রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫  |   ২৪ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইউসুফ গাজী গ্রেফতার

প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

গীতিকবি মুখলেসুর রহমান মুকুল স্মরণে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন

পলাশ দে
গীতিকবি মুখলেসুর রহমান মুকুল স্মরণে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন

বছরের কিছু মাস আসে আনন্দ ও বেদনা নিয়ে। একটি মাস আসলে শুধুই যে আনন্দ থাকে তা কিন্তু নয়, বরং বেদনা এমন হয় যেন জীবন চলায় সান্ত¡না দেয়ার কেউ থাকে না আশপাশের কোথাও। ১৭ জানুয়ারি তারিখটি বর্তমানে আমার কাছে তথা চাঁদপুর সংস্কৃতি অঙ্গনে অনেক বেদনার এবং বেদনাদায়ক। চাঁদপুর সংস্কৃতি ভাবধারার উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন গীতিকবি মুখলেসুর রহমান মুকুল। কবি, লেখক ও গীতিকার মুখলেসুর রহমান মুকুল ১৭ জানুয়ারি ২০২২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ২০২৪ সালের ১৭ জানুয়ারি ছিলো তাঁর ৩য় মৃত্যুবার্ষিকী।

গানের ভাষায় বলতে হয় ‘চলতে চলতে একদিন থেমে যাবো’। আমার সত্যিই খুব ভাগ্য খারাপ। কারণ হলো যে মানুষ সন্তানের মতো স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন সেই সব মানুষ এক এক করে না-ফেরার দেশে চলে গেলেন! মাঝে মাঝে ভীষণ মন খারাপ লাগে, যখন ভাবি শ্রদ্ধেয় মানুষ কত স্মৃতি, কত কথা, কত উপদেশ, কত পরামর্শ, সমাজিক কাজ, সঙ্গীতচর্চা, সংগঠন, পত্রিকায় লেখা ও সাংবাদিকতা, কবিতা লেখা, নাটকে অভিনয় করাসহ ইত্যাদি মহৎ ও সৎ কাজে নিজেকে জড়িয়ে রাখার যে উৎসাহ আজ সত্যিই মন থেকে হারিয়ে ফেলছি। প্রতিনিয়ত হারাতে হবে জীবনের পথচলার আরো অনেক বাস্তবতাকে।

গীতিকবি লেখক শুধু নয়, শ্রদ্ধেয় মুখলেসুর রহমান মুকুল ছিলেন চাঁদপুরের সুবিশাল বড় মন মানসিকতার মহৎপ্রাণ মানুষ। তিনি দেশের শিল্প ও সংস্কৃতি ভুবনে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শিল্পকলা পদক অর্জন করেছিলেন। শৌখিনভাবে তিনি চলাফেরা করতেন। চাঁদপুর স্টেডিয়াম রোডে সুবিশাল শৈল্পিক বাড়ি ছিলো তাঁর। যদিও হাজীগঞ্জ উপজেলায় মুখলেসুর রহমান মুকুলের পূর্বপুরুষের জন্মভূমি বাড়ি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। উচ্চশিক্ষিত হয়েও কর্মজীবনে তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী মানুষ। সৃজনশীল চিন্তার মানুষ মুখলেসুর রহমান মুকুল ছিলেন খাঁটি বাঙালি, তার কারণ হলো তিনি জীবন চলার পথে বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতি জাগরণে ছিলেন আপোষহীন মনোভাবের মহৎ মানুষ। তাঁর রচিত একটি গানের কথা উল্লেখ করছি তা হলো, ‘আমার পোষা ময়নাটা আর তো কিছু বলে না, বলে শুধু বাংলাদেশ আমার ঠিকানারে আমার ঠিকানা’ বা ‘সবুজের মাঝে লাল সূর্য আঁকা, আমাদের পতাকা প্রিয় পতাকা, আমাদের ভাই আর বোনের খুনে আঁকা পতাকা’। এ ধরনের দেশপ্রেমী গান শুনলে এমনিতেই মনে আরো একধাপ এগিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়, মনে সত্যিই জাগ্রত হয় দেশপ্রেম। যা খুব কাছ থেকে শ্রদ্ধেয় মুখলেসুর রহমান মুকুলকে দেখতে পেয়েছি। আমি ওনাকে কাকু বলেই ডাকতাম। তাঁর স্মৃতি কখনোই ভুলবার নয়, ভুলতে পারবো না কিছুতেই।

তিনি সৎ ভাবনায় জীবনযাপন করে গিয়েছেন। ভুল চিকিৎসার কারণে তিনি খুব কষ্ট পেয়েছেন। এক পর্যায় বিছানায় শুয়ে থাকতেন উঠে বসতে পারতেন না। কিন্তু তাঁর মনের শক্তি ছিলো প্রবল। তাই শুয়ে থেকে মোবাইলে আপনজন-বন্ধু-স্বজনদের সাথে কথা বলতেন। ফেসবুক ব্যবহারে ছিলেন সরব উপস্থিতি। তাঁর কিছু মনের কষ্টের কথা বলেছিলেন। সত্যিই তিনি এমনভাবে মৃত্যুবরণ করবেন তা ভাবতে পারিনি। ফোনে আমার সাথে মুকুল কাকুর শেষ কথা ছিলো ‘পলাশ কই তুমি, কেমন আছো, কী বলবো পলাশ, তোমার কাকিমা অসুস্থ ডাক্তার দেখাচ্ছে কিন্তু তোমার কাকিমার সাথে পাশে থাকতে পারলাম না, কী যে মন খারাপ লাগছে তা তোমাকে বুঝতে পারবো না’। আমি সেদিন তাঁর কথার কোনো উত্তর খুঁজে পাইনি, শুধু বলেছি, কাকু কী আর করবেন মহান সৃষ্টিকর্তা যা করবেন তাই মেনে নিতে হবে।

গীতিকবি মুখলেসুর রহমান মুকুল এক সন্তানের জনক। তাঁর সন্তান উচ্চশিক্ষিত এবং যতটুকু জানতে পেরেছি তিনি একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে উচ্চ পর্যায় চাকুরি করছেন। চাঁদপুর শহরের স্টেডিয়াম রোডে যখনই আসা যাওয়া হয় গীতিকবির বাসার দিকে চোখ রাখলে তাঁর স্মৃতি মনে হয়। মনটা না দেখার হাহাকার করে চোখ গড়িয়ে জল পড়ে। আজো তাঁর মৃত্যুর সংবাদটি কেনো জানি মেনে নিতে পাচ্ছি না। তার কারণ হলো তিনি বেঁচে থাকার জন্য অসুস্থতার মধ্যেও বাঁচার আকুতি খুব বেশি ছিলো। আমাকে তিনি প্রায়ই বলতেন, পলাশ টাকা জোগাড় করতে পারলে ইন্ডিয়া ভেলোর যাব চিকিৎসা হতে’। কিন্তু!তিনি যে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে না-ফেরার দেশে চলে যাবেন তা সত্যিই বলছি ভাবতেই পারিনি!

আমি ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য, সাংস্কৃতিক ভাবধারাকে ভীষণ ভালোবাসি এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ভালোবেসে যাব। ১৯৯২ সালে চাঁদপুর ললিতকলা সঙ্গীত বিদ্যালয়ে গান শিখার জন্য ভর্তি হই। এর সঙ্গীতগুরু শ্রদ্ধেয় প্রয়াত শীতল ঘোষাল ছিলেন সঙ্গীত শিক্ষক। গানের ক্লাসে পরিচয় করিয়ে দিলেন গীতিকবি মুখলেসুর রহমান মুকুলের সাথে। যতটুকু মনে পরে সেদিন শ্রদ্ধেয় শীতল ঘোষাল বলেছিলেন, মুকুল আমার একমাত্র ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ওর অনেক চমৎকার গান রয়েছে, যা আমি সুর করেছি, যা তোমরাও এক সময় কণ্ঠে তুলবে আশা করছি।

১৯৯৭ সালে চাঁদপুর শহরে বাংলা ও বাঙালির গৌরব এবং গর্ব মুম্বাইয়ের মেগাস্টার শক্তিমান অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তীর নামে মিঠুন ফ্রেন্ডস্ এসোসিয়েশন সংগঠনের প্রতিষ্ঠা করার পর, যিনি সংগঠন করার বিষয়টি মনোযোগ দিয়ে শোনার পর সব চেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলেন গীতিকবি মুখলেসুর রহমান মুকুল অন্যতম উৎসাহদাতা। তিনি ও তাঁর বন্ধু শীতল ঘোষাল ছিলেন মিঠুন ফ্রেন্ডস্ এসোসিয়েশন সংগঠনের উপদেষ্টা।

কোলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘মানুষ মিঠুন চক্রবর্তী’ বইটি অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তীর স্বাক্ষরসহ অভিনন্দন গীতিকবি মুখলেসুর রহমান মুকুলকে। বইটি পেয়ে দারুণ খুশি হয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় মুখলেসুর রহমান মুকুল। সেদিনের আনন্দঘন মুহূর্ত ভাবলে যা লিখে সেই অনুভূতি বোঝানো যাবে না।

ইন্ডিয়ার ত্রিপুরার আগরতলা থেকে আসলেন নজরুল গবেষক ও সঙ্গীতজ্ঞ পঙ্কজ মিত্র চাঁদপুরে। পূর্বেই পঙ্কজ মিত্র মহাশয়ের সাথে আমার পরিচয়। তাই তিনি চাঁদপুর আসার খবর পেয়ে আমি মুকুল কাকুকে বিষয়টি বলেছি। তখন আমাকে বললেন, ভদ্রলোক আসুক, আসার পর তুমি আমার বাসায় নিয়ে আসবে। তো যা কথা তা কাজ। পঙ্কজ মিত্র চাঁদপুর আসলেন, অবশ্য পঙ্কজ মিত্র চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের নেতা, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত বাবু গনেশ কর্মকারের আপন ছোটবোনের বর। পুরো পরিচয় পেয়ে শ্রদ্ধেয় গীতিকবি মুখলেসুর রহমান মুকুল কাকু, নজরুল ভক্ত পঙ্কজ মিত্রকে জামাইবাবু বলেই ডাকলেন। এর মধ্যে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ পত্রিকায় পঙ্কজ মিত্র চাঁদপুর আগমনে তাঁর বিশাল একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হলো। সাক্ষাৎকারের পত্রিকাটি হাতে পেয়ে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন পঙ্কজ মিত্র। আর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন চাঁদপুরের তরুণ কবি ও গবেষক মুহাম্মদ ফরিদ হাসান। পত্রিকাটি হাতে পেয়ে হাসি দিয়ে খুশিতে বললেন, পলাশ চলো চাঁদপুর কণ্ঠ অফিসে গিয়ে কাজী শাহাদাত সাহেবের সাথে দেখা করি। এরপর শ্রদ্ধেয় কাজী শাহাদাত ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করে অফিসে সন্ধ্যায় পঙ্কজ মিত্রকে নিয়ে যাই। শাহাদাত ভাই তাঁকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানালেন। আজ যা শুধুই স্মৃতি।

গীতিকবি মুখলেসুর রহমান মুকুল ও নজরুল ভক্ত পঙ্কজ মিত্র এক হয়ে নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, আধুনিক গান, পল্লীগীতি, ভক্তিমূলক গান নিয়ে অনেক অনেক কথা বললেন এবং একে অপরের সাথে অজানা অনেক তথ্যনির্ভর কিছু জানতে পারলেন। এক পর্যায়ে শ্রদ্ধেয় গীতিকবি মুকুল কাকু নজরুল ভক্ত পঙ্কজ মিত্রকে স্মৃতিতে রাখার জন্যে একটি গান রচনা করলেন।

গানের কথাগুলো ভীষণ পছন্দ করলেন পঙ্কজ মিত্র। তিনি গানের মুখের চার লাইনের গানের তাৎক্ষণিক কিছু সময় নিয়ে সুর করে শোনালেন, গানের সুর গীতিকবির কাছেও খুব ভালো লাগলো বলে মত প্রকাশ করেছিলেন।

পঙ্কজ মিত্র শেষ চাঁদপুর থেকে বিদায় পূর্বে গীতিকবিকে বললেন, মুকুল ভাই যদি আরো আগে আপনাকে এতো কাছে পেতাম বা আমি যদি আগরতলা থেকে সময় করে করে চাঁদপুরে আসতে পারতাম তবে আপনার আমার সুর করা বহু গান সৃষ্টি করতে পারতাম। সত্যিই মনের মাঝে অনেক স্মৃতি জমে রয়েছে। শুধু চেষ্টা করছি স্মৃতিময় দিনগুলো প্রকাশ করতে।

দুঃখজনক হলেও সত্য, মানুষ মরণশীল, কেউ আমরা বেঁচে থাকবো না, পৃথিবীর মায়াত্যাগ করতেই হবে, জীবনচলায় ভুলত্রুটিসহ কিছু স্মৃতিই রয়ে যাবে। সৎকর্ম ভালো কিছু কেউ মনে রাখবে, কেউ রাখবে না এটাই চির সত্য ও বাস্তবতা।

গীতিকবি মুখলেসুর রহমান মুকুল ও নজরুল ভক্ত পঙ্কজ মিত্র পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন যা তিন বছর হয়ে গেল। আর সঙ্গীতগুরু শীতল ঘোষাল মৃত্যুবরণ করেন তাও অনেক বছর পার হতে চলো! তাঁদের স্মৃতির প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। বিদেহী আত্মার চির শান্তি লাভ করুণ উপরওয়ালার কৃপা প্রার্থনা করছি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়