প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০
সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্য সামনে রেখে মানুষের আত্মিক ও নৈতিক উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়াই হলো মানবিক উন্নয়ন। মানবিক উন্নয়নের ফলে অন্যের মতামত, আচার-আচরণ, ভাব-ভাষা ও বিভিন্ন ধর্ম, শ্রেণি, সংস্কৃতির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি সহনশীল হয়। উন্নয়নকে পরিপক্ব করার জন্য জনহিতকর উদ্যোগ বা মানবিক উন্নয়নের গুরুত্ব অপরিসীম। মানবিক রাষ্ট্রের পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত না হলেও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়, করোনা মহামারি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে মানবিকতাকে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি সামনে এসেছে।
চলতি বছরের মার্চে প্রকাশিত ‘বিপ্লব ও মানবিকতা’ গ্রন্থের সম্পাদকীয়তে শেখ ফজলে শামস্ পরশ বলেছেন, ‘বর্তমান যুবলীগের অন্যতম লক্ষ্য রাষ্ট্রের মানবিক ধারাকে গতিশীল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা এবং মানুষের সুখে-দুঃখে সহমর্মী হওয়া। এ লক্ষ্যে যুবলীগ ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য মানবিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে ‘মানবিক যুবলীগে’ পরিণত হয়েছে।’
যুবলীগ যুবদের সংগঠন। যুবসমাজ একটি জাতির স্তম্ভ; সভ্যতা, সংস্কৃতি ও উন্নয়নের কারিগর। তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্তিশালী, জাগ্রত জ্ঞানের অধিকারী এবং রাষ্ট্র-সমাজের পরিবর্তন ও সংগ্রামের অগ্রনায়ক। মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রাণোৎসর্গকারীদের বিশাল অংশ ছিল যুব।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের বড় অধ্যায়ও যুব বয়সের। বাংলার যুবারা ছিল তার প্রাণ। যুবাদের ওপর ভর করেই তিনি এঁকেছিলেন সাফল্যের নকশা। তার যুবসমাজ ভাবনার গভীরে রয়েছে বাংলা, বাঙালি, বাংলাদেশের চূড়ান্ত মুক্তি ও বিশ্বরাষ্ট্রে বাঙালির মাথা উঁচু করে নেতৃত্ব দেওয়ার দর্শন। তিনি চেয়েছেন দেশপ্রেমিক যুবসমাজ।
১৯৭৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘জোয়ান ভাইয়েরা, দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন-এ হবে তোমাদের ব্রত। মানুষকে ভালোবেসো, মানুষকে সেবা করো। বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য বাংলার জনগণের পাশে থেকে তোমরা কাজ করো।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছায় রাজনীতিতে আসা এবং বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে রাজনৈতিক দীক্ষা পাওয়া শেখ ফজলুল হক মণি তার আজীবন রাজনৈতিক শিক্ষক বঙ্গবন্ধুর দর্শন বাস্তবায়নে সচেষ্ট ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে মুক্তির পথ দেখাতে গিয়ে তিনি অনেক ক্ষমতাবানেরও বিরাগভাজন হয়েছেন।
তিনি একাধারে লেখক, সাংবাদিক, তাত্ত্বিক, দার্শনিক, সম্পাদক এবং শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার নির্ভীক সংগঠক। শেখ ফজলুল হক মণি শুধু স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ চাননি, সেই সঙ্গে চেয়েছেন স্বাধীন সমাজব্যবস্থা, যা বঙ্গবন্ধু ও মুজিববাদের অন্যতম দর্শন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তিনি মুজিববাহিনী গঠন করেছিলেন, যার অন্যতম লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর দর্শনের আলোকে একটি শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে এবং মুজিববাদের আলোকে স্বাধীনতা ও যুগপৎ সমাজবিপ্লব বাস্তবায়ন করা ছিল অত্যন্ত কঠিন। শেখ ফজলুল হক মণি সেই কঠিন সংগ্রামকেই ব্রত হিসাবে নিয়েছিলেন। এ কারণেই হয়তো তিনি স্বাধীনতার সময় ভারত সরকারের কাছ থেকে পাওয়া ‘শিক্ষকতার প্রস্তাব’ গ্রহণ করেননি অথবা স্বাধীনতার পর মন্ত্রিত্বের পদে বা ক্ষমতার চেয়ারে বসেননি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশের প্রথম যুব রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী যুবলীগ। তিনি যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তরুণ নেতাকর্মীদের মাঝে পড়াশোনা, দেশসেবার দীক্ষা ও সাংস্কৃতিক চেতনা ছড়িয়ে দিতে তিনি বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার কিছু আগে ঘাতকরা শেখ ফজলুল হক মণি ও তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী সামসুন্নেসা আরজুকে হত্যার মাধ্যমে সে পথ রুদ্ধ করে। খুনি হায়েনা দল ও তাদের দোসরদের হত্যা, লুটতরাজ ও সন্ত্রাসের বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে কখনো আত্মীয়ের বাসায়, কখনো পলাতক থেকে, কখনো অন্য রাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়ে বড় হয়েছেন শেখ মণির দুই সন্তান শেখ ফজলে শামস্ পরশ ও শেখ ফজলে নূর তাপস।
বলা যায়, ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিসহ সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের প্রেক্ষাপটে যুবলীগের সপ্তম কংগ্রেসে (২৩ নভেম্বর ২০১৯) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান শেখ ফজলে শামস্ পরশ। দায়িত্ব নিয়ে তিনি নেতৃত্ব নির্বাচনের মানদণ্ড নির্ধারণসহ পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ গড়তে নেতাকর্মীদের শপথ করান। দরিদ্র ও আশ্রয়হীনদের জন্য ঘর নির্মাণ, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, হিজড়া ও অবহেলিত-প্রান্তিক সম্প্রদায়কে সহযোগিতা, করোনার সময়ে দুস্থদের জন্য অ্যাম্বুলেন্স, টেলি মেডিসিন এবং বিনামূল্যে অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থাসহ অনেক মানবিক কর্মসূচি তিনি বাস্তবায়ন করেন। তার প্রায় তিন বছরের নেতৃত্বে যুবলীগের নেতাকর্মীদের নামে-বেনামে ব্যানার-ফেস্টুন ও প্রচার-প্রচারণা বন্ধ হয়। বিতর্কিত কর্মকাণ্ড থেকে নেতাকর্মীদের দূরে রাখা, যুবলীগের নেতিবাচক খবর বন্ধ করা এবং ‘মানবিক যুবলীগ’ কথাটির ব্র্যান্ডিং করার ক্ষেত্রে তিনি যুগান্তকারী ভূমিকা রাখেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে ডিগ্রিধারী শেখ ফজলে শামস্ পরশ বিভিন্ন সভা-সমাবেশে মানবিক সমাজব্যবস্থার ব্যাখ্যা করার প্রয়াস নিয়েছেন। ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর এক বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, ‘আপনাদের হাত ধরে আগামী দিনের যুবলীগ এদেশে মানবিক সমাজব্যবস্থা কায়েম করবে। যে সমাজে আপনাদের মানবিকতাই প্রধান চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করবে এবং এই মানবিকতাই মূল্যবান সম্পদ হিসাবে বিবেচিত হবে। মানবিক সমাজব্যবস্থা কায়েম হলে অন্যায়-অবিচার থাকবে না, এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।’
যুবলীগের নেতৃত্বে যুবসমাজ হোক মানবিক; অন্যায়, সন্ত্রাস, দুর্নীতিসহ সব ব্যাধির প্রতিবন্ধক। বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এ প্রত্যাশা করি।
ড. মুহম্মদ মনিরুল হক : শিক্ষা ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ।