বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া, স্ত্রীর আত্মহত্যা
  •   ভারতকে কড়া বার্তা শ্রম উপদেষ্টার
  •   আধুনিক নৌ টার্মিনাল প্রকল্প পরিদর্শনে চাঁদপুরে নৌপরিবহণ উপদেষ্টা
  •   ডাকাতিয়া নদী ও সিআইপি অভ্যন্তরস্থ খাল খননসহ ৫ দফা দাবিতে সংগ্রাম কমিটির সংবাদ সম্মেলন

প্রকাশ : ০৭ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

মোবাইল আসক্তিতে শিশুদের সর্বনাশ

তথ্য প্রযুক্তি কণ্ঠ ডেস্ক ॥
মোবাইল আসক্তিতে শিশুদের সর্বনাশ

ভিডিও প্ল্যাটফরম ইউটিউবে ১০ বছরের একটি শিশু বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপন দেখে জানতে পারে রাজধানীর একটি বিপণীবিতানে নিত্যনতুন মডেলের মোবাইল ফোন কিনতে পাওয়া যায়। ওই ভিডিও দেখে ট্রাংকে রাখা বাবার জমানো ৫০ হাজার টাকা নিয়ে গোপনে সে শেরপুর থেকে ঢাকায় চলে আসে। নানাজনের কাছে জিজ্ঞেস করে করে শিশুটি শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যায় ওই বিপণীবিতানে। তবে বিপণীবিতানের নিরাপত্তাকর্মীরা শিশুটিকে সন্দেহজনক ঘোরাফেরা করতে দেখে পুলিশের হেফাজতে দেন।

পরে ওই শিশুর চাচাকে থানায় ডেকে শিশুটিকে তার জিম্মায় দিয়ে দেয় পুলিশ।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শিশুটির মোবাইল ফোন আসক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, কীভাবে সে ঢাকায় আসবে, কীভাবে বিপণীবিতানে যাবে, কীভাবে মোবাইল ফোন কিনে আবার বাড়ি ফিরে যাবে--এসবের তোয়াক্কাই করেনি। মাত্র ১০ বছরের একটি শিশু মোবাইল ফোন আসক্তির কারণে গোপনে এভাবে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে শেরপুর থেকে ঢাকায় চলে আসা নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় হয়েছে। মোবাইল ফোনের এই আসক্তি রোধ করা না গেলে, তা একসময় শিশুদের বড় ধরনের সর্বনাশ ডেকে আনবে।

শিশুর মোবাইল ফোন আসক্তি কতটা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, সাম্প্রতিক এক গবেষণায় তার চিত্র ফুটে উঠেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মাদ নাজমুল হকের তত্ত্বাবধানে ওই গবেষণা প্রতিবেদন গত বছর এপ্রিলে আন্তর্জাতিক জার্নাল এলসভিয়ারের জার্নাল অব ইফেক্টিভ ডিস-অর্ডারে প্রকাশিত হয়। ওই গবেষণায় উঠে আসে, বাংলাদেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ প্রি-স্কুল শিশু স্মার্টফোনে আসক্ত। এর মধ্যে ২৯ শতাংশ শিশুর মারাত্মক স্মার্টফোন আসক্তি রয়েছে।

গবেষণায় আরো দেখা যায়, ৯২ শতাংশ শিশু তাদের মা-বাবার স্মার্টফোন ব্যবহার করে আর ৮ শতাংশ শিশুর ব্যবহারের জন্য পৃথক স্মার্টফোন আছে। বাংলাদেশের শিশুরা প্রতিদিন গড়ে প্রায় তিন ঘণ্টা স্মার্টফোন ব্যবহার করে, যা ইউনিসেফ কর্তৃক সুপারিশ করা সর্বোচ্চ সময়ের প্রায় তিন গুণ বেশি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিশু গড়ে প্রতিদিন পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত স্মার্টফোন ব্যবহার করে।

শিশুর স্মার্টফোন আসক্তির কারণ হিসেবে বলা হয়, ৮৫ শতাংশ মা-বাবা তাদের সন্তানদের কম সময় দেন। ৫২ শতাংশ শিশু খেলার মাঠের অভাবে এবং ৪২ শতাংশ শিশু খেলার সঙ্গীর অভাবে স্মার্টফোনে আসক্ত হচ্ছে।

৭৯ শতাংশ প্রি-স্কুল শিশু স্মার্টফোন ব্যবহার করে কার্টুন বা কল্পকাহিনি দেখতে, ৪৯ শতাংশ গেম খেলতে আর ৪৫ শতাংশ ভিডিও দেখা বা গান শোনার জন্যে। মাত্র ১৪ শতাংশ শিশু পড়ালেখার জন্যে ব্যবহার করে স্মার্টফোন।

৭৩ শতাংশ মা বিনা বাধায় কাজ করতে, ৭০ শতাংশ মা তাদের শিশুরা স্মার্টফোন ব্যবহার করতে পছন্দ করে বলে, ৬৭ শতাংশ মা তাদের শিশুসন্তানকে খাওয়াতে এবং ৩১ শতাংশ মা শিশুকে ঘুম পাড়াতে স্মার্টফোন ব্যবহার করেন।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ইসিডি নেটওয়ার্কের চেয়ারপারসন ড. মনজুর আহমদ বলেন, ‘শিশুদের মোবাইল ফোন আসক্তি বেড়েছে, এটা সত্য। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারে এই আসক্তি বেশি বেড়েছে। কারণ তাদের কাছে স্মার্টফোন সহজলভ্য। এসব পরিবারে দেখা যায়, মা-বাবা দুজনই চাকরি করেন। ফলে দুজনই ব্যস্ত। ক্ষতিটা অনুধাবন না করেই তারা শিশুদের হাতে মোবাইল ফোন ছেড়ে দিচ্ছেন। কিন্তু সমস্যাটা অনেক বড়ো। মোবাইল ফোন আসক্তি নিয়ন্ত্রণে মা-বাবাকেই প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে। শিশুদের মোবাইল ফোন ছাড়া অন্য খেলার ব্যবস্থা রাখতে হবে। তাদের সময় দিতে হবে। এছাড়া শিশুরা যাতে ইন্টারনেটের সব জায়গায় বিচরণ করতে না পারে সে ব্যাপারে ফোন কোম্পানি, মোবাইল নেটওয়ার্ক কোম্পানি এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো উদ্যোগ নিতে পারে।’

শেরপুরের ওই শিশুকে বিপণীবিতান থেকে নেওয়া হয়েছিলো রাজধানীর তেজগাঁও থানায়। ওই থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন জানান, শিশুটি ইউটিউবে দেখে জানতে পারে, রাজধানীর ওই বিপণীবিতানে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নিত্যনতুন মোবাইল সেট পাওয়া যায়। তখন সে ওই বিপণীবিতান থেকে মোবাইল ফোন কেনার পরিকল্পনা করে। কাউকে না জানিয়ে সে তার বাসা থেকে বাবার জমানো ৫০ হাজার টাকা নিয়ে নেয়। পরে সে মানুষজনকে জিজ্ঞেস করে শেরপুর থেকে ঢাকার মহাখালী আসে। সেখান থেকে আবার মানুষজনকে জিজ্ঞেস করে করে ওই বিপণীবিতানে পৌঁছে যায়। সেখানে মোবাইল ফোনের দোকানের সামনে ঘোরাঘুরি করতে দেখে নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এ সময় শিশুটির কাছে অনেক টাকা দেখে নিরাপত্তাকর্মীরা হতবাক হয়ে পুলিশকে জানালে পুলিশ শিশুটিকে হেফাজতে নেয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) শিশু নিউরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডাঃ গোপেন কুমার কুণ্ডু বলেন, ‘যেকোনো ডিভাইস বড়দের ক্ষেত্রে যতটা না ক্ষতি করছে, শিশুদের তারচেয়ে বেশি করছে। একটা শিশুর প্রথম তিন বছরে খুবই র‌্যাপিড বিকাশ হয়। এই বিকাশটা নির্ভর করে নিউরনের বৃদ্ধির ওপর। কারণ প্রথম তিন বছরে শিশুর ৫০ শতাংশ এবং পাঁচ বছরে ৯৫ শতাংশ বিকাশ হয়। কিন্তু এ সময়ে যদি শিশুরা মোবাইল ফোন ধরে তাহলে তার যে বিকাশ হওয়ার কথা তা হয় না। তার আচরণেও সমস্যা তৈরি হয়। চোখের সমস্যা, মাথা ব্যথা, ঘাড়ের সমস্যা হয়। পড়ালেখায়ও মন বসে না।’ অভিভাবকদের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘৪৫ মিনিটের বেশি কেউ মোবাইল ফোন দেখলে আমরা বলি, লেজি আই বা ড্রাই আই রোগ হতে পারে। এ জন্যে মোবাইল ফোন দেখতে দিয়ে শিশুদের খাওয়ানো যাবে না। কান্না করলেই মোবাইল ফোন দেওয়া যাবে না। খেলনা দিতে হবে। শিশুসন্তানকে মা-বাবা উভয়ের সময় দিতে হবে। সুযোগ থাকলে বিকেলে খেলার জন্যে মাঠে নিয়ে যেতে হবে। ইনডোর গেমসে বাচ্চাকে সময় দিতে হবে অভিভাবকদের।’

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়