প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
মুক্তভাবে বেড়ে ওঠা ঘাসের ডগায় শিশিরদানার দ্যুতি অনন্যার মন নির্মল করে দেয়। নগ্ন পায়ে ঘাসের জমিনে পা ফেলে। বহুদিনের অনাদরের পর আপ্লুত বালকের খুশির অশ্রুতে যেমন গাল ভিজে ওঠে, তেমনি করে অনন্যার পা ভিজে ওঠে শিশিরের মায়ায়। আর সেই মায়ার প্রচ্ছন্ন টানে সে হাঁটু গেড়ে বসে পরম মমতায় ঘাসের বুকে হাত বুলাতে থাকে। চমকে ওঠে অনন্যা, যেন মায়ের স্পর্শ! এই মাটির সঙ্গেই মিশে আছে তার মা। হাত দশেক দূরে কামিনী গাছের পাহারায় শুয়ে থাকা মায়ের আঁচলের দিকে চোখ পড়ে তার। বুকের ভেতরে যে অনুভূতির কোঠর থাকে সেইখানে এক পশলা বেদনা চিমটি কেটে ওঠে। কষ্টের আঁচড়ে দলা পাকিয়ে ওঠা কান্নার ঢেউকে প্রতিহত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে অনন্যা মায়ের আঁচলের ওপর আছড়ে পড়ে। এই মাটির কবরে শুয়ে আছেন তার মা, সেই কবরকে তার মায়ের আঁচল মনে হয়।
অনন্যার কাছে স্পষ্ট হয়ে আসে নিজের অপরাধনামা। সীমাহীন অপরাধবোধ তার মনকে কারাগারে নিক্ষিপ্ত করে। এই মানসিক যন্ত্রণার মতো কঠিন সাজা জগতে আর একটিও নেই।
নিজের বুকে আঘাত করতে থাকে অনন্যা। মা, মাগো, ওমা, মা। আর কোনো শব্দ তার মুখ থেকে বেরোয় না। জগতের সব শব্দরা যেন এই একটি শব্দ 'মা'তে এসে ভর করেছে। কবরকে জড়িয়ে ধরে ঘাস-মাটিতে সে গড়াগড়ি খায়, যেমন করে শিশুকালে আদরের আবদারে মায়ের কোলের মধ্যে ঢুকে যেতে চাইত, তেমন করে।
সূর্যকিরণের প্রতাপ যত বাড়তে থাকে, শিশিরের ফোঁটাগুলো মিইয়ে আসে ক্রমেই। মাটি ঘাস শিশিরকণায় স্নাত অনন্যার অন্তরের কাঁপন দমিত হয় না। ইচ্ছে করে মাটি সরিয়ে মাকে বের করে এনে তার পায়ে লুটিয়ে পড়তে। এই তো মাত্র সাড়ে তিন হাত গভীরে মা ঘুমিয়ে আছেন। হাত বাড়ালেই হয়তো ছুঁয়ে দেওয়া যায়, তবু চিরকাল এ যেন যোজন যোজন দূরত্বের কোনো গ্রহ। এটুকু দূরত্ব অতিক্রম করে কেউই সেখানে পৌঁছতে পারে না।
কত কষ্টই না সে দিয়েছে তার মাকে। অন্তরের এই দহন, এই অনুশোচনাবোধ, চিরদিনের জন্য মাকে হারিয়ে ফেলা, এর চেয়ে কঠিন শাস্তি আর কী আছে!
আজ মা নেই, অথচ মায়ের কথাগুলো সত্য হয়ে তার সামনে হাজির হয়েছে। অনন্যা অন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সত্য তার সামনে থাকা সত্ত্বেও সে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছিল মিথ্যার প্রলোভনে। ভালো-মন্দের হিতাহিত জ্ঞান
হারিয়ে ফেলেছিল সে। হাজারবার বোঝানোর পরও মায়ের কথাকে অগ্রাহ্য করে ভুল মানুষের সঙ্গে ভুল সম্পর্কে জড়িয়েছিল। বিধাতা সেই কর্মের ফল এত দ্রুত যে দেবেন ভাবতেও পারেনি সে।
মা বলেছিলেন, আজ তুই যেখানটায় আছিস আমিও এই জায়গাটা পেরিয়ে এসেছি। এমন ভুল করিস না, যার দায় জীবনভর তোকে বহন করতে হয়। অনন্যা শোনেনি মায়ের কথা। এসএসসি পরীক্ষার শেষ দিনেই সে আর বাড়ি ফেরেনি। চলে গিয়েছিল সেই ছেলেটির সঙ্গে। যারা তাকে সাহায্য করেছিল আজ তারাই আবার তাকে ফিরে আসতে সাহায্য করছে। তারাই বলে, এই ছেলের সঙ্গে তোর কোনোদিন সুখ হবে না। চলে যা মায়ের কাছে। অনন্যা চলে এসেছে অনেক কিছু হারানোর পর, অনেক চেনা, অনেক জানার পর তার উপলব্ধি হয়।
ভুল থেকে অনেকেই ফিরে আসে। কিন্তু ততদিনে ভুলের পাহাড় সৃষ্টি হয়ে যায়। সেই পাহাড়ের বোঝা বয়ে চলা কঠিন, যদি সময় থাকতে নিজেকে না ফেরায়।
অনন্যার চলে যাওয়ার বেদনা কাউকে দেখাতে পারেনি তার মা। পড়শিরা সান্ত¡না দিতে এলে বলত, মেয়ে যদি ভালো থাকে তো থাকুক যেথায় তার সুখ। বলত, ওর আর কী দোষ, ওর রক্তে মিশে আছে এই প্রস্থান। ওর বাবাও আমাকে ছেড়ে গিয়েছিল অন্য কারও আহ্বানে। আবার ফিরে এসেছিল নিজেই, কিন্তু যে চলে যেতে চায় তাকে আমি মুক্ত করে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, মেয়েটা মানুষ হোক, মায়ের দুঃখ বুঝবে।
বেদনা লুকিয়ে অন্তরের রোগ বাড়িয়ে তুলেছিল অনন্যার মা। সেই রোগ থেকে মুক্তিলাভ তার আর হয়নি। যেতে যেতে হাসিমুখে বলেছিল, মেয়েটা আসবে শিগগিরই। ফিরে আসবে নিজের বেদনা লুকাতে। মায়ের আঁচলে অশ্রু মুছতে। কিন্তু ততদিনে ঘাসেরা অবাধে বেড়ে উঠবে মায়ের বুকের জমিনে।
হৃদয়ে শীত জমে ওঠা পড়ন্তবেলায় একটুখানি রোদের আশায় গোঙাতে থাকে অনন্যা। মা, মাগো, আমাকে বুকে নাও, এই ভার তো আর নিতে পারছি না মা। তোমার স্নেহের উষ্ণতায় আমার পাপের বরফ গলিয়ে দাও মা। তোমাকে কষ্ট দিয়ে আমি সীমাহীন কষ্টে নিমজ্জিত হচ্ছি।
সন্ধ্যা নেমে এলেও অনন্যা টের পায় না। প্রকৃতিতে নেমে আসা আঁধারের চেয়েও তার অন্তরের আঁধারের ঘনত্ব আরও গভীর। মা নেই, তো কে ঘুচাবে এই আঁধার!