রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৫ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০

প্রজন্মের বুকে জ্বলুক দেশপ্রেমের চেতনা
আরাফাত শাহীন

একটি দেশের সামগ্রিক উন্নতি এবং অগ্রগতির জন্যে সে দেশের তরুণ সমাজকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হয়। বর্তমান বিশ্ব অতি দ্রুততার সঙ্গে প্রযুক্তি এবং কারিগরি দক্ষতায় সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর এ অগ্রগতির পেছনে এক বিপুলসংখ্যক তরুণ তাদের নিষ্ঠা ও শ্রম জ্বালানি হিসেবে সরবরাহ করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ বিশ্বের একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লাখ শহীদ ও প্রায় তিন লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের এ স্বাধীনতা। কিন্তু শুধু স্বাধীনতা পেয়েই একটা জাতি খুশিতে আত্মহারা হয়ে থাকতে পারে না।

বিশ্বের বুকে নিজেদের মর্যাদার আসনে দেখতে চাইলে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও স্বনির্ভরতা প্রয়োজন। আর আমরা এখন ধীরে ধীরে হলেও সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সরকার বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক তরুণ তাদের মেধা ও শ্রম বিনিয়োগ করে চলেছেন।

আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের একটি ছোট্ট দেশ (৯৪তম) হলেও জনসংখ্যায় আমরা অন্যতম বৃহত্তম (৮ম) দেশ। এই ক্ষুদ্র দেশে রয়েছে বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠী। সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় দেশে যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন শিক্ষিতের হার বেড়েছে। কিন্তু এ শিক্ষা আবার এক দিক দিয়ে বড় বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ, দেশে বেকারত্বের হার অতীতের সব রেকর্ডকে অতিক্রম করে গেছে। এ বেকারদের একটা বড় অংশ ¯œাতক ও ¯œাতকোত্তর পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন।

যে সময়ে আমাদের তরুণ প্রজন্ম দেশপ্রেমের ব্রত নিয়ে দেশের মানুষের কল্যাণের চিন্তা করবেন, ঠিক সেই সময়েই তারা তাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময় ব্যয় করে চলেছেন চাকরি নামক সোনার হরিণের পেছনে ছুটে। দিন দিন এভাবেই জাতি হিসেবে আমরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছি।

বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি দেশের উচ্চশিক্ষার জন্য সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বলে মনে করা হয়। উচ্চশিক্ষা মানে শুধু কিছু বুলি মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় সেগুলো উগরে দেয়া নয় বরং এখানে চিন্তা-গবেষণার পাশাপাশি নীতি-নৈতিকতা এবং দেশপ্রেমের শিক্ষা দেয়ারও কথা। কিন্তু আমরা বড় হতাশার সঙ্গে দেখতে পাই, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের দেশপ্রেমের ছবক দিতে পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে।

একটা সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে সম্মান প্রদর্শন করতাম। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে সব ধরনের আন্দোলন-সংগ্রামে একটা সময় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের তরুণরা সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু সেই বাস্তবতা এখন আর আমরা প্রত্যক্ষ করি না।

আমাদের ভেতরকার নীতি-নৈতিকতা এবং দেশপ্রেম দিন দিন শূন্যের কোঠায় নেমে আসছে। তাই যদি না হতো তাহলে দেশের সর্বনাশ করে আমরা দুর্নীতির মহা¯্রােতে গা ভাসিয়ে দিতে পারতাম না; যে মহান মানুষগণ আমাদের মানুষ হওয়ার শিক্ষা দান করেন তারা অন্যের গবেষণা নিজের নামে চালিয়ে দিয়ে বড় বড় ডিগ্রি অর্জনের পেছনে দিন-রাত ছুটে বেড়াতেন না।

যে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাগ্রহণ করে আমাদের দেশ ও জাতির কল্যাণে আত্মনিয়োগ করার কথা সেখানে আজ প্রকৃতপক্ষে কোনো শিক্ষাই প্রদান করা হচ্ছে না। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই আজ চরম বাস্তবতা। শিক্ষার মতো পবিত্র খাতও আজ দুর্নীতির করালগ্রাসে এক অন্ধকার গিরিখাতে পড়ে একটু অক্সিজেনের আশায় ছটফট করে মরছে। একবার প্লেটো তার গুরু সক্রেটিসকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘গুরু, দেশপ্রেম কী?’-জবাবে তিনি মৃদু হেসে বলেছিলেন, ‘নিজের কাজটা সবচেয়ে সুন্দরভাবে করাই হলো দেশপ্রেম’। এখন বিবেচনা করে দেখুন, আমরা কিন্তু মুখে সবসময় দেশপ্রেমের কথা বলে থাকি; কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ কতটুকু? আমরা আসলে কেউই নিজের কাজটা ভালোভাবে করি না বা করতে চাই না। একজন শিক্ষার্থীর প্রকৃত কাজ হলো, জ্ঞান অর্জন করে নিজেকে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিয়োজিত করা। কিন্তু আমরা যারা শিক্ষার্থী, তারা জ্ঞান অর্জনের জন্যে মোটেও উদগ্রীব নই।

শিক্ষক ডায়াসে দাঁড়িয়ে লেকচার দেন। আর আমরা ক্লাসের পেছনে বসে ইন্টারনেটে ব্রাউজ করি অথবা ঘুমাই। বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু মুক্তজ্ঞান চর্চার জায়গা এবং এখানে যারা পড়াশোনা করতে আসেন তারা সবাই কমবেশি বুঝমান; তাই শিক্ষকও দেখে না দেখার ভান করেন। ফলে একজন শিক্ষার্থী অন্ধকারে হারিয়ে যান অতি সহজেই। কিন্তু তিনি তা বুঝতেও পারেন না।

একটি দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হলে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবেও সক্ষমতা অর্জন করা জরুরি। আর এজন্যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন সুনাগরিকের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। দেশকে যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে বিপুলসংখ্যক তারুণ্যদীপ্ত এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবান মানুষের প্রয়োজন।

এদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর মতো একজন মহান ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হয়েছিলো বলেই আমরা পাকিস্তানের নাগপাশ ছিন্ন করে স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিতে সক্ষম হয়েছি। একটা সময় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমন অনেক সোনার সন্তানের জন্ম দিয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তখন ছাত্র সংসদ নির্বাচন চালু ছিলো। নির্বাচিত নেতৃবৃন্দ সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের জন্যে সবসময় সোচ্চার থেকেছেন। শুধু তাই নয়, দেশের যে কোনো ক্রান্তিল¯েœ তারা সবার আগে এগিয়ে এসেছেন। ফলে দেশে যোগ্য নেতার জন্ম হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নেই।

আমাদের দেশের বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনায় তরুণ প্রজন্মের উচিত ছিলো দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করা। কিন্তু এই সময়টাতে এসেই তারা সবচেয়ে বেশি হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছেন। একদিকে দেশে যেমন রয়েছে সীমাহীন বেকারত্ব, তেমনি অন্যদিকে আমাদের প্রচলিত শিক্ষা কাঠামো শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছে না।

ফলে আমরা যখন দেখি, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটা জায়গায় এসেও একজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নিচ্ছেন তখন আমরা হতাশ না হয়ে পারি না। একজন তরুণ জীবনযুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াই করার পরিবর্তে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যেতে পারেন না। এটা তো তারুণ্যের শিক্ষা হতে পারে না।

বিগত বছরগুলোতে দেশে মাদকের একটা রমরমা কারবার চলছে। আমার কেনো যেনো মনে হয়, এই মাদকের সবচেয়ে নির্মম শিকার হলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে হাঁটতে গিয়ে প্রায়ই ফেনসিডিলের বোতল চোখে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পবিত্র অঙ্গনে মাদকের সব উপকরণই উপস্থিত। শিক্ষকের সামনে বেহায়ার মতো সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে সুখ পায় আমাদের তরুণ প্রজন্ম। এটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্যে চরম লজ্জার। আমরা নামতে নামতে আজ সব ক্ষেত্রেই একেবারে খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছি।

আজকে আমাদের তরুণ প্রজন্মের সামনে নানামুখী প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও আমি বিশ্বাস করি, দেশ গঠনের কাজে এখনো তারাই সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম। চাকরির বাজারের এই প্রতিকূলতার সময়ে কিছু তরুণ উদ্যোক্তা হয়ে অন্য তরুণদের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে দেখেছি, কোথাও কারও রক্তের প্রয়োজন হলে নিজের পরিবারের সদস্য মনে করে ছুটে যান তরুণরা। দেশের যে কোনো প্রান্তে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানলে সবার আগে ছুটে যান আমাদের তরুণ শিক্ষার্থীরা।

আমি নিজেও বন্যার্তদের জন্যে অর্থ সংগ্রহ করেছি, কয়েকবার হতদরিদ্র এলাকায় গিয়েছি শিশুদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করতে। যে তরুণরা নিজেদের অর্থ, শ্রম ও সময় ব্যয় করে পরের উপকারে ছুটে যাচ্ছেন তারা কখনো দেশবিরোধী কোনো কাজে যুক্ত হতে পারেন না বলে আমার বিশ্বাস। আর এটাই তো প্রকৃত দেশপ্রেম।

সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে হলে তরুণদের মেধা এবং শ্রমকে অবশ্যই মূল্যায়ন করতে হবে। আজকে তরুণরা জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশজুড়ে রয়েছেন। একটি দেশের তরুণেরা যদি কোনো কারণে হতাশায় নিমজ্জিত হন, তাহলে সেই দেশটাও পিছিয়ে পড়তে বাধ্য। আমাদের তরুণদের একটা বড় অংশই নানামুখী অবসাদে ভারাক্রান্ত। তাদের জাগিয়ে তুলতে হবে। তরুণদের ভেতর দেশপ্রেমের আগুন জে¦লে দিতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, এই তরুণদের একবার তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজে লাগিয়ে দিতে পারলে আর পেছনে ফিরে তাকানো লাগবে না; আমার প্রিয় স্বদেশ অবশ্যই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়