প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
ব্যাটারিচালিত রিকশা উচ্ছেদ কতটা যৌক্তিক
সুধীর বরণ মাঝি
বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি ব্যাটারিচালিত রিকশাণ্ডশ্রমিকদের আর্তনাদে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভারী হয়ে উঠেছে। সারাদেশে প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিক ব্যাটারিচালিত রিকশা বা ইজিবাইক, ভ্যান ও রিকশা চালিয়ে জীবিকা অর্জন করে। এটা সাধারণ মানুষের একমাত্র বাহন। আর যা সহজেই পাওয়া যায়। এর সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রায় আড়াই কোটি মানুষের জীবনণ্ডজীবিকা সম্পৃক্ত। এসব রিকশা, ভ্যান, ইজিবাইক যাত্রী পরিবহন, পণ্য পরিবহন এমনকি রোগী পরিবহনের ক্ষেত্রেও দেশের সর্বত্র ব্যবহৃত হয়। বিদ্যুৎচালিত বলে এসব বাহন শব্দ দূষণ এবং পরিবেশ দূষণ করে না। এগুলো পরিবেশবান্ধবও বটে। ছোট ছোট গলিপথে চলাচল করতে পারে এবং ভাড়া কম এসব বাহন দ্রুত সারা দেশে প্রয়োজনীয় ও জনপ্রিয় বাহনে পরিণত হয়েছে। করোনায় যখন কর্মহীন ও দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, রাষ্ট্র কাজ এবং খাদ্য সরবরাহ করছে না তখন যারা নিজেরা ঋণ করে, নিজ উদ্যোগে কাজ করে জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করছে তাদেরকে উচ্ছেদ করা শুধু অন্যায় নয়, চূড়ান্ত অমানবিক। একজন ব্যাটারিচালিত রিকশাওয়াকে সেদিন বলতে শুনেছি, ‘আমরা রিকশা চালিয়ে যেই টাকা উপার্জন সেই টাকা গ্রামের বাড়ি পাঠাই, বিদেশে পাচার করি না। আমরা কখনো ঋণখেলাপী হই না। আমাদের বিদ্যুৎ বিল কখনো বকেয়া থাকে না, বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকে সরকারি প্রতিষ্ঠানের, বড় বড় শিল্প কারখানার। যাদের বিরুদ্ধে সরকার বা রাষ্ট্র দৃশ্যমান কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে না’।
ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক, ভ্যান এগুলো চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা যদি অবৈধ হয় তাহলে এগুলো আমদানি এবং বিক্রি বৈধ কেনো? আপনারা আমদানি করে বিক্রি করতে পারবেন আর আমরা গবির মানুষ সেগুলো কিনে চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করলেই দোষ। যতো দোষ আমাদের মতো গরিব মানুষদের। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক, ভ্যান এগুলো বন্ধের ঘোষণায় দরিদ্র মানুষগুলোর জীবন এবং জীবিকা আতঙ্ক ও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। অনেক পরিবার নিঃশ্ব হয়ে পড়বে। ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ভ্যান এগুলো আমাদের অভ্যন্তরীণ আয়ের একটি বড় সম্ভাবনা খাত হতে পারে। এগুলো বন্ধ না করে কীভাবে আধুনিক এবং যুগোপযোগী করা যায় সেদিকটা ভাবাই আমাদের জন্যে হবে সর্বোত্তম।
সারাদেশে শ্রমজীবী এবং সাধারণ মানুষের স্বার্থে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে সরে আসবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি। যেখানে ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক, ভ্যানগুলোর সাথে শ্রমজীবী এবং সাধারণ মানুষের জীবনণ্ডজীবিকা, স্বার্থ নিহিত আছে সেখানে ব্যাটারিচালিত রিকশা, ভ্যানগুলো বন্ধ করে দেয়া কতটা যৌক্তিক? দেশে করোনাকালীন কয়েক কোটি শ্রমজীবী এবং সাধারণ মানুষ কাজ হারিয়ে জীবনণ্ডজীবিকায় হিমশিম খাচ্ছে। তার ওপরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই ঘোষণা! করোনাকালীন প্রায় এক কোটি শ্রমজীবী মানুষ এবং সাধারণ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। ঠিক সেই সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যাটারিচালিত রিকশা, ভ্যানগুলো বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দেন যা সাধারণ মানুষ এবং শ্রমজীবী মানুষের জন্যে মরার ওপর খড়ার ঘাণ্ডএর মতো অবস্থা। এগুলো বন্ধ করে দিলে সাধারণ মানুষ এবং শ্রমজীবী মানুষ পথে বসা ছাড়া বিকল্প পথ থাকবে না। ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক ভ্যানগুলো প্রত্যেকে এনজিও থেকে লোন নিয়ে কিনেছে। ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক, ভ্যানগুলো বন্ধ করে দিলে তারা নানা রকম অপরাধের সাথে নিজেকে যুক্ত করে বাঁচার চেষ্টা করবে। সামাজিক অপরাধ, বিবাহ বিচ্ছেদ, আত্মহত্যার পরিমাণ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ বৃদ্ধি পাবে, পারিবারিক বন্ধন হ্রাস পাবে। এসব সামাসাজিক অপরাধ সংঘটিত হওয়ার কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ আয়ও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। সাধারণ মানুষের এবং শ্রমজীবী মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা, কাজের নিশ্চয়তা, দেশের অভ্যন্তরীণ আয়ের উন্নতি ও দেশের সার্বিক উন্নতির জন্যে ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক, ভ্যানগুলো বন্ধ না করে নকশা আধুনিকায়ন ও নীতিমালা প্রণয়ন করে কাঠামোগত পরিবর্তন করে ব্যাটারিচালিত/বিদ্যুৎচালিত যেতে পারে। এর মাধ্যমে নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করা সম্ভব এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে গতিশীলতা আসবে।
গত কয়েক দিন আগে একটি সংবাদে দেখলাম একজন লোক এই ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকে মিনিবাসে রূপান্তরিত করেছে এবং ওই মিনিবাস থেকে সে গড়ে প্রতিদিন ৮শ’ থেকে ৯শ’ টাকা আয় করছে। যা দিয়ে গ্রামের বাড়িতে দুটি পরিবার অনায়াসে চলতে পারে। আমারা যদি ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক, ভ্যানগুলোর নকশা আধুনিকায়ন ও নীতিমালা প্রণয়ন করে কাঠামোগত পরিবর্তন করে ব্যাটারিচালিত বা বিদ্যুৎচালিত যানবাহনের লাইসেন্স প্রদান করতে পারি। প্রকৌশলী, পরিবহন বিশেষজ্ঞ, বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় অভিজ্ঞ মেকানিকদের নিয়োগ দিয়ে ব্যাটারিচালিত যানবাহনের যথোপযুক্ত নকশা এবং নিরাপদ ব্রেক পদ্ধতি নিশ্চিত করতে পারলে এগুলো আমাদের জন্যে আরও নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব হবে। প্রতিটি সড়কণ্ডমহাসড়কে রিকশা, ইজিবাইকসহ স্বল্পগতির এবং জনগণের সীমিত গতির যানবাহন চলাচল করার জন্যে পৃথক লেন বা সার্ভিস রোড নির্মাণ করে সহজে চলাচলযোগ্য করা। সর্বত্র স্থানীয় নির্যাতনণ্ডহয়রানি, পুলিশি হয়রানি নির্যাতন ও চাঁদাবাজি বন্ধ করা। সারাদেশে রিকশা, ভ্যান, ইজিবাইকসহ ব্যাটারিচালিত যানবাহন চলাচল বন্ধের অযৌক্তিক ও গণবিরোধী সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে ৫০ লাখ মানুষের আত্মকর্মসংস্থান ও আড়াই কোটি মানুষের জীবনণ্ডজীবিকা রক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণে যুগোপযোগী ও কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণও বাস্তবায়ন করা। সমস্যা থাকলে তা সমাধানের জন্যে নতুন পথ খুঁজে বের করতে হবে। যাত্রীসাধারণের সুবিধার্থে ভাড়া নির্ধারণ করে দিতে হবে। পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করলে ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক, ভ্যানগুলো একদিন আমাদের অর্থনীতির জন্যে আশীর্বাদ হয়ে উঠবে বলে আমরা সাধারণ জনগণ বিশ্বাস করি। আসুন, আমরা ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক, ভ্যানগুলোকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলি, যা আমাদের অর্থণীতিকে সামনের দিকে নিয়ে যাবে এবং নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তুলতে পারবো।
লেখক : শিক্ষক, হাইমচর সরকারি মহাবিদ্যালয়, হাইমচর, চাঁদপুর।