় বাবা। গরু কাটার ছুরিণ্ডচাকু আমাদের ছিল। এগুলো সারাবছর বাবা যত্ন করে রাখেন। বাবা ঈদের আগের দিন বালু গরম করে ছুরিণ্ডচাকু ধার দেন।
রোজা বা কোরবানি দুই ঈদেই এক নম্বর স্টার গেটের সামনে বাজার বসে। ঈদ ছাড়া অন্য সময় শ্রমিকদের বেতনের দিন বৃহস্পতিবার বাজার বসে। আর ঈদের আগে প্রায় ৪ বা ৫ দিন ধরে গেটের সামনে পথের দুইপাশে বসে বাজার। থানকাপড়, মশলা, লুঙ্গি, জামাণ্ডকাপড়সহ নানা পণ্যেও অস্থায়ী দোকান থাকে। লেইসফিতার দোকানও থাকে। ফেরিওয়ালা জালাল ও সিরাজ ফেরি করে বিক্রি করেন। ঈদের আগে তারাও গেটের সামনে পলিথিনের শামিয়ানা টাঙিয়ে কয়েকদিনের জন্য বসেন।
অস্থায়ী জামাকাপড়, জুতা বা থানকাপড়ের দোকান ছাড়া স্টার গেটে কিছু স্থায়ী দোকান আছে। এর মধ্যে বড় দোকার মোমিন সওদাগরের। এ দোকানে জুতা, লুঙ্গি, জামাকাপড়, থানকাপড় সবই পাওয়া যায়। আর কাঞ্চন কাকার দোকানে লুঙ্গিণ্ডশাড়ি পাওয়া যায়। এছাড়া গেটে কাপড়ের দোকান ছিল নজরুল ইসলাম (শিক্ষক), জিন্নাত, মুছা, বেলায়েতসহ কয়েকজনের। গেটের সামনে আজিজ কাকার জুতার দোকান। আরও আছে উত্তম দর্জি, রবিউল দর্জি, কাউসার দর্জির দোকান।
অবশ্য সবাই স্টার গেটের সামনে থেকে ঈদের কেনাকাটা করে, তা নয়। অনেকে ভৈরব নদী পার হয়ে খালিশপুর, চিত্রালী, দৌলতপুর বা খুলনা থেকেও ঈদের কেনাকাটা করেন। ঈদের আগে অনেক রাত পর্যন্ত খেয়া পারাপার চলে। ছোটবেলায় এ নদী আমরা পার হয়েছি মাত্র ২৫ পয়সা দিয়ে। পরে খেয়া নৌকার বদলে ইঞ্জিনের নৌকা আসে।
ঈদের আগের কয়েকদিন গেটের সুমীরের লন্ড্রির দোকানে ভিড় দেখা যায়। এছাড়া গেটে সারাবছর যারা জুতা মেরামতের করেন, ঈদের আগে তাদেরও ব্যস্ততা বাড়ে।
রোজার ঈদ বা কোরবানির ঈদ, সব ঈদের আগের দিন আইয়ুব কসাই, নুরুল ইসলাম কসাই, ইসলাইল কসাই, মহিউদ্দিন কসাইের মাংসের দোকানে ভিড় থাকে। মুদি দোকানগুলোতেও সেমাই আর অন্য জিনিস কেনার ভিড় থাকে। গেটের বড় মুদি দোকানের মধ্যে ছিল তিন ভাইয়ের দোকান। রুহুল আমিনসহ তিন ভাই মিলে দোকান দিয়েছেন বলেই দোকানের নাম তিন ভাইয়ের দোকান। পরে অবশ্য তিন ভাইয়ের আলাদা আলাদা দোকান হয়েছে। আরও ছিল সিরাজ কাকা, আজিজ কাকাসহ আরও কিছু দোকান। তবে স্টার গেটে আজিজ কাকার দোকানেই প্রথম ফ্রিজ আসে। এক টাকা দামের পাইপ আইসক্রিম খাই এ দোকান থেকে। দোকানে রহিম ভাইকে বেশি বসেন। সম্ভবত তিনি স্টার মিলের বাবু ছিলেন। সব ঈদের আগে স্টার গেটের সেলুনগুলোতে ভিড় থাকে। আবুল গাজীর হোটেলের দোতালায় ছিল অলোকের লোকালয় সেলুন। এ সেলুনে চুল কাটাই। এ সেলুনে তরুণদের ভিড় একটু বেশি থাকে।
আমরা ঈদের নামাজ পড়ি স্টার মিলের জামে মসজিদের সামনের ঈদগাহে। এছাড়া আমাদের এলাকায় আরেকটি ঈদগাহ আছে। আলীনগর ঈদগাহ। ঈদের আগের দিন মাইকে সারা এলাকায় ঈদের জামাতের সময় জানিয়ে দেওয়া হয়।
স্টার মিলের মসজিদে ঈদের নামাজ পড়ান ইমাম গাজী নাসির উদ্দিন। ঈদের দিন তিনি পড়েন বড় আলখেল্লা। মাথায় লালণ্ডসাদা রঙের রুমাল পরে তাতে চাপান কালো রঙের বিড়া। যেমনটা হাজীদের মাথায় দেখা যায়। তাই সারা বছর তাকে একরকম দেখলেও ঈদের দিন মনে হয় অন্যরকম। স্টার কলোনিতে যত গরু কোরবানি হয়, তার অধিকাংশই জবাই করেন ইমাম সাহেব।
সব ঈদেই স্টার গেটে বিশেষ করে মিলের ক্লাবের সামনে ঈদের মেলা বসে। এলাকার বড় ভাইরা ক্লাবের সামনে তাদের সংগঠন একতা তরুণ সংঘের উদ্যোগে স্টল দেন। স্টলের নাম ‘ইয়ানতুন খাইা যান’। তারা টটপটিণ্ডফুসকা বিক্রি করেন। গেটের সামনে নানা ধরনের খেলনা ও খাবারের অস্থায়ী দোকান বসে।
স্টার মিলের নিরাপত্তাকর্মীরা সারা বছর হলুদ ইউনিফর্ম পরে গেটের সামনে থাকেন। তবে ঈদের দিন তাদের দেখা যায় পাঞ্জাবিতে।
চন্দনীমহল ডাকঘরের পিয়ন সাহেব আলীও সারা বছর হলুদ ইউনিফর্ম পরে চিঠি বিলি করেন। তবে ঈদের আগের দিন থেকে তাকেও দেখা যায় নরমাল পোশাকে।
স্টার গেটের শ্রমিক মিলনায়তন বা ক্লাবে ছিল রঙিন টিভি। সম্ভবত ২১ ইঞ্চি। এ টিভির তত্ত্বাবধানে থাকেন নওয়াব আলী। সাধারণত ক্লাব খোলেন বিকেলে। কিন্তু ঈদের দিন একটু আগে খোলেন। অনকে সময় তার আসতে দেরি হলে বাসা থেকে তাকে ডেকে আনা হয়।