রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০

করোনাকালের দিনলিপি
অনলাইন ডেস্ক

ঘণ্টা বেজে উঠলো। কেউ কেউ মাঠে দৌড়াদৌড়ি করছে, কেউ বা স্কুলগেটের বাইরে বসে আড্ডা দিচ্ছে। ঘণ্টার আওয়াজ শোনার সাথে সাথে সবাই সবার নিজস্ব কর্মাবস্থান ছেড়ে, যে যার মতো নিজ নিজ ক্লাসে চলে এলো। একটু পরেই ক্লাসে স্যার আসবেন। তার আসার জন্যে অপেক্ষায় কেউ কেউ বসে আছে। কেউ কেউ আবার বাড়ির কাজ না করতে পারায়, ক্লাসের অন্যান্য ভালো ছাত্র-ছাত্রীদের খাতা দেখে সম্পন্ন করছে। কেউ কেউ আছে, যাদের মনে হয়! ক্লাসে পড়া দেয়া কিংবা স্যারের দেয়া বাড়ির কাজ সম্পন্ন করার চেয়ে স্যারের হাতে মার খাওয়া ঢের সহজ।

সেজন্যে তারা লেখালেখি কিংবা অপেক্ষা এ দুটোর কিছুই না করে একজন আরেক জনের পাশ ফিরে কথা বলছে, আবার এর জন্যে তারা আশপাশে কাউকে না পেলে সামনের জনকে গুঁতো দিয়ে নানা ধরনের অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা চালিয়ে দেয়।

একটু পরই রোজকার মতো ক্লাসে ঢুকলেন দেলোয়ার স্যার। ঢুকেই সবাইকে প্রথমে চুপ করতে বললেন। তারপর যখন সবাই চুপ হলো তখন তিনি কথা বলা শুরু করলেন।

প্রথমেই অবাক করা শব্দ উচ্চারণ করলেন, ‘করোনা ভাইরাস’। শব্দটা শোনার সাথে সাথে কিছুটা আজব লাগলো। এট আবার কেমন শব্দ! কেমন ভাইরাস!

দেখলাম স্যারের কথার সঙ্গে ক্লাসের দু-একজন শিক্ষার্থীও তাল মিলাচ্ছে। তাদের দাবি এ সম্পর্কে স্যারের সাথে সাথে তারও অবগত এবং মোটামুটি জানে।

অথচ তখন পর্যন্ত আমার কাছে এর পরিচতি ছিলো প্রথমবারের মতো। বুঝলাম জাগতিক খবরা-খবর সম্পর্কে আমার ধ্যানধারণা তাদের তুলনায় অনেকটাই কম। আর যেহেতু তারা এ বিষয়ে সমকালীন সময়েই জেনে গেছে। তার মানে, তারা এ বিষয়ে আমার থেকে এগিয়ে। ভাবলাম আমার এ অবস্থান বদলাতে হবে। আমাকেও সকল ধরনের নতুন খবরা-খবর রাখতে হবে, জানতে হবে, শুনতে হবে।

এদিকে স্যার তার বক্তব্য একনাগাড়ে দিয়ে চলছেন। সুতরাং সে বিষয়েই মনোনিবেশ করলাম। একপর্যায়ে স্যারের ভয়াবহতা জানালেন। আরো জানালেন এতে আক্রান্ত ব্যক্তির পরিণাম কতটা ভয়াবহ এবং দুর্বিষহ। এছাড়াও আরো অন্যান্য।

তবে সেদিন দেলোয়ার স্যার যতোটা গুরুত্ব দিয়ে করোনাভাইরাসের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আমরাও ঠিক ততোটা সস্তায়-ই বিষয়টা হজম করে ফেলি। ভুলে যাই আত্মমগ্নে। স্যার যখন বললেন, চীনের উহান প্রদেশে এর উৎপত্তি তখন ভাবলাম যে, সেখানকার ভাইরাস এখানে আসবে কি করে? আসার কোনো প্রশ্নই আসে না। সুতরাং এ নিয়ে এতো ভাবার কিছু নেই।

বাড়িতে নিজেদের স্থায়ী পুকুর থাকলেও, গোসলের জন্যে প্রায়ই দিঘিতে গোসল করতাম। সেখানে কেবলই গোসল নয়, একই সাথে বয়সে বড় ভাই, কাকা, দাদা, এবং আরো অন্যান্য মুরব্বীদের সাথে সময়টা সকলেই একতালে আড্ডা দিয়ে কাটাতাম। আর এজন্যে অবশ্য গোসল করতে যাওয়ার আলাদা একটা ইচ্ছে জাগতো। যেতামও...।

মার্চের প্রথম সপ্তাহ। প্রতিদিনের মতো সেদিনও গোসল করতে গেলাম। অন্যান্য দিন যারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে হাসি-রহস্য করতো আজ তাদেরকে বেশ চিন্তিত দেখা গেলো। কিন্তু কি কারণে এমনটা হলো সেটা অবশ্য তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারিনি।

একটু পরে শোনা গেলো দেশে নাকি করোনাভাইরাসের আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে এবং তিনি বিদেশফেরৎ লোক। তাই তার মধ্যে আরো অনেকে লোকের কাছে ভাইরাসটা ছড়িয়ে গেছে বলে সবাই মনে করছেন এবং এ নিয়েই তারা এতো চিন্তিত।

এ চিন্তাধারা নিয়ে তারা এ বিষয়ের ভালো-খারাপ দিক নিয়ে আলোচনা শুরু করলো। একপর্যায়ে কথার অবসান হলো। গোসল করে উঠতে উঠতে সবাই সবাইকে সতর্ক থাকতে বললো। একই সাথে আমাকেও সাবধানে থাকতে বলা হলো। এ নিয়ে তাদের নিজস্ব যে চিন্তাধারা তা হলো দেশের অবস্থা কোন্দিকে যায় তার ঠিক নেই। বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না। বের হলেও সুরক্ষা যেনো নিশ্চিত থাকে। সেদিন অবশ্য তাদের কথাবার্তা এবং গম্ভীর মুখ-মণ্ডলে দেখে ভাইরাসের গুরুত্ব এবং ভয়াবহ কিছুটা আঁচ করতে পারছিলাম।

পরদিন যথারীতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকায় স্কুলে গেলাম। দ্বিতীয় ঘণ্টা শেষ করে যে যার মতো দলবেঁধে গ্রুপিং বিষয়ের ক্লাস করতে চলে এলাম। আমাদের রসায়ন বিষয়ে ক্লাস ছিলো। পিরিয়ডটা নিতেন আমাদের প্রধান শিক্ষক সাখাওয়াৎ হোসেন স্যার। অন্যান্য দিন অবশ্য এসেই জিজ্ঞেস করতেন, ‘আজকে কি পড়ানোর কথা?’

নিয়ম করে একজন এর উত্তরটা দিয়ে দিতো এবং স্যার সে বিষয়ে আলোচনা, বিশ্লেষণ কাজ ইত্যাদির মাধ্যমে পুরোটা ক্লাস পার করতেন। কিন্তু আজ সেরকম কিছুই হলো না। মুখে ডবল ওয়ানটাইম মাস্ক পরা। দেখে বুঝা গেলো আগে থেকেই সচেতন হচ্ছেন। পাশে বসা ক্লাসমেটরা অবশ্য অন্য কথা বললো তাদের বক্তব্য কিছুটা এমন যে, ‘কোথায় না কোথায় ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে তার জন্য আবার মাস্ক পরতে হয় নাকি? বোধহয় ধূলাবালির থেকে বাঁচার জন্যে ব্যবহার করছে। আরে ওয়ান টাইম মাস্ক স্যার তো তাই যে কেনো দোকানে বললেই এমনিতেই দিয়ে দেয়। ফা-ও পাইলে আলকাতরাও ভালো’ আরো নানা ধরনের মন্তব্য। তবে আমি একেবারেই চুপচাপ ছিলাম। কেননা স্যার ক্লাসে কথা বলা পছন্দ করেন না। তার উপর তিনি মাইর দিলে সে ব্যথা এক সপ্তাহের নিচে কমবে না। এ রকম নয়-ছয় ভেবেই ক্লাসে চুপ থাকতাম। যদিও তিনি কখনোই ক্লাসে বেত আনতেন না। তবে একদিন এনেছিলেন রসায়ন অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষার পর। রসায়ন খাতা দিয়ে দেখলেন ছাত্র-ছাত্রীদের নাম্বার তার মনমতো হয়নি। হবেই বা কিভাবে যে নাম্বার পেয়েছি তা দিয়ে কোনো মতে পাসের বর্ডার পার করেছি। অনেকে আবার সেটাও করতে ব্যর্থ। আর সবমিলিয়ে স্যার যা পড়িয়েছেন তার কিছুই তিনি খাতায় খুঁজে পাননি। এজন্যে সেদিন তিনি বেত আনতে বাধ্য হন।

যাই হোক, তার মাস্ক পরা নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের যে ধারণা ছিলো তা কিছুক্ষণের ভেতরই বদলে গেলো। প্রথমেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন তোমাদের মাস্ক কোথায়? সবার একই উত্তর ‘কিনি নি স্যার!’

তখন তিনি বললেন, খুব দ্রুত মাস্ক কিনে নাও দেশের অবস্থা ভালো না। কয়েকজন বলা বলি করতে লাগলো আমাদের এখানে তো ভাইরাস নেই! তাহলে এখন মাস্ক কিনে কি হবে। স্যার সাবলীলভাবে জবাব দেন যে, এটা একটা অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়া রোগ, কখন, কিভাবে কার শরীরে এর অবস্থান এটা কেউই জানে না। কখন, কিভাবে কার শরীরে ছড়ায় সেটাও কেউ নির্দিষ্টভাবে বলতে পারে না। তাই আমাদের উচিৎ সচেতন হওয়া। স্যারের কথায় সবাই কোনো রকম মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।

বলাবলি করতে লাগলো আজকেই ওয়ানটাইম মাস্কের বাক্স কিনে নিবো। কিন্তু না, সে চিন্তাধারাও দীর্ঘ হলো না। আবার পরক্ষণেই বললেন, ‘তোমরা কি জানে দেশে মাস্কের দাম বেড়ে গেছে?’ সবাই অবাক হলাম। বললাম না, স্যার! তিনি বললেন, আগে একটা ওয়ানটাইম মাস্ক কিনতাম তিন টাকা দিয়ে অর্থাৎ দুইটা পাঁচ টাকা দিয়ে কিনতাম। কিন্তু এখন সে মাস্কের দাম ২৫-৩০ টাকা করে বিক্রি করে। মাস্কের দাম আর বেশি বাড়ার আগে সংগ্রহ করে নাও...।

বুঝলাম দেশের মানুষের বিবেক অধপাতনে নামছে। মাত্র একজন ব্যক্তি আক্রান্ত হওয়ায় দেশের এ অবস্থা তাহলে যদি আরো আক্রন্ত হয় দেশের অবস্থা কি হবে! মাস্কের দাম তো আরো বেড়ে যাবে।

ঠিকই মাস্কের দাম বেড়েছে। করোনা রোগীর সংখ্যার সাথে সামঞ্জস্য রেখেই বাড়ানো হয়েছে। তাদের ধারণা এ-ই ছিলো যে, মানুষ মৃত্যু হাত থেকে বাঁচাতে যে কোনো উপায় অবলম্বন করবে। সুতরাং মাস্কের দাম একশ’ টাকা হলেও তারা এটা কিনবেই। তাদের কাছে কেবল লাভটাই গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো মানুষের জীবন নয়।

মার্চের মাঝামাঝি সময়। মাত্র পনের দিনের ছুটি ঘোষণা করে বন্ধ করে দেয়া হয় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু পনের দিনেই ক্ষান্ত হয়নি এর স্থায়ীত্ব। এই পনের দিনের রূপ আস্তে আস্তে রূপধারা বদলে আজকের এ বিশাল রূপ। অর্থাৎ অনির্দিষ্টকালের জন্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রতিবারই একটা নির্দিষ্ট তারিখ দিয়ে ঘোষণা দেয় যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে। কিন্তু পরিস্থিতির বিপর্যয়ে তা আর হয়ে ওঠে না। জনসাধারণকে সচেতন করাও সম্ভব হয় না। সরকার সবাইকে মাস্ক পরে বাইরে বের হতে বলেছে। আর তারা বলছে মাস্ক পরার দরকার নাই। আল্লাহই হেফাজত করবো। আরে ভাই! আল্লাহ বলেছেন তিনি হেফাজত করবেন তাই বলে কি আপনি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবেন! আপনার কি চেষ্টা করা উচিত নয়। চেষ্টা না করলে তো আপনি আল্লাহর হেফাজত প্রতাশা করতে পারেন না।

আজ বিশ্ব ভালো নেই। চারদিকে কেবলই লাশের গন্ধ। স্বজন হারানোর বুকফাটা আর্তনাদে চারিপাশ পরিপূর্ণ হয়ে মিলিয়ে যায় দিগন্তে। সবাই সব দিকে সঠিক। বাঙালি হিসেবে আমাদের যে বৈশিষ্ট্য তা হলো নিজের উপর বিপদ না আসলে আমরা কখনোই এর গুরুত্ব বুঝতে চেষ্টা করি না। আমার কারণে অন্য কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কি না সেদিকেও বিন্দুমাত্র লক্ষ্য নেই। সবার একই কথা, ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’। অর্থাৎ আমি আমার মন মতো যা-ই করি না কেনো তাতে কার ক্ষতি বা কার লাভ হচ্ছে সেটা আমার দেখার বিষয় না। এখানে কেবল আমার স্বার্থকতাই যথেষ্ট।

অথচ তারা এটা বুঝতে চায় না যে এভাবে চললে লাশের গন্ধ কমবে না, বরং এটা তীব্র আকার ধারণ করবে। আজ অন্যের স্বজন হারানো কান্না দেখছো! কাল হয়তো তুমি তোমার আপন কাউকে হারাবে। তোমার কান্না অন্য কেউ দেখবো। এজন্যই কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘যুগের ধর্ম এই! পীড়ন করলে সে পীড়া এসে পীড়া দেবে তোমাকেই’।

আমরা চাইলেই সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় করোনা প্রতিকার করতে পারি। অথচ আমরা অসচেতনভাবে বেঁচে আছি কারো দিকে কারো লক্ষ্য নেই। সকলেই আত্মমগ্ন। এভাবে চললে প্রতিরোধ তো দূরের কথা এই মহামারির হাত থেকে নিজকে বাঁচানো অসম্ভব হয়ে পড়বে।

* পাঠক ফোরাম বিভাগে লেখা পাঠানোর ঠিকানা

[email protected]

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়