প্রকাশ : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০
বর্তমান বিশ্বে মারাত্মক প্রাণঘাতী মহামারি হলো নোভেল করোনাভাইরাস অর্থাৎ কোভিড-১৯। এই ভাইরাসটির গঠন ক্রাউন অর্থাৎ মুকুটের মতো হওয়ায় চীনের গবেষকরা এর নাম দিয়েছে কোভিড। আর ২০১৯ সালে এটির সংক্রমণ ছড়িয়েছে বলে কোভিড-১৯ নামকরণ করেছে। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহান শহরে মানুষের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। তবে এর অনেক বছর আগে, ১৯৩০ সালে সর্বপ্রথম এই ভাইরাসটি মুরগির শরীরে সংক্রমণ ঘটায়। পরে ১৯৬০ সালে এসে এটি মানুষের শরীরে সংক্রমণ ঘটায়। আর বর্তমানে এই ভাইরাসটি জ্বর, সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা, শ্বাসকষ্টজনিত লক্ষণ নিয়ে মানুষের শরীরে সংক্রমিত হয়ে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে ধংস করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। গবেষকদের ধারণা, হাতের স্পর্শে, নিঃশ্বাসের মাধ্যমে এবং বাতাসের মাধ্যমে এ ভাইরাসটি একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে প্রবেশ করে। ২০২০ সালের মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে চীন ছাড়িয়ে পৃথিবীর আরো ১৮০টি দেশের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এই ভাইরাসটি।
২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে করোনা রোগী শনাক্ত হয়। খুব তাড়াতাড়ি বাড়তে থাকে করোনা রোগীর সংখ্যা। অচিরেই শহর ছাড়িয়ে গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে এই রোগ। চারদিকে বাড়তে থাকে মৃত্যুর মিছিল। ভয়ে, আতঙ্কে ঘরবন্দি মানুষের জীবন। যেসব প্রতিষ্ঠানে মানুষের সমাগম বেশি সরকার সিদ্ধান্ত নেয় সেসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করার। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয় অনির্দিষ্টকালের জন্যে। এছাড়া ও অফিস-আদালত, কারখানা, গার্মেন্টস্, বিদেশের বিমান চলাচল, বৈদেশিক বাণিজ্য, সিনেমা হল সব বন্ধ হয় সাময়িক সময়ের জন্যে। একদিকে করোনার আতঙ্ক অন্যদিকে যেসব মানুষ এইসব প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে তাদের জীবনে নেমে আসে চরম ভোগান্তি।
করোনাভাইরাস হুজুগে বাঙালির মনে তৈরি করেছে সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার। করোনা সংক্রমণ শুরুর দিকে সারা বিশ্বের করোনার আপডেট বার্তাগুলো প্রতিদিন প্রেসব্রিফিং করেন আইইডিসিআর পরিচালক ডাঃ মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। কিছু কিছু মানুষতো তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, পোশাক নিয়েও সমালোচনা করতে ভুলেনি। অথচ এই মহান ব্যক্তি এর আগে সঙ্কটময় সময়ে সহায়তার হাত বাড়িয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। ধর্মকে কেন্দ্র করে কেউ কেউ বলেছে রাত ১০টার পর সারাদেশে একযোগে আজান দিলে, কোটি বার দুরূদ পাঠ করলে করোনা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। অনেকে তো স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছে, ফজরের নামাজের আগে থানকুনি পাতার রস, আদা, রসুনের রস খেলে করোনা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। অথচ বড় আলেমগণ বলেছেন, যে কোনো বিপদ ও মহামারি থেকে পরিত্রাণ পেতে আজান দেয়া, দুরূদ পড়া ও বেশি বেশি ইবাদত করতে বলা হয়েছে কোরআন, হাদিসে। তবে তা কোনো নির্দিষ্ট সময়ে একযোগে বা নির্দিষ্ট সংখ্যায় পড়তে বলা হয়নি। কোরআনে কালিজিরা ও মধু খাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো গবেষক, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক করোনার চিকিৎসা আবিষ্কার করতে পারেনি। হাতের সংস্পর্শে, স্বাস গ্রহণের মাধ্যমে, বাতাসের মাধ্যমে এই জীবাণু মানবদেহে প্রবেশ করে বলে গবেষকরা বলেছেন সাবান-পানি দিয়ে কিছুক্ষণ পর পর ভালো করে হাত ধোয়া, নাকে-মুখে মাস্ক ব্যবহার করা, মানুষের সংস্পর্শ থেকে দুরত্ব বজায় রাখা, শাক-সবজি ও ফলমূল খাওয়া, বেশি বেশি করে পানি পান করা, পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম, ব্যায়াম ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার মাধ্যমে এ ভাইরাসটি মানুষের শরীরে প্রবেশ করা থেকে আটকানো যেতে পারে। তবে মানুষের দেহে করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়েছে কি না তা শনাক্তের জন্যে করোনা কীট আবিষ্কার করেছে বিজ্ঞানীরা। কীটের মাধ্যমে পিসিআর পরীক্ষা পদ্ধতিতে ২-১৪ দিন পর করোনার সম্ভাব্য রোগীর নাক ও গলা থেকে তরল শ্লেষ্মা নিয়ে করোনা পজিটিভ বা নেগেটিভ প্রমাণ করা হয়। করোনাভাইরাস ফুসফুসের নিউমোনিয়াজনিত রোগ হওয়ায় অনেক সময়ই পরিমাণমত শ্লেষ্মা সংগ্রহের অভাবে এবং গবেষণাগারে পরীক্ষিত ত্রুটির কারণে এই পরীক্ষার ফলাফল সঠিক নাও হতে পারে। করোনাভাইরাস যাতে মানুষের শরীরে এন্টিবডি তৈরি করতে পারে এবং এই ভাইরাসটির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে সেজন্যে বিভিন্ন দেশে গবেষণা করে আবিষ্কার হয়েছে করোনার টিকা। বর্তমানে এই টিকা পৌঁছে গেছে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে।
সচেতন নাগরিকরা শুরুতেই এই টিকা নিয়েছে। আর যারা বলেছে বাঁচলে এমনিতেই বাঁচবো, টিকার দরকার নেই, তারাও আজ বেঁচে থাকার জন্যে হুমড়ি খাচ্ছে করোনা টিকার কেন্দ্রগুলোতে। অনেকে টিকা নেয়ার ছবি তুলে ছাড়ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যেনো এটাও করোনা থেকে মুক্তি পাওয়ার একটা উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু অভিভাবক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের পক্ষে থাকলেও অনেক অভিভাবক এর পক্ষে না। কারণ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তাদের সন্তানরা। তারা মোবাইল ফোনের বিভিন্ন গেমস্-এর প্রতি নেশাগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নিতে চাইলেও আবার করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে বলে বন্ধের ঘোষণা দেন।
দেশের হাসপাতালে বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন। প্রতিটি হাসপাতালে আলাদা করে করোনা ওয়ার্ড স্থাপন হয়েছে। পর্যাপ্ত পরিমাণ অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারপরও হাসপাতালে জায়গা হচ্ছে না করোনা রোগীর। সেজন্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অস্থায়ী ভিত্তিতে করোনা রোগীর সেবার জন্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্তমানে এই ভাইরাসটি এমনভাবে মানুষের জীবনে আঘাত হানছে যার ফলে এক হাসপাতালে জায়গা না পেয়ে অন্য হাসপাতালে যাওয়ার পথেই রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। এরই মাঝে কোনো কোনো হাসপাতালের কিছু অসাধু কর্মকর্তা মোটা অংকের টাকা না দিলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করায়নি, এমনকি অক্সিজেন পর্যন্ত দেয়নি। যার ফলে অসহায় গরিব মানুষ হাসপাতালের পথে পথে ঘুরে মৃত্যুর মিছিলে যোগ দেয়। আজ মানুষ আপন আত্মীয়ের বাড়িতে যেতে ও ভয় পায়, যদি সেখানে কারো করোনা থাকে? করোনা থেকে আপনজকে বাঁচাতে প্রিয় মানুষটি নিজের মুখ দিয়ে একটুখানি শ্বাস দিতে দেখেছে মানুষ। লকডাউনের কারণে গাড়ি না পেয়ে কাঁধে করে করোনা আক্রান্ত সন্তানকে বহন করছে বাবা। আবার পাষ- কিছু মানুষ করোনা সন্দেহে ঘর থেকে বাইরে রেখে গেছে পরিবারের প্রিয় কোনো সদস্যকে। এসবই ভয়ানক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। যেগুলো গভীরভাবে দাগ কাটে মানুষের হৃদয়ে। এই মহামারিতে সবচেয়ে কঠিন হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখেছে পৃথিবীর মানুষ। যেখানে করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশ আগুনে পোড়ানো হয়েছে, গণকবর দেয়া হয়েছে, ভাইরাস ছড়াতে পারে বলে কাফন, জানাজা ছাড়াই দূর থেকে গর্তে নিক্ষেপ করে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে।
প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে মুক্তি পেতে ধাপে ধাপে লকডাউন দিচ্ছে সরকার। যার ফলে পণ্যদ্রব্যের মূল্য অনেক বেড়ে গেছে। জনজীবনে নেমে এসেছে বিপর্যয়। কর্মচ্যুত মানুষের জীবনে নেমেছে চরম ভোগান্তি। অনেকে দুবেলা খেতেও পায়নি। এমতাবস্থায় সরকার তাদের জন্যে দান, অনুদানের ব্যবস্থা করছে। তবে সরকারের দানের কতটুকু পেয়েছে অসহায় মানুষ? পেট ভরেছে কিছু অসৎ নেতা-কর্মীর। ওই যে কথায় বলে না, ‘বেশি ভরলে বস্তা ফাটে’। তাদেরও হয়ছে সেই অবস্থা। লোকে দেখেছে তাদের সুন্দর মুখোশের আড়ালের কুৎসিত চেহারা।
জনমানুষের জীবনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সরকার কখনো লকডাউন তুলে নিচ্ছে। খুলে দিচ্ছে অফিস, গার্মেন্টস্, বাজার ও যানবাহন। আবার শুরু হয় মানুষের অবাধ চলা। মানুষ নিজের সাথে করে ভাইরাস নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। কোনো কোনো এলাকাভিত্তিক জেলা প্রশাসন লকডাউন দিচ্ছে। মানুষের মাঝে পৌঁছে দিচ্ছে বিনামূল্যে মাস্ক, হাত ধোয়ার সাবান, স্যানিটাইজার ও খাদ্যসামগ্রী। কোনো কোনো জায়গাতে পুলিশ করোনা মহামারিতে সহায়তা করেছে সাধারণ মানুষের।
এই মহামারিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে মানবিক কিছু চিকিৎসক ও নার্স। করোনার কাছে নিজেদের জীবন বাজি রেখে সংসার সন্তানের মায়া ত্যাগ করে দিনরাত সেবা করছে রোগীদের। কখনো দেখা গেছে ২৪ ঘণ্টার পরও তাঁরা মুখের মাস্ক খুলতে পারেনি। গায়ের পোষাক পাল্টাতে পারেনি। কিছু খেতেও পারেনি। নাকে-মুখে দাগ লেগে গেছে মাস্কের। করোনা রোগীর সেবা করতে করতে কত চিকিৎসক করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে।
সরকারি সহায়তা ছাড়াও অনেক বেসরকারি সংস্থা, ব্যক্তি উদ্যোগী সংস্থা, এমনকি ব্যক্তিগত উদ্যোগেও এই মহামারিতে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। করোনা আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালে পৌঁছে দেয়া, ঘরে ঘরে বিনামূল্যে অক্সিজেন সরবরাহ করা, মানসিক সাহস দিয়ে ও অনেক ছাত্র সংগঠন সহায়তা করছে রোগীদের। যেখানে করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশ নিতে অস্বীকার করেছে আপনজনরা সেখানে একদল স্বেচ্ছাসেবক দল মৃত্যু-ভয়কে উপেক্ষা করে করোনার বিরুদ্ধে সমস্ত সুরক্ষার সাথে তুলে নিচ্ছে মৃতের কাফন, জানাজা এবং দাফনের কাজ। কারণ গবেষকরা বলছে, মৃত ব্যক্তির শরীর থেকে ভাইরাস ছড়াতে পারে না। যেহেতু শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ায়, মৃত ব্যক্তির শ্বাস বন্ধ থাকে বলেই এটি ছড়াতে পারে না। তবে মৃত ব্যক্তিকে না ছুয়ে সমস্ত রকমের স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাদের জানাজা, কাফন ও দাফন করা যায়। এমনকি মাটি চাপা দেয়ার পর ভাইরাস সংক্রমণ ঘটাতে পারে না। কাজটি করার পর শরীরের সব ভাইরাস প্রতিরোধী পোষাক আগুনে পুড়িয়ে সাবান দিয়ে ভালো করে গোসল করলে শরীরে জীবাণু ঢুকতে পারে না। এছাড়া কোনো ব্যক্তির শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকলে করোনার জীবাণু তাদের শরীরে প্রবেশ করলেও তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারে না।
বেশি বেশি প্রার্থনা করা, নিজে সচেতন থাকা, অন্যকে সচেতন করা, মানসিক শক্তি ও সাহস রাখা, আক্রান্ত রোগীর সাহস ও সহায়তার মাধ্যমে এই প্রাণঘাতী ভাইরাস থেকে সুরক্ষিত থাকা যায়। পুরানো সেই বাণী সকলের মনে পুনরোজ্জীত হোক-‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’।
* পাঠক ফোরাম বিভাগে লেখা পাঠানোর ঠিকানা