শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২২ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।
  •   রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করলেন না সমাজী।

প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০২৩, ০০:০০

ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নপূরণে রায়হানের অদম্য যাত্রা!
চৌধুরী ইয়াসিন ইকরাম ॥

ব্যাট-বলসহ খেলার যাবতীয় সরঞ্জামাদি বাবা ফেলে দিলেন পানিতে। কোনোভাবেই খেলা যাবে না ক্রিকেট। কিন্তু ততোদিনে ক্রিকেট খেলা ছেলেটার রক্তে মিশে গেছে। যে করেই হোক দেশসেরা ক্রিকেটার তাকে হতেই হবে। স্বপ্নটা আঁকড়ে ধরে ছেড়েছে বাড়ি। হোটেল বয় থেকে ডিসের লাইনম্যান হয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণের পথে হাঁটছে কিশোর রায়হান হোসাইন।

২০০৫ সালে কচুয়া উপজেলার আকানিয়া নাছিরপুর গ্রামের জন্ম তার। এক ভাই তিন বোনের মধ্যে রায়হান দ্বিতীয়। তার বাবার নাম মজিবুর রহমান, মায়ের নাম ভুলু বেগম। তার বাবা এলাকাতে চা বিক্রি করে সংসার পরিচালনা করেন।

ছয়-সাত বছর বয়সেই ক্রিকেট খেলার প্রেমে পড়ে রায়হান। এলাকার বড় ভাইদের খেলতে দেখে তারও ইচ্ছে জাগে খেলার প্রতি। শিশু বয়সেই পেস বোলিং খুব মনে ধরে তার। জেঠাতো ভাই সাব্বির রহমানের কাছে বায়না ধরেন বল করা শিখিয়ে দিতে। ছোট্ট রায়হানের আবদারে ভাই সাব্বির তাকে শিখিয়ে দেয় বল করা। সেই থেকে শুরু।

বাড়ির পাশের দেওয়ানবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাইমারি শিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন আকানিয়া নাছিরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। ততোদিনে টেপ টেনিস ক্রিকেট খেলে এলাকায় বেশ নামডাক ছড়িয়ে পড়ে ডানহাতি এই পেসারের। একটা সময় আশপাশের গ্রাম থেকেও তাকে হায়ার করে ক্রিকেট খেলানো শুরু হয়। আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো না হওয়ায় ক্রিকেট খেলে আয় করা টাকা দিয়েই পড়াশুনার খরচ চালাতো রায়হান।

এর মধ্যে ২০২১ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হয় কচুয়া বঙ্গবন্ধু ডিগ্রি কলেজে। বুঝতে পারলো, টেপ টেনিস বলে ক্রিকেট খেলে খেলোয়াড় হওয়া যাবে না। তখন জমানো টাকা দিয়ে গিয়ারেস (খেলার সরঞ্জাম) ক্রয় করে চাঁদপুর ক্লেমন একাডেমীতে কোচিংয়ে ভর্তি হয়। এলাকায় টেপ টেনিস টুর্নামেন্টে খেলে যে টাকা আয় হতো, তা দিয়েই প্রতিদিন কচুয়া থেকে চাঁদপুর ক্রিকেট একাডেমীতে আসতো। টাকার অভাবে কখনো গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির পথ ধরতো পায়ে হেঁটে। খেলা ছাড়ার জন্য প্রতিনিয়তই তার বাবা বকাঝকা করতো। হঠাৎ করেই একদিন চায়ের দোকানী বাবা মজিবুর রহমান তার গিয়ারেস বাড়ির পাশের পুকুরে ফেলে দেয়। সেই দিন ক্রিকেটার হওয়ার লক্ষ্য পূরণে অন্ধকার নেমে আসে তার। ক্রিকেটার হওয়ার লক্ষ্য পূরণে অটুট থেকে ২০২১ সালের ১২ আগস্ট রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চাঁদপুর চলে আসে রায়হান।

রায়হান জানায়, চাঁদপুর এসে স্টেডিয়ামের পাশে অবস্থিত ক্যাফে ঝিল রেস্টুরেন্ট কাজ নেয় সে। ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত বয়ের কাজ করে বিকেল বেলা একাডেমীতে কোচিং শুরু করে। রাতে রেস্টুরেন্টেই মাথাগোঁজার ঠাঁই হয়। ১মাস ১৭দিন হোটেল বয়ের কাজ করে একাডেমীর শিক্ষক পলাশ কুমার সোমের সহযোগিতায় কাজ পায় জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি রোটারিয়ান মাঈনুদ্দিনের ডিস লাইনে। পাশাপাশি থাকার সুযোগ করে দেন তাদের ভবনে।

রায়হান বলে, জীবনে অনেক ঝড় এসেছে। কিন্তু ক্রিকেট খেলা ছেড়ে দিবো তা কখনো ভাবতেই পারি না। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ওয়াইফাই আর ডিসের লাইনের কাজ শেষ করে একাডেমিতে প্র্যাকটিসে যাই। প্র্যাকটিস শেষে আবার সন্ধ্যা থেকে শুরু করে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করি। মাঈনুদ্দিন ভাই আমাকে কাজের পাশাপাশি তাদের বাসার ৬তলায় থাকার জায়গা দিয়েছেন। সেখানেই নিজের খাবার নিজে রান্না করে খাই আমি। কখনো খাবারের সুযোগ থাকে তো কখনো না খেয়েই কেটে যাচ্ছে দিন।

রায়হান বলে, ২০২১ সালে চাঁদপুর জেলার অনূর্ধ্ব-১৬ দলের প্রাথমিক পর্বের ৩০ জনের দলে ডাক পেয়েছিলাম। কিন্তু ওই সময়ে নিয়মিত চাঁদপুরে এসে অনুশীলন না করতে পারায় আর খেলার সুযোগ হয়নি। আমার সকল মনোযোগ খেলাধুলায়। আমার স্বপ্ন পূরণে একাডেমীর বড় স্যার ক্রিকেট কোচ শামিম ফারুকী অনেক আন্তরিক। তাদের সহযোগিতায় আমি আমার লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে যাচ্ছি। খেলাধুলার পাশাপাশি পড়াশোনায় আমার আগ্রহ রয়েছে অনেক। আমি একদিন বাংলাদেশের হয়ে বিশ্বমঞ্চে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবো--এটাই আমার স্বপ্ন। জাতীয় দলের তাসকিন আহমেদ আমার আইডল। কিন্তু অর্থের অভাবে আমি ঠিকমত অনুশীলন করতে পারছি না। আমার স্বপ্ন পূরণে কোনো সুহৃদ ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা পেলে কৃতজ্ঞ থাকবো।

রায়হানের ব্যাপারে জানতে চাইলে ক্লেমন চাঁদপুর ক্রিকেট একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা ও জেলার ক্রিকেট কোচ শামিম ফারুকী এ প্রতিবেদককে বলেন, আমি একদিন সকালে ক্যাফে ঝিলে নাস্তা করতে যাই। ওই সময় এই ছেলেটিকে দেখি হোটেলে কাজ করছে। নাস্তা খাওয়া অবস্থায়ই তার দিকে আমার চোখ পড়ে। তাকে খুব চেনা চেনা মনে হয়। আমি চিন্তা করতে থাকি যে, এই ছেলেটিকে আমি কোথায় দেখেছি। পরবর্তীতে বিকেল বেলা ছেলেটিকে দেখি একাডেমীর মাঠে অনুশীলন করছে। এরপর থেকে আমি একাডেমীতে তাকে নিয়মিত অনুশীলনের ব্যবস্থা করে দেই। তার অনুশীলনের জন্যে একাডেমীতে কোনো অর্থ দিতে হয় না। খেলোয়াড় হিসেবে ও বেশ পরিশ্রমী এবং মেধাবী। তাকে একাডেমী থেকে বিভিন্ন সময়ে চেষ্টা করি বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করার জন্যে। সে নিজ এলাকা থেকে শহরে ছুটে এসেছে একজন ভালো ক্রিকেটার হওয়ার জন্য। একজন ভালো পৃষ্ঠপোষক পেলে হয়তো ক্রিকেটে অনেক দূর এগিয়ে যাবে ক্রিকেটার রায়হান।

রায়হানের কাজ ও থাকার ব্যবস্থাকারী মাঈনুদ্দিনের সাথে মুঠোফোনে আলাপকালে তিনি বলেন, ছেলেটার ক্রিকেট খেলার প্রতি অনেক আগ্রহ। কাজের সময়টুকু ছাড়া তাকে খেলার অনুশীলনের জন্যে সুযোগ করে দিয়েছি। তাছাড়া তার কোনো আশ্রয় নেই জেনে বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি।

এই প্রতিবেদককে সংগ্রামী এই ক্রিকেটারের খোঁজ দেয়া ক্রীড়া অনুরাগী ও গণমাধ্যমকর্মী তালহা জোবায়ের বলেন, রায়হান অদম্য মানসিকতার একজন মানুষ। নিজের স্বপ্ন পূরণে একাই লড়াই করে যাচ্ছে। আমি চাই তার স্বপ্ন পূরণ করে একদিন সে ক্রিকেট মাঠে দেশের হয়ে কোটি বাঙালির জন্যে লড়াই করুক। এই অদম্যদের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখতে সামর্থ্যবানরা সহযোগিতার হাত প্রশস্ত করুক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়