রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২১, ০০:০০

যাত্রী ছাউনিতে গ্রন্থাগার

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার

যাত্রী ছাউনিতে গ্রন্থাগার
অনলাইন ডেস্ক

লকডাউনে ঘরে বসে সাহিত্যচর্চা করার এক অফুরন্ত সুযোগ। আর এ চর্চার মূল উপাদান হলো বই। বই থাকে লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মোট জনসংখ্যার তুলনায় লাইব্রেরির সংখ্যা খুবই কম। বিপুল জনসংখ্যার বিপরীতে এ কমসংখ্যক লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা আরও কম। এসব লাইব্রেরি মূলত শিক্ষার্থী কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সাহিত্যচর্চা এবং তা থেকে জ্ঞান আহরণে যে কেউ লাভবান হতে পারে যে কোনো বয়সে। রবীন্দ্রণ্ডনজরুল কেউণ্ডই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। কিন্তু তারা সাহিত্যের পণ্ডিত ছিলেন। তাদের রচিত বই নিম্ন শ্রেণি থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত পড়ানো হচ্ছে, হচ্ছে গবেষণাও। দেশে সাধারণ তথা আমজনতার জন্য লাইব্রেরি নেই বললেই চলে। এ নিয়ে কেউ কোনোদিন আপত্তি করেনি আবার তেমন কোনো উদ্যোগও লক্ষ্য করা যায়নি। তাই বলে এতদিন যা হয়নি তা এখন কিংবা ভবিষ্যতে হবে না তা কিন্তু নয়। দেশের সার্বিক উন্নয়ন এখন দৃশ্যমান। উন্নয়নের এ ধারায় সর্বস্তরের জনগণের জন্য সংযুক্ত হতে পারে গ্রন্থাগার। দেশের সিংহভাগ লোকই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পায় না। দরিদ্রতা, বাল্যবিয়ে, অল্প বয়সে সংসারের হাল ধরাসহ নানাবিধ কারণে শিক্ষার সুযোগ থেকে অনেকেই বঞ্চিত। আবার যারা অল্প শিক্ষিত, শুধু লিখতেণ্ডপড়তে পারে অথচ কর্মব্যস্ততার কারণে এবং সময় ও সুযোগের অভাবে প্রাতিষ্ঠানিক লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়া কিংবা জ্ঞানচর্চার সুযোগ পায় না, তাদের জন্য ব্যাপক হারে গণগ্রন্থাগার কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায় সে আলোচনাই এখানে। শহরণ্ডবন্দরণ্ডগ্রাম নির্বিশেষে মানুষের যাতায়াতের জন্য আছে অসংখ্য যাত্রী ছাউনি। বাস, লঞ্চ, ট্রেন নির্দিষ্ট সময়ে ছাড়া কিংবা আসার প্রচলন এখনো তেমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি আমাদের দেশে। যাত্রীরা এসব স্থানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও পরিচালনার অভাবে এখানে থাকে পান/বিড়ি/সিগারেটের দোকান। থাকে ফকির, মিসকিন, পাগল, মানসিক বিকারগ্রস্ত, নেশাগ্রস্ত ও হকারের দখলে। পরিষ্কারণ্ডপরিচ্ছন্নতা তো নেই বললেই চলে। উন্নত দেশের এসব যাত্রী ছাউনিতে টাঙানো থাকে পরিবহন আসাণ্ডযাওয়ার সময়সূচি। থাকে পত্রণ্ডপত্রিকা, ম্যাগাজিনসহ নানাবিধ গল্পের বইয়ের একটি মিনি স্টল। পরিবহন না আসা পর্যন্ত যাত্রীরা ওই স্টল থেকে বিনামূল্যে এসব বই, ম্যাগাজিন পড়ে এবং যাওয়ার সময় যথাস্থানে রেখে যায়। ইচ্ছা করলে কিনেও নিতে পারে। অত্যন্ত পরিষ্কারণ্ডপরিচ্ছন্ন, কোলাহলমুক্ত ও সুশৃঙ্খল একটি পরিবেশ। অর্থাৎ পারিপার্শ্বিক অবস্থাই ওদের জ্ঞানচর্চা ও ভদ্র হতে শেখায়। ওইসব দেশের আদলে আমরাও এ রকম উদ্যোগ নিতে পারি।

আগেই বলেছি সারা দেশে অসংখ্য যাত্রী ছাউনি আছে। সাধারণত এগুলো সরকার কিংবা স্থানীয় সরকারের আওতাধীন বিভিন্ন ইজারাদারের মাধ্যমে বার্ষিক চুক্তিতে পরিচালিত হয়। এসব যাত্রী ছাউনিতে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হলে দরকার ইচ্ছা, আন্তরিকতা ও পরিকল্পনা। তাহলে কে নেবে উদ্যোগ? সরকার তো অবশ্যই নেবে। সরকারের পাশাপাশি উদ্যোগ নিতে পারে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, পেনশনভোগী অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সমাজসেবী, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, ক্লাব, সংগঠন, ব্যবসায়ী সংগঠন এমনকি বিদেশি প্রতিষ্ঠানও। সড়ক, নৌ ও রেল যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে পরিকল্পিত মাস্টার প্ল্যান করা যেতে পারে। পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করতে পারে নগরণ্ডঅঞ্চল পরিকল্পনাবিদরা। উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি চালু হয় দেশের চারটি বড় শহরণ্ড ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীতে। আজ ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি দেশের প্রায় সবকটি জেলা এবং উপজেলায় বিস্তার লাভ করেছে। এ লক্ষ্যে প্রথমেই ঠিক করে নিতে হবে যাত্রী ছাউনির সঠিক সংখ্যা এবং তা নিবন্ধিত করতে হবে। প্রতিষ্ঠিত পত্রিকার মালিকরা এখানে সৌজন্য সংখ্যা পাঠাবে, প্রকাশকরাও তাদের বইয়ের মার্কেটিংয়ের জন্য কিছু বই এখানে রাখবেন। সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তিও অনুদান হিসেবে নিজেদের প্রকাশিত বই যা সমাজ উন্নয়নে সহায়ক, এখানে রাখতে পারেন। দেশে আছে অসংখ্য গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে ডিগ্রিধারী জনবল। সুষ্ঠুভাবে এসব গ্রন্থাগারগুলো পরিচালনার জন্য নিয়োগ করা যেতে পারে তাদের। যে দায়িত্বে থাকবে সেণ্ডই পরিষ্কার, পরিচ্ছন্নতাসহ রক্ষণাবেক্ষণের সার্বিক দায়িত্ব পালন করবে। অর্থাৎ কর্মসংস্থানের একটি বিপুল সম্ভাবনা দেখা দেবে, ফলে বেকারত্ব কমবে এবং সংশ্লিষ্ট কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। অনেকেই বলবেন ইন্টারনেটের এ যুগে গুগল সার্চ করে যে কোনো তথ্যই খুব সহজে পাওয়া যায়। অথচ ইংরেজ লেখক নীল গাইমান বলেছেন, ‘গুগল হয়তো আপনাকে এক লাখ উত্তর দিতে পারে, কিন্তু একজন লাইব্রেরিয়ান আপনাকে সঠিক উত্তরের সন্ধান দিতে পারে।’ বিখ্যাত মার্কিন লেখক ও চিত্রনাট্যকার রে ব্র্যাডবারি বলেছেন, ‘গ্রন্থাগার ছাড়া আমাদের কী আছে? আমাদের না আছে অতীত, না আছে ভবিষ্যৎ।’ বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রাবন্ধিক, কবি ও লেখক প্রমথ চৌধুরী তাঁর ‘বই পড়া’ প্রবন্ধে বলেছেন, সাহিত্যচর্চা শিক্ষার প্রধান অঙ্গ এবং সাহিত্যচর্চার জন্য লাইব্রেরি অপরিহার্য। তাই তিনি লাইব্রেরিকে স্কুলণ্ডকলেজের ওপর স্থান দিয়েছেন। পৃথিবীর যে কোনো সুস্থ সমাজের ভিত্তি হচ্ছে গ্রন্থাগার। গ্রন্থাগার মানুষকে নতুন ধারণা, জ্ঞান অর্জন, চাকরির অনুসন্ধান এবং বিশেষত চমৎকার সব গল্পের জগতে হারিয়ে যেতে সাহায্য করে। গণতন্ত্রের সাফল্যেও গ্রন্থাগারের ভূমিকা রেডিও, টেলিভিশন কিংবা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মিডিয়ার চেয়ে কম নয়। এ লক্ষ্যে এসব লাইব্রেরিতে একটি বড় ডিজিটাল মনিটর রাখা যেতে পারে। যেখানে সরকারি প্রজ্ঞাপন, নির্দেশনা, নাগরিক সেবামূলক বার্তা, আবহাওয়ার পূর্বাভাসসহ নানাবিদ জরুরি হেডলাইন প্রদর্শিত হবে। আসলে একটি জ্ঞানদীপ্ত আধুনিক সমাজ বিনির্মাণে গ্রন্থাগারের বিকল্প নেই। গ্রন্থাগার আলোকিত মানুষ তৈরি করে। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম যেভাবে ফেসবুক, টুইটার, টিকটক ইত্যাদি আধুনিক ডিজিটাল অ্যাপসের দিকে ঝুঁকে বসেছে, সেখান থেকে ফিরিয়ে আনতে এসব লাইব্রেরি যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে। প্রকৃতপক্ষে গ্রন্থাগার কেবল বইয়ের কোনো সংগ্রহশালা নয়, কিংবা শুধু সমাজ সংস্কারের কাজই করে না, এটি সমাজের একটি দর্পণ এবং সামগ্রিক সমাজ বিকাশের স্থায়ী উপকরণ হিসেবে ভূমিকা পালন করে। তাই শুধু যাত্রী ছাউনিতেই নয়, শহরণ্ডগ্রামণ্ডমহল্লায় জ্ঞান বিতরণের এ আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে হবে এবং কীভাবে স্থায়ী রূপ দেওয়া যায় সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করা দরকার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে এ যাত্রার শুভ সূচনা হোক।

লেখক : অধ্যাপক ও পরিচালক, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়