প্রকাশ : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০
কৃষক যেভাবে মাটিতে লাঙল চষেন, তেমনিভাবে নদীর পানিতে ঠোঁট চষে এ পাখি। বলা যায় এরা খাবার সংগ্রহ করে নদীর পানি কেটে কেটে। তাই এদের নাম দেশি-গাঙচষা। এটি আমাদের জলচর পরিযায়ী পাখি। আর বাংলাদেশে এ পাখির একমাত্র আবাসভূমি দমারচর।
বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে মেঘনা নদীর মোহনায় জেগে ওঠা এ চরের অবস্থান নোয়াখালীর হাতিয়ার নিঝুমদ্বীপের পুবে জাহাজমারা-মোক্তারিয়া চ্যানেলের পাশে। চরের কিছু অংশ ম্যানগ্রোভ বন। বাকিটা কাদাবালু। শুধু গাঙচষা নয়, নানা প্রজাতির জলচর সৈকত পাখিও এ চরের বাসিন্দা। আর এ বাসিন্দাদের দেখতে বেশ কয়েকবছর ধরে প্রতি শীত মৌসুমেই এ চরে হাজির হই। মূলত এ চরে আসি এখানে বিচরণ করা জলচর পাখিদের শুমারি বা গণনা করতে পাখিবিশারদ ইনাম আল হকের নেতৃত্বে।
শীত মৌসুমের বাইরে শরতের শেষে আরও একবার হাজির হই এ চরে। এবারের সফরসঙ্গী পাখি গবেষক দল। তারা এ চরে উপকূলীয় জলচর পাখি সংরক্ষণ নিয়ে গবেষণার কাজ করেন।
এক বিকেলে সদরঘাট থেকে লঞ্চে উঠি দমার চরের উদ্দেশে। সন্ধ্যায় লঞ্চের ছাদে খানিক আড্ডা দিই। তারপর রাতের খাবার। খুব ভোরের দিকে আসি নোয়াখালীর হাতিয়ার তমরুদ্দিন ঘাট। ঘাটে এসে চা-নাস্তার বিরতি শেষে রিকশায় আসি বেকের বাজার। সেখান থেকে চান্দের গাড়িতে (জিপকে স্থানীয় ভাষায় চান্দের গাড়ি বলে) শরীফের দোকান। তারপর পায়ে হেটে নতুন সুখচর গ্রামের কালামচর স্লুইচগেট বাজার। বাজারের পাশেই তাজুল ইসলামের বাসা। দুপুরে খাবার পর ট্রলারে উঠি দমার চরের উদ্দেশে। পথে বনের গাছে দেখি একজোড়া ধলাপেট সিন্ধু ঈগল। ত্রিশ মিনিটের মাথায় নামি দমারচর। অনেক প্রজাতির পাখি দেখি। এর মধ্যে ছিল কালামাথা কাস্তেচরা, ইউরেশিও গুলিন্দা, নদীয়া পানচিল, কয়েক প্রজাতির বক ও বাটান। টেলিস্কোপ ও দূরবীন দিয়ে পাখি গণনা করে তা খাতায় লিখি। সন্ধ্যার আগে ফিরি বাসায়।
সন্ধ্যার পর কালামচর স্লুইচগেট বাজারে আসি চা খেতে। মূলত এ স্লুইচগেট মাছধরার নৌকার ঘাট। আর ঘাটেই মাছের আড়ৎ। এ ঘাট ও আড়ৎ ঘিরেই বাজার। এ ঘাট থেকেই জেলেরা নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে যান সাগরে। তারা ঘাটেই থাকেন, জাল বুনেন, জাল মেরামত করেন।
বাজারে দোকানের সংখ্যা ২৫ থেকে ৩০টি। এসব দোকান মাছ ধরার রমঞ্জাম, মুদি ও চায়ের। ওষুধ বিক্রির দোকানও আছে দুই-একটি। বাজার জমে সন্ধ্যার পর। বাজারের ক্রেতা অধিকাংশ জেলে। সারাদিন কাজ শেষে সন্ধ্যার পর তারা বাজারে আসেন প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে। একটু গল্পগুজব করতে। কথা হলো স্থানীয় কয়েকজন মানুষের সঙ্গে, তারা জানালো এখানকার মানুষের স্বাস্থ্যসেবার নানা সমস্যার কথা। সত্যিই এখানকার মানুষের জীবনযাপন খুবই সাদামাটা ও সংগ্রামী।
পরের দিন খুব সকালে চরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিই; কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় বৃষ্টি। আর সকালে পাখিও দেখা যায় বেশি। অনেকক্ষণ হলেও বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ দেখি না। বাধ্য হয়ে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই উঠি ট্রলারে। চরে নেমে বৃষ্টির মধ্যে ভিজেভিজে পাখি দেখি। বৃষ্টি যখন থামলো তখন প্রায় দুপুর। দেশি-গাঙচষাসহ আজ দেখি নদীয়া পানচিল, ইউরেশিও গুলিন্দা, কালালেজ জৌরালি, পাতি সবুজপা, কালামাথা কাস্তেচরা, পাকড়া উল্টোঠুঁটি, ছোট পানকৌড়ি, দেশি কানিবক, গো-বগা, ছোট-বগা, মাঝলা-বগা, বড়-বগা, ধুপনি-বক, খয়রা চকাচকি, পাতি চকাচকি, কেন্টিশ-জিরিয়া, ছোট-ধুলজিরিয়া, বড়-ধুলজিরিয়া, নাটা গুলিন্দা, পাতি-লালপা, বিল বাটান, টেরেক বাটান, লাল নুড়িবাটান, ছোট-চাপাখি, টেমিংকের চাপাখি, গুলিন্দা বাটানসহ ইত্যাদি।
পাখিবিদদের মতে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার কাদাচরে ৯২ প্রজাতির জলচর সৈকত পাখি বিচরণ করে। এর মধ্যে ১৩ প্রজাতির পাখি বিশ্বব্যাপী বিপদাপন্ন। আর এ ১৩ প্রজাতির সবগুলোই এ দমার চরে দেখা যায়। সেজন্য পাখিবিদদের কাছে এ চর অনেক গুরুত্বের। শুধু তাই নয়, ৪০ থেকে ৫০ প্রজাতির পাখি একসঙ্গে এ চরে দেখা যায় বলেও এ চর অনেক গুরুত্বের।
এ চরের সবুজ ঘাস মনে হয় অন্য ঘাসের চেয়ে একটু বেশি-ই সবুজ। যেন বিছানো সবুজ গালিচা। দেখলেই বসে যেতে উচ্ছে করে। তবে আমরা না বসলেও সবুজ এ গালিচায় বসে আছে ঝাঁকে-ঝাঁকে নানা প্রজাতির পাখি। আর চরের যেখানে কাদাবালু সেখানেও বসে আছে অসংখ্য পাখি। অবশ্য সব পাখিই যে বসে আছে তা কিন্তু নয়। আমাদের চারপাশেই ঝাঁকে-ঝাঁকে পাখির ওড়াউড়ি চলছে। মনে হলো পাখিগুলো তাদের ওড়াউড়ির নানা কৌশল দেখাচ্ছে আমাদের।
ওড়াউড়ির ভিড়ে দেখি একদল গাঙচষা তাদের চিরেচেনা ভঙ্গিতে নদীর পানি কেটে কেটে খাবার সংগ্রহ করছে। এদের পিঠ অনেকটা কালচে বাদামি ও নিচের দিক জ্বলজ্বলে সাদা রঙের। আর ঠোঁট অনেকটাই কমলা-হলুদ রঙের। আর এদের নিচের ঠোঁটটি একেবারে ছুরির মতো এবং নিচের ঠোঁটটি উপরের ঠোঁটের চেয়ে অনেকটা বড়। সত্যিই একে আজব ঠোঁটের পাখি বললে ভুল হবে না। অবশ্য অনেকেই একে আজব ঠোঁটের পাখি বলে থাকেন। পাখিবিদদের মতে এদের মূল প্রজনন কেন্দ্র ভারতের উত্তর প্রদেশ-মুম্বাই অঞ্চল। পৃথিবীতে তিন প্রজাতির গাঙচষা রয়েছে। এর মধ্যে আমাদের দেশে দেখা যায় এক প্রজাতি। বাকি দুইটি দেখা যায় আমেরিকা ও আফ্রিকায়।
মজার তথ্য হলো, আমরা যেমন সকাল, দুপুর ও রাতে খাবার খাই। এরাও তেমনি খাবার সংগ্রহ করে বেশির ভাগ সময়-ভোরবেলা ও সন্ধ্যার আগে আগে। আবার এদের অনেকে পূর্ণিমা রাতেও খাবার সংগ্রহ করে। এরা যখন নদীর পানিতে খাবার সংগ্রহ করে, তখন ক্যাপ, ক্যাপ শব্দে এরা সুর করে ডাকে। ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসে এরা পানচিল নামক আরেকটা পাখির দলের সঙ্গে মিলে বড় নদীর বালুতীরে বালি খোদল করে দিম পাড়ে। ডিমগুলো কিছুটা পাটল ও বাদামি রঙের।
গবেষণার অংশ হিসেবে কয়েক বছর আগে এ পাখির পিঠে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটারও স্থাপন করেছেন পাখি শুমারির সদস্যরা। ২৫১ এবং ২৩০ গ্রাম ওজনের দুইটি গাঙচষার পিঠে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার স্থাপন করা হয়। স্থাপনার কাজটি করেছেন বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কয়েকজন পাখি বিশেষজ্ঞ। পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে সারাবিশ্বে এ পাখির সংখ্যা ৫ হাজারের বেশি হবে না। এর মধ্যে প্রতি বছর শীত মৌসুমে একে এ চরে দেখা যায় ১ হাজারের বেশি। আর একসঙ্গে এ পাখি এত বেশি আর কোথাও দেখাও যায় না। তবে পাখির এ চরে ইদানীং দু-চার ঘর মানুষের বসতিও গড়ে উঠছে, যা এ চরের পাখিদের বেঁচে থাকার জন্য ক্ষতিকর।