প্রকাশ : ০৬ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
রিমা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। ওর বাবা একজন ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীদের লাভ-ক্ষতি সমুদ্রের স্রোতের মতো। সেদিন ঘরে ঢুকেই বাবা ইলিয়াস মেয়েকে ডাকে, একটা চেক দেখিয়ে বলে, দেখো মা আমি একটা ব্যবসায় এই চেকটা লাভ করেছি।
বাবার মন খুব ভালো। রিমা কি এমন একটা দিনের অপেক্ষা করছিল তা আমার, আপনার বা রিমার মায়ের এমনকি ইলিয়াস সাহেবেরও জানা নেই। বাবার মন ভালো দেখেই মেয়ে আবদার করে, বাবা আমাকে একটা ট্যাব কিনে দাও, আমার কত দিনের শখ।
ইলিয়াস সাহেব মেয়ের আবদার ফেলতে পারেননি। ট্যাব কিনে দেবেন বলে কথা দেন। এ বিষয়ে রিমার মা কিছুই জানেন না। মাত্র তিন-চার দিন পরই বাবা-মেয়ে শপিংয়ে যায়, ঘরে ফেরে ট্যাব নিয়ে। রিমার মা আনিসা মেয়ের হাতে ট্যাব দেখে অবাক হন। ধীরে ধীরে রিমা ট্যাবে আসক্ত হয়ে পড়ে। হওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ এই বয়সটাই যে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানার, দেখার, শেখার। আনিসা ইলিয়াসকে বলে, মেয়েকে এটা কিনে দিলে অথচ আমায় বললে না। মেয়ে এখন সারাক্ষণ ওটা নিয়েই পড়ে থাকে।
ইলিয়াস সাহেব কথাটা কানে নেয়নি। বরং জবাব দিয়েছেন একটু কড়া মেজাজে আমার মেয়েকে আমি দিয়েছি, তোমার সমস্যা কী?
রিমা কোচিংয়ে যায়, প্রাইভেটে যায়। যাওয়ার সময় ট্যাব সঙ্গে করে নিয়ে যায়। অন্য বান্ধবীরাও মোবাইল ট্যাব নিয়ে আসে। একজন অন্যজনের থেকে কত কী শেয়ার করে নিয়ে আসে আর বাসায় এসে রাতে চুপে চুপে সেগুলো দেখে। মা আনিসার চোখে পড়ে এসব। ইলিয়াসকে বললে, সে বিশ্বাস করে না। উল্টো আনিসাকে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দেয়। আনিসা এখন পড়ল বিপদে। সে বুঝছে মেয়ে অন্য পথে চলে যাচ্ছে। প্রথমে মেয়েকে বোঝাতে চেষ্টা করে, তাতে কাজ না হলে নিজেই রাতে মেয়ের সঙ্গে ঘুমানো শুরু করে। মায়ের সঙ্গে নিজের রুম শেয়ার করতে রাজি না রিমা। আনিসা মেয়ের রুমে ঘুমালে মেয়ে গিয়ে ড্রয়িংরুমে সোফায় ঘুমায়। এ নিয়েও শুরু হয় সমস্যা। আনিসা ট্যাব দেখতে চাইলে রিমা ট্যাবে পাসওয়ার্ড দিয়ে রাখে। মেয়ের পাশে ঘুমাতে গিয়ে কৌশলে পাসওয়ার্ডটা জেনে নেয় মা। ইলিয়াস বিশ্বাস করেনি বলে বাধ্য হয়ে ট্যাবে কী আছে, মেয়ে কী দেখে, তা ইলিয়াসকে দেখায়। এরপর ইলিয়াস বিশ্বাস করে। কিন্তু তত দিনে রিমা অনেকটাই আসক্ত হয়ে পড়ে। বাবা-মা কারোই নিষেধ শোনে না। কিছু বললে তর্ক করে জেদ দেখায়। রিমা এখন নিজের ইচ্ছামতোই চলে।
আনিসা অনেক আক্ষেপ করেই বলে, ইলিয়াসের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আগে থেকেই ভালো না। এ জন্য মেয়ের কোনো ব্যাপারে আমার মতামত সে নিতে চাইত না। সম্পর্ক এখন আরো খারাপের দিকে। কিন্তু আমি কী করব। মেয়ের পাশে আমি ঘুমাই, এটা স্বামী চায় না। সে এটাও বোঝে না সন্তানের ভালোর জন্যই আমি সন্তানের পাশে থাকতে চেয়েছি।
২.
লিয়াকত আর অদিতির সম্পর্ক তেমন ভালো না। লিয়াকত পরকীয়ায় জড়িত বলে প্রায় দুজনের কথা- কাটাকাটি হয়। ঘরে এলে তেমন কথা বলে না। ঘুমানো ছাড়া বাসায় তেমন থাকেও না। যখন-তখন অদিতির দোষ ধরে বেড়ায়। ওদের ঘরে এক মেয়ে দুই ছেলে। ছেলেরা ছোট হলেও মেয়ে সব বোঝে, কারণ ও বড়।
লিয়াকত আগে সাধারণ মোবাইল ব্যবহার করত, অদিতিও। লিয়াকত একটা লেটেস্ট মোবাইল কেনে। এখন আগের মোবাইলটা বাড়তি। ওদের মেয়ে অলি পড়ে মাত্র ষষ্ঠ শ্রেণিতে। এক দিন লিয়াকত বলে, আমার আগের মোবাইলটা অলিকে দিয়ে দেব। প্রত্তুতরে অদিতি বলে, এই ছোট মেয়েকে মোবাইল দেওয়ার দরকার নেই। বরং মোবাইলটা ঘরেই থাকুক। যখন আমি বাসার বাইরে যাব ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারব।
Ñতার দরকার নেই। আমি এটা ওকেই দেব। অনেক বলে কয়ে মেয়েকে বুঝিয়ে অদিতি মোবাইলটা মেয়েকে না দিয়ে ঘরেই রাখে। মেয়ের যখন কথা বলার দরকার হয় মায়ের বা বাবার মোবাইল দিয়েই কথা বলে। অদিতি মেয়েকে আগেই বলেছে তোমায় এখন মোবাইল দেব না। এখন তো আমিই তোমার সঙ্গে চলি, স্কুল যাই, প্রাইভেটে যাই, যখন দরকার আমারটা ব্যবহার করবে। এইচএসসি পাস করার পর তোমায় ভালো একটা সেট দেব। মেয়ে তেমন কিছুই বলেনি। বরং খুশি হয়েছে। সেভাবেই মেয়েকে বড় করে। মেয়ে নিজেই বলে, ছোটবেলায় মোবাইল দিলে ওর ক্ষতিই হতো।
৩.
দিপা এবার সমাপনী পরীক্ষা দিয়েছে। ফলাফল ভালো করেছে। ওর বেস্ট ফ্রেন্ড ইভাও ভালো ফলাফল করে। ইভার বাবা ওকে ৩৫ হাজার টাকা দামের ট্যাব কিনে দেয়। সে অনেক খুশি। খবর আসে দিপার কানে। ছোটবেলায় অন্যদের হাতে ট্যাব দেখে নিজে চাইত। ওর মা সালমা বলত, আমরা এমন পরিবারের নয় যে খেলার জন্য এত টাকা দিয়ে ট্যাব কিনে খেলব। এখন সমাপনী পাস করার পর দিপা চায় ওকেও এমন একটা ট্যাব কিনে দেওয়া হোক। বোনের আবদার বুঝে বড় বোন রিয়াও চায় ওকে ট্যাব কিনে দিতে। এতে বাবাও রাজি আছে। কিন্তু ওর মা সালমা রাজি নয়। বড় বোন রিয়া চেয়েছে দিপাকে একটা সাইকেল কিনে দিতে। এতে মা রাজি থাকলেও বাবা রাজি নেই। কথার ছলে বোঝা যায়, ট্যাব কিনে দিতে রাজি আছে রিয়ার বাবা।
দুপক্ষের বোঝাপড়া না হওয়ায় অনেক দিন ট্যাব কেনা হয়নি। মায়ের সঙ্গে মাঝে মাঝেই দিপা বলত। মা বুঝিয়ে বুঝিয়ে রাখত। এক দিন দিপা বুঝতে পারে বাবার পকেটে টাকা আছে, বাবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে রাজি করে ফেলে। বাবা বলে দিয়েছে দিপাকে ট্যাব কিনে দেবে। সালমা তেমন বাধা দিতে পারেনি। কিন্তু মেয়েকে বলেছে, এটা আমার কাছেই থাকবে। অল্প সময়ের জন্য পাবে। তবে সামনের পরীক্ষা খারাপ হলে ভাবব এটার জন্যই খারাপ হয়েছে। তা হলে আর পাবে না।
মেয়ে কথাটা মেনে নেয়। সেভাবেই দিপাকে ট্যাব কিনে দেওয়া হয়। পরের বার পরীক্ষায় সত্যি ও ভালো করে না। এজন্য সালমা ট্যাবটা সরিয়ে রাখে। নিজে সময় করে মাঝে মাঝে ১০-১৫ মিনিটের জন্য দিত। দ্বিতীয় পরীক্ষায় দিপা ভালো করে। সালমা মেয়েকে এগুলো বুঝিয়ে বলে। এই সময়টা এমনি যত দেখবে, দেখতেই চাইবে, জানতে চাইবে। কিন্তু নিজের ক্ষতি করে নয়। একপর্যায়ে দিপা বুঝতে পারল ট্যাব কেনা ঠিক হয়নি।
আমাদের সমাজের অনেক পরিবারের বাবারা সন্তানের কিছু ক্ষেত্রে অতি উৎসাহী হয়ে থাকেন। এমনিতেই সন্তানদের শাসন বেশি করেন মায়েরা, কারণ ওদের ভালোমন্দ মায়েরাই বেশি দেখেন। সেখানে বাবারা একটু উৎসাহী হলে, দেখালে সন্তানরা মায়ের চেয়ে বাবার পক্ষ নেয়। আর যেসব পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সম্পর্ক টানাপড়নের হয়, সে পরিবারের পরিবেশ অন্যরকম হয়। সন্তানরা কিছু সুযোগের অপেক্ষায় থাকে, তখন রোজগার করা বাবা নিজের মতামতকে চাপিয়ে দেয়; যা সন্তানের জন্য ক্ষতিকর।
সন্তান ভুল করতে পারে, কিন্তু সন্তানের ভালোমন্দটা বাবা-মা দুজনকেই একসঙ্গে ভাবতে হবে। পরামর্শ দিতে হবে, নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, বাবা-মায়ের সম্পর্কের জাঁতাকলে যেন সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যৎ হারিয়ে না যায়। আমরা কি পারি না সন্তানের কথা ভেবে আমাদের রেশারেশি প্রতিযোগিতাগুলো দূরে রাখতে। সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়তে বাবা-মা দুজনেরই প্রয়োজন, ওর ভবিষ্যৎ ভালোমন্দটাও দুজনকেই ভাবতে হবে, বুঝতে হবে।