প্রকাশ : ১৩ জুন ২০২২, ০০:০০
দেহ এক জালকের মতো। অসংখ্য রক্তবাহী শিরা ও ধমনী জালকের মতো জড়িয়ে আছে এ দেহতে। এই রক্তবাহিকাগুলো হলো তনু-তটিনীর মতো। নদী যেমন তার প্রবাহপথে বাধা পেলে অনর্থ হয় তেমনি তনু-তটিনী সদৃশ এ রক্তবাহিকাগুলো তার স্বাভাবিক প্রবাহে প্রতিরোধ পেলে শরীরের জন্যে বয়ে আনে বেদনা, বয়ে আনে অঘটন-অগণন।
ভেরিকোজ ভেইন কী
যে রক্তবাহী শিরা রক্ত চলাচলের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার কারণে স্ফীত হয়, কুণ্ডলী পাকিয়ে যায়, আঁকাণ্ডবাঁকা হয়ে প্যাঁচানো নুডলসের মতো হয়ে যায় তাকে বলে ভেরিকোজ ভেইন। এসব অস্বাভাবিকভাবে রূপান্তরিত শিরার মধ্যে সর্বদা রক্ত সঞ্চিত থাকে। ফলে হাঁটায়, দাঁড়ানোতে কিংবা বসতে গেলে মৃদু হতে অসহনীয় মাত্রায় ব্যথা ও বেদনা অনুভূত হতে থাকে।
কাদের ভেরিকোজ ভেইন হয়
ভেরিকোজ ভেইন যে কারও হতে পারে। তবে পুরুষের চেয়ে নারীদের বেশি হয়। সাধারণত পঞ্চাশ বছরের অধিক বয়সীদের বেশি হয়। যারা অধিক সময় ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় যেমন : ট্রাফিক পুলিশ, ক্রিকেটের আম্পায়ার, যারা একটানা অধিক সময় ধরে বসে থাকতে হয়, তাদের ভেরিকোজ ভেইন হতে পারে। গর্ভবতী মায়েরা যারা পেটে বাচ্চা ও গর্ভস্থ অ্যামনিওটিক ফ্লুইড বহন করে তারা ভেরিকোজ ভেইনে আক্রান্ত হতে পারে। যাদের কনস্টিপেশন বা কোষ্ঠকাঠিন্য আছে, যারা মাত্রাতিরিক্ত স্থূলকায় তারাও ভেরিকোজ ভেইনে আক্রান্ত হয়। যারা অ্যালকোহলসেবী, যারা ধূমপায়ী ভেরিকোজ ভেইনে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তাদেরও আছে।
কোনো ধরনের ভেইন ভেরিকোজ ভেইন হয়
সাধারণত নিম্নাঙ্গের ভেইনগুলোতে ভেরিকোজ ভেইনের দশা সৃষ্টি হয়। যে সব ভেইন ত্বকের মাত্র নীচে থাকে, পায়ের কাফ মাসলে অবস্থিত শেফানাজ ভেইন ও হাঁটুর পেছনের খোলে বিদ্যমান পপলিটিয়াল ভেইনে ভেরিকোজ ভেইন বেশি হয়। কোনো কোনো চিকিৎসাবিজ্ঞানী ওভারিয়ান ভেইনকে ভেরিকোজ ভেইনের একটি বড় স্থল বলে মনে করেন।
ভেরিকোজ ভেইন চেনার উপায় কী
এই ভেইনগুলোতে রক্তপ্রবাহ দেখা যায়। কালচে নীল ধরনের চেহারা হয়। ভেইনের বহির্গাত্র শক্ত হয়। ভেইনের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে চুলকায়, ক্ষত তৈরি হয়। ভেইনগুলো দলা পাকানো দড়ির অবয়ব পায়। মনে হয় ল্যাসোর ফাঁস কিংবা শিরার সোপান।
ভেরিকোজ ভেইনে আক্রান্তের পরিণাম
দীর্ঘক্ষণ দাঁড়ালে ব্যথা বোধ হয়। অনেকক্ষণ বসার পর উঠে দাঁড়ালেও ব্যথা লাগে। রাত্রে ঘুমুতে গেলে পা কামড়ায়, শিন শিন করে। মৃদু ব্যথা একসময় তীব্র ও অসহনীয় হয়ে উঠে। কখনো কখনো হাঁটায় বিঘœ ঘটে। ভেরিকোজ ভেইনের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আলসার হয়, মাঝারি রক্তপাত ঘটে এবং ক্ষত কখনো শুকায় না, দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যায়।
ভেরিকোজ ভেইনের রোগনিরূপণী পরীক্ষণ
চোখে দেখে ভেরিকোজ ভেইন বুঝা গেলেও সবচেয়ে ভালো হয় নিম্নাঙ্গের রক্তনালীগুলোর কালার ডপলার আল্ট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে রক্তপ্রবাহের সঠিক ধারণা ও চিত্র খুঁজে নেয়া।
ভেরিকোজ ভেইনের চিকিৎসা
ঔষধ প্রয়োগে ভেরিকোজ ভেইনের চিকিৎসায় সাফল্য তেমন পাওয়া যায় না। যদিও অ্যাস্পিরিন, ডায়াস্মিন ও হেসপেরিডিন-সমন্বিত ঔষধে হাল্কা উপকার পাওয়া যায়। স্কেলেরো থেরাপি হলো ভেরিকোজ ভেইনের হাত হতে পরিত্রাণ পাওয়ার একটা গ্রহণযোগ্য উপায়। এছাড়াও আর একটি কার্যকর চিকিৎসা হলো শৈল্য চিকিৎসার মাধ্যমে লুপগুলোর অপসারণ। ইদানীংকালে লেজার পদ্ধতিতে সীমিত শৈল্যে ভেরিকোজ ভেইন অপসারণ করা হয়।
ভেরিকোজ ভেইন হয় কেনো
দেহের যে সকল স্থানে চাপ পড়ে, বিশেষত পায়ের নিম্নাংশের ভেইনে ভেরিকোজ ভেইন হয়। ভেইন বা শিরাগুলোতে ভাল্ব বা কপাটিকা নামে দ্বি-পত্রিকাবিশিষ্ট একমুখী দরজা আছে যাদের কাজ হলো রক্তকে কেবল নিম্নাংশ হতে হৃদপি-ের দিকে ধাবিত করা। এ কাজটি করতে পায়ের থোড়ের মাংশপেশি মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এজন্যে একে পেরিফেরাল হার্ট বা মফস্বলের হৃদপি- বলে। কোনো কারণে এই ভাল্ব যদি দুর্বল হয়ে যায় তাহলে হৃদপি-মুখি রক্ত নীচের দিকে পশ্চাদপ্রবাহে নিম্নাংশের শিরায় গিয়ে ভিড় করে এবং দীর্ঘসময় ধরে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে ভেরিকোজ ভেইনের সৃষ্টি হয়।
ভেরিকোজ ভেইন হতে দূরে থাকার উপায়
তন্তুজাতীয় খাদ্য উপাদান প্রতিদিনের আহারে বৃদ্ধি করতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম করলে রক্তনালীর স্বাস্থ্য ঠিক থাকে। পা দুটো ছড়িয়ে বসতে হবে। অতি টাইট মোজা পরিধান করতে হবে। দীর্ঘক্ষণ একটানা দাঁড়ানো বা বসার অভ্যাস এড়িয়ে পর্যায়ক্রমে বসা ও দাঁড়ানোর অভ্যাস করা জরুরি।