প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
১২ ডিসেম্বর ২০২১ থেকে বাংলাদেশ ফাইভ-জি নেটওয়ার্কের আওতায় এলো। বিজয়ের মাস, স্বাধীনতার ৫০ বছর ও মুজিব শতবর্ষে বাংলাদেশের জন্যে এটি একটি বিরাট অর্জন। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর ৬-৭টি দেশ এ প্রযুক্তির আওতায় এসেছে। মোবাইল ফোনের পঞ্চম জেনারেশন ইন্টারনেটকে সংক্ষেপে ডাকা হয় ফাইভ-জি। বর্তমানে চলমান ফোর-জি এলটিই (‘লং টার্ম এভুলুশন’) নেটওয়ার্কের আডগ্রেড ভার্সনকে ফাইভ-জি বলে। এলটিই বলতে মোবাইল ফোন এবং ডেটা টার্মিনালগুলোর উচ্চগতির তথ্য আদান-প্রদানে বেতার যোগাযোগকে বোঝায়। এ প্রযুক্তিতে ল্যাটেন্সি কম হওয়ায় বাড়বে নেটওয়ার্ক রেসপন্স। ল্যাটেন্সি বলতে কোনো সাইট অ্যাকসেস করা এবং তার রেসপন্স করার মধ্যবর্তী সময়কালকে বোঝায়। ফোর-জির চেয়ে ফাইভ-জি নেটওয়ার্কে ১০ গুণ বেশি দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুবিধা পাওয়া যাবে এবং সর্বোচ্চ ১০ হাজার এমবিপিএস গতিতে ডাউনলোড করা যাবে। গতির এই হিসাব প্রথম শুরু হয় ১-জি দিয়ে ১৯৭৯ সালে অ্যানালগ পদ্ধতির মাধ্যমে-যেখানে দুটি ডিভাইসের মধ্যে শুধু কল করা যেতো। এরপর আসে ২-জি (১৯৯১ সালে)। এখানে দুটি মোবাইল ডিভাইসের মধ্যে কল করার পাশাপাশি টেক্সট মেসেজ পাঠানো সম্ভব হতো। তারপর আসে ৩-জি (১৯৯৮ সালে)। তা টেক্সট মেসেজ, কল, ইন্টারনেট ইত্যাদির সঙ্গে ব্রাউজ করার সুবিধা ছিলো। ৩-জির সব সুবিধাসহ ৪জি আসে ২০১০ সালে। এতে সহজেই একসঙ্গে অনেকগুলো ডিভাইস কানেক্ট করা এবং যে কোনো বড় সাইজের ফাইল শেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়। পরে ৪-জিকে আরও দ্রুত করার জন্যে এলটিই প্রযুক্তি সংযুক্ত করা হয় এবং ল্যাপটপ, স্মার্টফোন বা অন্যান্য মোবাইলযন্ত্রে মোবাইল ব্রডব্যান্ড, মোবাইল আল্ট্রাব্রডব্যান্ড, ইন্টারনেটসেবা অন্তভুক্ত হয়। ৪-জি নেটওয়ার্কে আরও যেসব সুবিধা বিদ্যমান, সেগুলোর মধ্যে সংশোধিত মোবাইল ওয়েবসেবা, আইপি টেলিফোনি, গেমিং, এইচডিটিভি, হাইডেফিনিশন মোবাইল টিভি, ভিডিও কনফারেন্স, ত্রিমাত্রিক টেলিভিশন এবং ক্লাউড কম্পিউটিং উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে ২০১৮ সালের জুনে মোবাইল ফোনে ৪-জি (এলটিই) সেবা শুরু হয়। ৫-জি প্রযুক্তিতে অনেকগুলো ডিভাইসকে একত্রে কানেক্ট (ইন্টারনেট অব থিংসের মতো) করে রাখার জন্যে বিশেষ প্রযুক্তিসহ এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছেÑযেখানে বেশি ব্যান্ডউইথ কন্ট্রোল করার ক্ষমতা রাখে। আর মূলত এ বিষয়ের ওপর লক্ষ্য করেই ফাইভ-জি প্রযুক্তির যাত্রা শুরু।
৩-জি বা ৪-জির মতো ৫-জি প্রযুক্তি শুধু সেলফোন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়; বরং ওয়াইফাইয়ের মতো যে কোনো ডিভাইসেও থাকতে পারবে, ভার্চুয়ালি সবাইকে কানেক্টেড করতে সক্ষম হবে এবং মেশিন, অবজেক্ট ও ডিভাইসগুলোকে একই সূত্রে গাঁথবে। এমনকি পারসোনাল কম্পিউটারেও একটি চিপ লাগানো যাবে। ফলে তথ্য আদান-প্রদান, ভিডিও কল, কল কনফারেন্স ও ইন্টারনেটভিত্তিক সেবায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। ভার্চুয়াল রিয়ালিটি, হাইরেজ্যুলেশন ভিডিও দেখা, চালকবিহীন গাড়ি, প্লেন চালানোর ট্রেনিং থেকে শুরু করে নানা গবেষণাকর্ম, অগ্নিনির্বাপণ, উদ্ধার কাজের ড্রোন ব্যবহার করা সম্ভব হবে। গুগোল ম্যাপ ব্যবহারেও অনেক বেশি ভূমিকা রাখবে। লোকেশন ট্র্যাকিংয়ের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সময় ব্যয় হবে না, মিলি সেকেন্ডের মধ্যে ফল দেবে। এমনকি উচ্চক্ষমতার এই মোবাইল ইন্টারনেটের মাধ্যমে রোবট, সেন্সর বা অন্যান্য প্রযুক্তি পণ্যেও ব্যবহৃত হবে। এর প্রভাব দেখা যাবে সর্বক্ষেত্রে, আমাদের জীবনে, কর্মক্ষেত্রে, এমনকি খেলাধুলাতেও। ৫-জি সহজলভ্যতার কারণে প্রচলিত অনলাইনভিত্তিক সব কার্যক্রম আরও দক্ষ ও গতিশীল হবে। ফলে কাস্টমার সার্ভিস হয়ে উঠবে আরও সন্তোষজনক। এক কথায় বলা যায়, গোটা সমাজটাকেই পরিবর্তন করে দেবে। এতো সুবিধা নিয়ে প্রথম যে দেশে ৫-জি টেকনোলজি চালু করা হয়েছিলো, তা হলো দক্ষিণ কোরিয়া ২০১৯ সালে।
৫-জি হাইব্যান্ডউইথ হ্যান্ডেল করার ক্ষমতা থাকার কারণে অদূর ভবিষ্যতে এ প্রযুক্তি শুধু মোবাইল ইন্টারনেট নয়, বরং হোম ইন্টারনেটেও নিজের জায়গা দখল করে নেবে। গ্রামীণ, পাহাড়ি ও বিচ্ছিন্ন এলাকায় এখনো হাইস্পিড ইন্টারনেট পৌঁছায়নি। কারণ ইন্টারনেট কোম্পানিগুলো লোকসানের আশঙ্কায় কোটি কোটি টাকা খরচ করে ব্রডব্যান্ড ক্যাবল বা ফাইবার অপটিক ক্যাবল স্থাপন করেনি সেখানে। ৫-জি প্রযুক্তি চলে আসার পর ওইসব এলাকার লোকরাও গিগাবিট/সেকেন্ড ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুবিধা পাবে এবং ইন্টারনেট অপারেটরদেরও আর মাটির নিচ দিয়ে কিংবা ওপর দিয়ে কেবল টানানোর প্রয়োজনীয়তা থাকবে না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এতে থাকবে মাত্র এক মিলি সেকেন্ডের লেটেন্সি এবং এটি ৯০ শতাংশ কম এনার্জি ব্যয় করে কাজ করবে। ডেটা ট্রান্সমিশনে সাধারণত ৩.৫ থেকে ২৬ গিগাহার্জের মতো হাইয়ার ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডের অনেক ক্ষমতা থাকে। কিন্তু স্বল্পতরঙ্গ দৈর্ঘ্যরে কারণে তাদের আওতা কম থাকে। ফলে সামনে কোনো বাধা পেয়ে আটকে যায়। ৫-জির প্রযুক্তিতে এ সমস্যা একেবারেই থাকবে না। কারণ এটি এমন একটি নতুন রেডিও প্রযুক্তিÑযা রেডিও তরঙ্গের ব্যবহার আরও নিশ্চিত করবে এবং একই সময় একই স্থানে বেশি মোবাইল ফোন ইন্টারনেটের সুবিধা নিতে পারবে। ফলে শিক্ষা ক্ষেত্রে, বিশেষ করে অনলাইন এডুকেশনে এক যুগান্তকারী বিপ্লব নিয়ে আসবে। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেও ব্যাপক রদবদল ঘটাবে। মেডিকেল ডিভাইসের সঙ্গে ৫-জি সিম ব্যবহার করে ডাক্তার দূরের কোনো রোগীকে শহরে বসেই জরুরি চিকিৎসা দিতে পারবেন। এমনকি রোবটিক সিস্টেমের সাহায্যে রিমোট সার্জারিও করতে পারবে। বডি ফিটনেস ডিভাইস নিজের শরীরের সঙ্গে ব্যবহার করে বডি থেকে সিগন্যাল পাঠাতে মিলি সেকেন্ড সময় লাগবে। গাড়ির লোকেশন, স্পিড, ডেস্টিনেশনসহ ট্রাফিকের সব ইনফরমেশন হাতের মুঠোয় চলে আসবে। ফলে ড্রাইভিং, গাড়ি দুর্ঘটনা কমাতে সহায়ক হবে। গেমিং এক্সপেরিয়েন্সকে আরও সুখময় করে তুলবে। বিশেষ করে অনলাইন গেমগুলোকে সবার কাছে অবাধ করে তুলবে। ফলে মোবাইল গেমিং ইন্ডাস্ট্রির প্রচুর বিস্তার ঘটবে।
প্রাথমিকভাবে রাজধানী ঢাকার ২০০টি জায়গায় পরীক্ষামূলকভাবে এ ইন্টারনেট পরিষেবা চালু হবে। ঢাকার গণভবন, বঙ্গভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয়, সরকারি গুরুত্বপূর্ণ অফিস, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ থানাসহ কিছু বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকাকে এ পরিষেবার আওতায় আনা হবে। সর্বত্র ফাইভ-জি চালু হলে দূরে থেকেও ঘরের লাইট, ফ্যান, এসি ও কৃষি ক্ষেত্রে পানির পাম্প চালু বা বন্ধ, পুকুরের মৎস্যচাষ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে (ইন্টারনেট অব থিংসের মতো)। ৫-জি নেটওয়ার্ক সেবা চালু হলে টিভি চ্যানেলগুলো দেখার জন্যে ডিশের প্রয়োজন হবে না। কম্পিউটারে থাকা ৫-জি চিপ থেকে ডেটা ট্র্যান্সমিট করে ফোন, ট্যাবলেট, টিভিতে ডেটা সিংক করা সম্ভব হবে। আবার একটি গেমিং কনসোল দিয়ে একসঙ্গে একাধিক টিভি চালানো যাবে অনায়াসেই। ঘরের ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ইত্যাদি প্রযুক্তির আওতায় থাকবে। ফলে জনপ্রিয় হবে স্মার্ট হোম, স্মার্ট সিটি, সেলফ ড্রাইভিং কার, হেল্থ মনিটরিং ডিভাইস আর অগমেন্টেড রিয়ালিটির মতো ডিভাইসগুলো। চোখের পলক পরার আগেই কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে। অর্থাৎ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বিকাশ ঘটবে ফাইভ-জির কল্যাণে অনায়াসেই। তবে এসব সুবিধা পেতে হলে বিদ্যমান টাওয়ারগুলো ফাইভ-জিতে রূপান্তর করতে হবে এবং গ্রাহকদের লাগবে সেই উপযোগী হ্যান্ডসেট। আর দ্রুতগতির বিষয়টি নির্ভর করবে কোন স্পেকট্রাম ব্যান্ডে ফাইভ-জি ব্যবহার করা হবে এবং মোবাইল কোম্পানিগুলো ট্রান্সমিটারের পেছনে কতটা বিনিয়োগ করবে। কর্তৃপক্ষকেও উদ্যোগ নিতে হবে ফাইভ-জি টেকনোলজির উপযোগী সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার প্রটোকল নির্ধারণ করা।
ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার : অধ্যাপক,
আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।