প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০
‘বিজয়’ এই শব্দটির সঙ্গে মানুষের চেতনার কিছু রং মিলেমিশে থাকে। সেই রং আনন্দের, উচ্ছ্বাসের, উন্মুখ অভিব্যক্তির। সেই রং ভালোবাসার, শ্রদ্ধার ও সম্মানের। বিজয়ের সেই রং কখনো কখনো মিশে থাকে হৃদয়ের রক্তক্ষরণের সঙ্গে, অশ্রুসিক্ত মানুষের আর্তনাদের সঙ্গে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধশেষে আমাদের বিজয় অর্জিত হয়। সুতরাং আমাদের বিজয়ের রং অভিমিশ্র আনন্দ-বেদনার এবং শোক ও সম্ভ্রমের।
আমাদের প্রাণের মানুষ, আমাদের চিরকালের আরাধ্য পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পঞ্চান্ন বছরের ছোট এক জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এই বিজয় ছিনিয়ে আনার জন্য। খুব শৈশব থেকে তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে, পাকিস্তানি শাসকদের হাত থেকে, তাদের নিপীড়ন-নির্যাতনের হাত থেকে, তাদের অন্যায় ও অবিচারের হাত থেকে এই দেশকে মুক্ত না করতে পারলে কোনোদিন এদেশের মানুষের সত্যিকারের মুক্তি আসবে না। সুতরাং তিনি নিরন্তর সংগ্রামের মাধ্যমে, মিছিল-মিটিং ও প্রচারণার মাধ্যমে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-পেশা নির্বিশেষে এদেশের সকল মানুষকে একত্রিত করতে পেরেছিলেন।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান যে জীবন যাপন করেছিলেন, সেই জীবন মিলেমিশে আছে এদেশের প্রতিটি মানুষের সঙ্গে আত্মীয়তার গভীর বন্ধনে। ফলে অনিবার্যভাবেই এদেশের মানুষ তাঁর নেতৃত্বে একসময় বিস্ময়কর এক শক্তির উৎসে পরিণত হয়। আর সেই শক্তির পরিচয় আছে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ ও উজ্জীবিত হয়ে ওঠার মধ্যে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি পরিষ্কারভাবে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেয় যে, তারা আর বিচ্ছিন্ন নয়; তারা সমবেত, একত্রিত, আর কোনো অন্যায়, অবিচারের কাছে মাথানত করবে না। কিন্তু নির্বোধ, অপরিণামদর্শী শোষক শ্রেণি কখনোই সুন্দরের শক্তি ও মাহাত্ম্য বুঝতে পারে না এবং ওই অপশক্তি কোনোদিন সত্য ও সুন্দরের কাছে মাথা নত করতে চায় না।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষের মঙ্গলের কথা, কল্যাণের কথা ভেবে আত্মগোপন না করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের হাতে ধরা দেন এবং ‘নির্বাসিত হন পাকিস্তানে, তাঁকে অন্তরিণ করা হয় অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠে। তাঁর এই নির্বাসন, কারারুদ্ধ অবস্থা, নিপীড়ন-নির্যাতন বাঙালি জাতিকে আরও বেশি শক্তিমান, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, প্রত্যয়ী এবং অঙ্গীকারাবদ্ধ করে তোলে। সেই প্রত্যয়, প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারের রক্তঝরা অধ্যায় নিহিত আছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে।
সময় এক নির্মম ও নিষ্ঠুর বাস্তবতা। শান্তিকামী, গণতান্ত্রিক পথে নির্বাচিত একটি জাতিকে পাকিস্তানি অপশক্তির প্ররোচনায় যুদ্ধকেই অনিবার্য করে তুলতে হয়। সেই যুদ্ধে কত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, কত মানুষ আপনজনকে হারিয়েছেন, কত মা হারিয়েছেন স্নেহের সন্তানকে, কত সন্তান হারিয়েছেন গভীর আশ্রয়স্থল বাবাকে, মাকে; কত স্ত্রী হারিয়েছেন তার প্রিয়তম স্বামীকে, কত বোন হারিয়েছেন প্রিয় ভাইটিকে; কত বাবা, কত ভাই, কত স্বামী তার প্রিয়তম স্ত্রী, পরম আত্মীয় মা, ভালোবাসার মানুষ বোনটিকে দেখেছেন নির্যাতিত, নিপীড়িত, অত্যাচারিত হতে। এই বিপুল হারানোর পটভূমিতে আমরা অর্জন করি আমাদের বিজয়। সুতরাং বিজয়ের রং যে বহুতর আনন্দের রঙে রঙিন ও ফুল্ল হয়ে উঠবে, তা নয়- বিজয়ের রং গভীর বেদনা আর মর্মন্তুদ যন্ত্রণারও হতে পারে।
তবুও আজ অর্ধশতাধিক বছর পরে আমরা যে বিজয়ের সম্মুখীন হই, সেই বিজয় সমৃদ্ধি ও স্বপ্নের কত যে বার্তা বহন করে, তার ইয়ত্তা নেই। প্রতিটি বছর আমাদের জীবনে বিজয় আসে অফুরন্ত প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞা নিয়ে, জাতিগত ঐক্য আর সমৃদ্ধির বার্তা নিয়ে, একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনের আহ্বান নিয়ে। আজ আমরা যে বিজয়ের সম্মুখীন হচ্ছি তার রূপ-রস-ঐশ্বর্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। পেছনের দিকে তাকানোর সময় নেই এখন। এখন বিজয় মানে ঐক্যের প্রতিশ্রুতি, বিজয় মানে সমৃদ্ধির অঙ্গীকার।
বিজয়ের আরেক নাম অধিকার। খাদ্যের, বাসস্থানের, স্বাস্থ্যের, শিক্ষার অধিকার। যা আমরা অনেকাংশে অর্জন করেছি। তারপরই আসে মুক্তচিন্তার, গণতান্ত্রিক জীবনাচরণের, অসাম্প্রদায়িক জীবনতৃষ্ণার এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অধিকার। এর ভেতর দিয়ে নিজেকে, পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনকে, সমাজকে, রাষ্ট্রকে নিজের মনের মাধুরী দিয়ে সুন্দর করে তোলার প্রত্যয়ই হবে এখন বিজয়ের আনন্দ অভিষেক। একই সঙ্গে মিথ্যার বিরুদ্ধে, অন্যায়ের-অবিচারের বিরুদ্ধে, শোষণ-নিপীড়ন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস ও শক্তি অর্জন করাও হবে বিজয়ের প্রেরণা।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে আমরা এই বিজয় অর্জন করেছি, আমরা এই অধিকার অর্জন করেছি। সেই থেকে চলছে আমাদের দেশকে নিজেদের মতো করে গড়ে তোলার সংগ্রাম- মুক্তিযুদ্ধের মতোই আরেক যুদ্ধ। কিন্তু সেই যাত্রাপথের বিভিন্ন মোড়ে ওঁৎপেতে থাকা শত্রুদের নির্মম আক্রমণের শিকার হয়েছে বাঙালি জাতি। স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে দীর্ঘদিন এই জাতি পিষ্ট হয়েছে, পিছিয়ে পড়েছে। কিন্তু কিছুতেই বাঙালি জাতিকে, বিজয়োন্মত্ত জাতির গতিকে প্রতিহত করতে পারেনি কেউই। গত এক যুগ ধরে বাংলাদেশের ইতিহাসে মানব উন্নয়নের বিচিত্র ক্ষেত্রে যে অর্জন হয়েছে তার সূচক অসাধারণ এবং ঈর্ষণীয়। শিক্ষার ক্ষেত্রে, দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে, নারীশিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে, মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে অগ্রগতি লাভ করেছে তা সত্যিই অসাধারণ।
তারপরও বলব, আমরা এখনো অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারিনি। অসাম্প্রদায়িক জীবনভাবনার যে অধ্যায় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেই জীবনবাস্তবতা আজও আমরা লাভ করতে পারিনি। আমরা এখনো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সৌন্দর্যকে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। এখনো মনে হয়, সম্পদের সুষম বণ্টনের যে আদর্শ নিয়ে এদেশের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেই সাম্যের বাংলাদেশ এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বাঙালি জাতিসত্তার দীর্ঘ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির যে সমৃদ্ধ ভাণ্ডার আছে সেই ঐতিহ্যকে লালন করার ক্ষেত্রেও অনেক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে আমাদের উত্তরণ ঘটাতে হবে।
একটি মানবিক, অসাম্প্রদায়িক ও দেশপ্রেমমূলক শিক্ষার ভেতর দিয়ে আমরা নিশ্চয়ই অদূর ভবিষ্যতে এমন এক বাংলাদেশকে দেখব, যে বাংলাদেশে দারিদ্র্য, সাম্প্রদায়িকতা ও অসহিষ্ণুতা থাকবে না, অন্যায়-অবিচার ও শোষণ-বঞ্চনা থাকবে না। আমাদের বিজয় আমাদের অফুরন্ত ভালোবাসা।