প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
কক্সবাজারের মহেশখালী দ্বীপে আগেও এসেছি, তবে এবারের ভ্রমণসঙ্গী মা। মূলত মাকে নিয়েই এবারের ভ্রমণ। কক্সবাজারের ছয় নম্বর ঘাট থেকে সকাল ১০টার দিকে স্পিডবোটে উঠি। যাত্রী ১২ বা ১৩ জন। ভাড়া ১০০ টাকা করে। কিছুটা চলার পর বাকখালী চ্যানেল শেষ। এরপর বঙ্গোপসাগরের মোহনা। এরপর আবার মহেশখালী চ্যানেল। দ্রুত চলায় সাগরের ঢেউয়ের সঙ্গে স্পিডবোট মাঝেমধ্যে জাম্প করে। যেন ঢেউয়ের উপর দিয়ে স্পিডবোট উড়ে চলছে। মঝেমধ্যে ঢেউয়ের ছিটাও গায়ে লাগছে। দারুণ এক রোমাঞ্চকর। বোটের অন্য যাত্রীরা কেউ কেউ আনন্দ পাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আছেন। ১৫ মিনিটের মাথায় বোট থামে আদিনাথ জেটিতে।
বেশ উঁচু এ জেটি। সাগরের পানি বাড়লে যাতে যেটি ডুবে না যায়, সেজন্যই এত উঁচু। জেটিতে দাঁড়িয়ে ডানে-বামে তাকালে দেখা মেলে সবুজ ম্যানগ্রোভ বন। বনটি কিছুটা সুন্দরবনের মতো দেখায়। এ বনের ওপর দিয়েই জেটি থেকে আদিনাথ মন্দির পর্যন্ত পাকা সেতু বা পথ। এ পথের দুই পাশেই ম্যানগ্রোভ বন। পথটি প্রায় বনের গাছের সমান উঁচু। দুইপাশে গাছগাছালির মধ্যে আছে সুন্দরী, গড়ান, গোলপাতাসহ লোনা পানির গাছ। জেটি থেকে আদিনাথ মন্দির পর্যন্ত অটোরিকশা আছে, তবে আমরা হেঁটেই চলছি।
প্রায় দশ মিনিটের মাথায় চলে আসি আদিনাথ মন্দিরের সম্মুখে। মন্দির গেটের বাইরে দু’পাশে নানা পণ্যের দোকান। কিছু দোকানের সামনে মাটির পাত্রে লাল জবাফুল, কমলা, শসা, বেল, কলাসহ নানা ফলমুল সাজানো। মূলত মন্দিরে আসা পুণ্যার্থীরা প্রার্থনার জন্য ফলমুল সাজানো এ পাত্র কেনেন। এছাড়া গেটের দু’পাশে আরও আছে আদিবাসী রাখাইনদের তাঁতে বোনা সালোয়ার-কামিজ, লুঙ্গি, শাল, ওড়না, গামছা, রুমালসহ বিভিন্ন তাঁতসামগ্রীর দোকান। চা-নাশতা ও ডাবের দোকানও আছে। অধিকাংশ দোকানি রাখাইন নারী। কিছু দোকানি পুরুষ।
অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে আসার পর মন্দিরের গেট। এ গেটের বাম পাশ দিয়ে আরেকটি সিঁড়ি উঠে গেছে পাহাড়ের দিকে। আমরা মন্দিরে প্রবেশ না করে সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ে উঠি। পাহাড়ে ওঠার এ সিঁড়ির বাম পাশেও অনেক দোকান। এসব দোকানেও সাজানো রাখাইনদের তাঁতপণ্য ও অধিকাংশ দোকানি রাখাইন নারী।
উঁচু সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে মায়ের একটু কষ্ট হয়েছে। তবে ওঠার পর ভালোও লেগেছে। পাহাড়টির নাম মৈনাক। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আদিনাথ মন্দিরের উচ্চতা ২৮৮ ফুট। সে হিসাবে এ পাহাড় চূড়ার উচ্চতা আরও বেশি। গাছগাছালিতে ছায়া এ পাহাড়ের এ চূড়ায় আছে একটি বৌদ্ধ মন্দির। গোলাকৃতির এ মন্দির নিচ থেকে ওপরের দিকে সরু হয়ে উঠে গেছে, অনেকটা উল্টো পিরামিডের মতো। এছাড়া চার কোণায় চারটি সিংহের মূর্তি দাঁড়িয়ে। এখানে থাকতে থাকতেই আমাদের সঙ্গে যোগ দেন কবি বন্ধু সাইয়্যিদ মঞ্জু। তিনি মহেশখালীর স্থানীয় লোক। এ কবির একাধিক কবিতা পড়ার সুযোগ হয়েছে। তার কবিতায় সমুদ্রের নানা রূপ-বৈচিত্র্য দেখেছি। কবিসহ কিছুক্ষণ ঘুরে নেমে আসি আদিনাথ মন্দিরে।
প্রাচীন এ মন্দিরের সম্মুখে স্থাপিত পটভূমি থেকে জানি, ঐতিহাসিকরা মনে করেন মন্দিরের বর্তমান অবকাঠামো ষোড়শ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত। অন্যদিকে সনাতন ধর্মীদের বিভিন্ন গ্রন্থে কয়েক হাজার বছর আগে ত্রেতাযুগে এ মন্দিদের গোড়াপত্তন বলে উল্লেখ আছে। এছাড়া এ মন্দির প্রতিষ্ঠার নানা ইতিহাস রয়েছে। তবে উল্লেখযোগ্য তথ্য হলো, মহশেখালীতে স্বয়ং অষ্টভূজা রূপে দুর্গাদেবীর অধিষ্ঠান বলে এখানে দুর্গা প্রতিমা বানিয়ে দুর্গা উৎসব পালন করা হয় না, তার বদলে পূজা হয় ঘটে। এছাড়া এ মন্দির প্রাঙ্গণে বর্তমানে ভৈরব মন্দির, রাধা-গোবিন্দ মন্দির ও শনি মন্দির প্রতিষ্ঠিত আছে।
মন্দিরের মাঝ বরাবর একটি পারিজাত ফুলগাছ। পুণ্যার্থীরা এ গাছে মানত করে সুতা বা পলিথিন বেঁধে রেখেছেন। এছাড়া মন্দিরের পেছনে জোড়া পুকুর। এর একটি পুকুরে পুণ্যার্থীরা স্নান করেন রোগমুক্তির আশায়। আর অন্য পুকুরে স্নান করলে রোগ হবে বলে বিশ্বাস করেন পুণ্যার্থীরা।
মন্দির প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে পাখির চোখে দেখি সাগর ও সাগর পাড়ের ম্যানগ্রোভ বন। কিছুক্ষণ থেকে আমরা এসে বসি মন্দিরের সম্মুখের একটি ডাবের দোকানে। সাইয়্যিদ মঞ্জু ডাব খাওয়ার আমন্ত্রণ করেন। অবশ্য কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন এলে তৃপ্তি মিটিয়ে ডাব খাই। এখানকার ডাবের স্বাদই আলাদা।
ডাব খেয়ে অটোরিকশায় আসি গোরখঘাটা পৌর শহরের বড় রাখাইনপাড়া বৌদ্ধ মন্দির। স্থানীয়দের কাছে এটি স্বর্ণমন্দির নামেও পরিচিত। এ মন্দিরটিও বেশ প্রাচীন। এর ভেতর একাধিক বৌদ্ধ মন্দির আছে। এখানে একাধিক বুদ্ধমূর্তি আছে। এছাড়া মন্দির প্রাঙ্গণে একটি পুকুর আছে। পুকুরটির মাঝে সাপের ফণার তলে বুদ্ধমূর্তি আছে।
মন্দিরের সম্মুখে রাখাইন নারীদের তাঁতে বোনা শাল, কাপড়সহ নানা পণ্যের দোকান। সাইয়্যিদ মঞ্জু মাকে একটা শাল উপহার দিয়েছেন। শালটি এখানকার রাখাইন নারীদের তাঁতে বোনা। এরপর আসি এখানকার মিষ্টিমুখ হোটেলে। মন্দিরের পাশেই এ হোটেল। দুপুরের খাবার খাই এখানে। সামুদ্রিক মাছ ও সবজি দিয়ে। এরপর চা।
সাইয়্যিদ মঞ্জুকে বিদায় দিয়ে আমরা উঠি অটোরিকশায়। আসার সময় আদিনাথ জেটি দিয়ে এলেও যাচ্ছি মহশেখালী জেটি দিয়ে। এ জেটিও আদিনাথ জেটির সমান। জেটিতে দেখি একজন পান বিক্রি করছেন। পানের ওপর কালারফুল সব মসলা ছিটানো। দেখতেই দারুণ লাগছে। আসলে মহেশখালীর পানের সুনাম রয়েছে দেশ-বিদেশ। তাই মহেশখালী যারা ঘুরতে আসেন, তাদের অনেকে এ পানের স্বাদ নেন। স্পিডবোটে আসতে আসতে মা জানান, সাইয়্যিদ মঞ্জুর আতিথিয়তা ও উপহারে তিনি ভীষণ খুশি।